বেসরকারি ইস্টার্ন, সিটি ও ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবি) চার এটিএম বুথে কার্ডের তথ্য-উপাত্ত বা ডেটা চুরির যন্ত্র ‘স্কিমিং ডিভাইস’ বসানো অবস্থায় ওই সব বুথে ১ হাজার ২০০ কার্ডের লেনদেন হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে গতকাল মঙ্গলবার এ তথ্য জানা গেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে আরও জানা যায়, গতকাল পর্যন্ত বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত যাচাই-বাছাই করে ৪০টি কার্ড ক্লোন করে গ্রাহকের অজান্তে প্রায় ২০ লাখ টাকা তুলে নেওয়ার তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে। এই ৪০টি কার্ডের সিংহভাগই উল্লিখিত তিন ব্যাংকের।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা দৈনিক বার্তাকে বলেন, ‘চার বুথে স্কিমিং ডিভাইস বসানো অবস্থায় ১ হাজার ২০০টি কার্ডের লেনদেন সম্পন্ন হয়। তাই আমরা আশঙ্কা করছি, এসব কার্ডের গ্রাহকের ব্যক্তিগত তথ্য বা ডেটা চুরি হয়ে গেছে। এর মধ্যে ৪০টির মতো কার্ড ক্লোন করে টাকা তুলে নেওয়ার তথ্য মিলেছে। বাকি কার্ডগুলোকে ইতিমধ্যে নিষ্ক্রিয় করে বিকল্প কার্ড ইস্যু করা হয়েছে।’
৬ থেকে ১২ ফেব্রুয়ারির মধ্যে রাজধানীর গুলশান, মিরপুরের কালশী ও বনানী এলাকার ইস্টার্ন, সিটি ও ইউসিবির চার বুথে স্কিমিং ডিভাইস বসিয়ে কার্ড জালিয়াতি ও পরবর্তী সময়ে গ্রাহকের অজান্তে টাকা তুলে নেওয়ার ঘটনা ঘটে। তবে তা জানাজানি হয় ১২ ফেব্রুয়ারি, শুক্রবার। ওই দিন ইস্টার্ন ব্যাংকের একাধিক গ্রাহক মুঠোফোনে খুদে বার্তার মাধ্যমে নিজেদের হিসাব থেকে টাকা তুলে নেওয়ার বিষয়টি জেনে ব্যাংকে অভিযোগ করেন। একসঙ্গে বেশ কিছু গ্রাহকের অভিযোগ পেয়ে ব্যাংক তদন্তে নামলে এ জালিয়াতির বিষয়টি জানাজানি হয়। কার্ড জালিয়াতির এ ঘটনায় রাজধানীর পল্লবী থানায় আরও একটি মামলা হয়েছে। গত সোমবার সিটি ব্যাংকের পক্ষ থেকে এ মামলা করা হয়। ব্যাংকটির অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও মুখপাত্র মাশরুর আরেফিন মামলা দায়েরের বিষয়টি দৈনিক বার্তাকে নিশ্চিত করেন।
এর আগে গত শুক্রবার এ জালিয়াতির ঘটনায় বনানী থানায় মামলা করেছিল ইউসিবি। ইউসিবির মামলাটি এখন ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) তদন্তাধীন রয়েছে। গত সোমবার রাতে বনানী থানা থেকে মামলাটির তদন্তভার ডিবির হাতে হস্তান্তর হয়। তবে এখন পর্যন্ত এ ঘটনায় পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। এদিকে জালিয়াতির ঘটনায় ইস্টার্ন ব্যাংকের যে ২১ জন গ্রাহকের হিসাব থেকে টাকা তুলে নেওয়ায় ঘটনা ঘটেছে, সেসব গ্রাহককে আগামীকাল বৃহস্পতিবার টাকা ফেরত দেওয়া হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমানের উপস্থিতিতে এ টাকা ফেরত দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে ইস্টার্ন ব্যাংকের জনসংযোগ বিভাগের প্রধান জিয়াউল করিম বলেন, ২১ জন গ্রাহকের যার যত অর্থ খোয়া গেছে পুরোটাই ফিরিয়ে দেওয়া হবে। সরাসরি গ্রাহকের হাতে এ অর্থ তুলে দিতে বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের সম্মেলনকক্ষে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট তিন ব্যাংকের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পুলিশের পাশাপাশি এ ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের খুঁজে বের করতে র্যাবও কাজ করছে। র্যাবের পক্ষ থেকেও সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর এটিএমের (অটোমেটেড টেলার মেশিন) গোপন ক্যামেরায় ধারণকৃত ভিডিও চিত্র সংগ্রহ করা হয়েছে। এদিকে গতকাল থেকে প্রায় সব ব্যাংকের এটিএমে আন্তব্যাংক লেনদেন সচল হয়েছে। ভিডিওতে যা আছে: দৈনিক বার্তার হাতেও একটি ব্যাংকের বুথের ভিডিও চিত্র রয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, ৭ ও ৮ ফেব্রুয়ারি একই ব্যক্তি সকাল ও রাত মিলিয়ে চার দফায় ওই বুথে ঢোকেন। বিদেশি চেহারার ওই ব্যক্তির চোখে ছিল চশমা, মাথায় কালো টুপি আর কাঁধে ঝোলানো ছোট একটি কালো ব্যাগ। ৭ ফেব্রুয়ারির ভিডিও চিত্রে দেখা যায়, সকাল ১০টা ৪৩ মিনিটের দিকে বুথে ঢুকেই প্রথমে তিনি বাঁ হাতে এটিএমে ওপরের অংশে বসানো গোপন ক্যামেরার মুখে কিছু একটা গুঁজে দিচ্ছেন। যাতে করে তাঁর চেহারাটি ক্যামেরায় ধরা না পড়ে। সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, বুথে একাধিক গোপন ক্যামেরা ছিল। কিন্তু সেটি হয়তো জানা ছিল না ওই ব্যক্তির। তাই একটি ক্যামেরার চোখ বন্ধ করতে পারলেও অন্যগুলোতে তা ধরা পড়ে যায়। এটিএমের ওপরের অংশের ক্যামেরার মুখে কিছু একটা গুঁজে দেওয়ার পর তাকিয়ে দেখেন বুথের প্রবেশের গেটের দিকে। এরপর কালো ব্যাগ থেকে কিছু একটা বের করে তা বুথের গোপন পিন নম্বর প্লেটের ওপরের অংশে স্থাপন করেন। সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের বিশেষজ্ঞ সদস্যদের মতে, প্রথমে বিদেশি ওই ব্যক্তি তাঁর নিজের গোপন একটি ক্যামেরা বসান মেশিনের পিন নম্বর প্লেটের ওপরের অংশে। যাতে গ্রাহকের পিন নম্বরটি ওই ক্যামেরায় ধরা পড়ে।
ক্যামেরা বসানোর পর কালো ব্যাগ থেকে আরেকটি যন্ত্র বের করে তা কার্ডের প্রবেশমুখে বসানো হয়। ব্যাংকারদের মতে, সেটি ছিল স্কিমিং ডিভাইস। যেটি দিয়ে কার্ডের ব্যক্তিগত গোপন তথ্য চুরি করা হয়। যন্ত্রটি বসানোর কাজ শেষ হওয়ার পর ওই বিদেশি আরেক দফা ভালোভাবে সব পরখ করে দেখে বেরিয়ে যান বুথ থেকে। পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করতে সময় নেন দুই মিনিটের মতো। একই দিন রাত ৮টা ৫৭ মিনিটের দিকে একই সাজপোশাকে তিনি আবার ওই বুথে ঢোকেন। প্রথমে গোপন ক্যামেরাটি খুলে সঙ্গে থাকা কালো ব্যাগে ঢোকান। এরপর খুলে নেওয়া হয় স্কিমিং ডিভাইসটি। এরপর বেরিয়ে যান তিনি। এ দফায় সময় নেওয়া হয় এক মিনিটের কিছু বেশি। একই ব্যক্তি ৮ ফেব্রুয়ারি সকালে ও রাতে একই বুথে ঢুকে ৭ ফেব্রুয়ারির মতো একই কাজের পুনরাবৃত্তি ঘটান। ভিন্নতা ছিল কিছুটা শুধু পোশাকের রঙে ও সময়ে। ৮ ফেব্রুয়ারি বেলা ১১টা ৩৫ মিনিটে তিনি বুথে ঢুকে যন্ত্রগুলো বসিয়ে দিয়ে বেরিয়ে যান। আর রাত ৮টা ৫৫ মিনিটের দিকে এসে বসানো যন্ত্রগুলো খুলে ব্যাগে ভরে বেরিয়ে যান।