* বরকতের প্রিয় বন্দুকটি সংরক্ষণের জন্য সরকারের উদ্যোগ প্রয়োজন ॥
* চাকুরিজীবীদের ভাতা বাড়লেও বাড়েনি ভাষা শহীদদের সম্মানী ভাতা ॥
* একুশের বই মেলাসহ আয়োজিত অনুষ্ঠাণে ভাষা শহীদ পরিবারদের আমন্ত্রণ জানানো হয় না ॥
* শহীদ মাতার কবরে শ্রদ্ধা জানাতে আগতদের নিরাপত্তা দেয়া হচ্ছে না ॥
প্রতি বছর শুধু আন্তর্জাতিক মাতৃ ভাষা দিবস ২১ ফেব্রুয়ারি এলেই ভাষা শহীদদের খোঁজ-খবর নেওয়া বা শুধু সরকারী সম্মানী ভাতা নয়, প্রয়োজন ভাষা আন্দোলনে শহীদ ও সৈনিকদের এখন পরিপূর্ণ রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও মর্যাদার। সেই সঙ্গে তাদের স্মৃতি যথাযথ মর্যাদায় সংরক্ষণ করা। মুক্তিযোদ্ধাদের মতো ভাষা শহীদ ও সৈনিকদের উত্তরসূরীদের চাকুরি ও ভর্তি কোটাসহ অন্যান্য রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধার দাবি করেছেন ভাষা শহীদ বরকত পরিবারের সদস্যরা। এছাড়াও যে ক’জন ভাষা সৈনিক বর্তমানে বেঁচে আছেন মৃত্যুর পর তাদেরকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফনের জন্যও সরকারের কাছে দাবী করেছেন তারা। শহীদ বরকত পরিবারের সদস্যরা অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, সম্প্রতি চাকুরিজীবিদের বেতন ভাতাদি বৃদ্ধি করা হলেও বাড়েনি ভাষা শহীদদের সম্মানী ভাতা। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে আগে অন্ততঃ প্রতি বছর শুধু ২১ ফেব্রুয়ারি এলেই ভাষা শহীদদের খোঁজ-খবর নেওয়া হতো। কিন্তু এখন আর তেমনটা খোঁজ নেওয়া হয় না। ভাষা শহীদদের পরিবারের সদস্যরা এখন অনেকটাই অবহেলিত। বর্তমানে ভাষা শহীদ ও সৈনিকদের স্মরণে যে একুশের বই মেলা এবং রাষ্ট্রীয়সহ বিভিন্ন অনুষ্ঠাণের আয়োজন করা হয়, সেখানেও তাদের কোন পরিবারের কাউকে আমন্ত্রণ জানানো হয় না। তবে দিবসটি উপলক্ষে শুধু সাংবাদিকরা খোঁজ নেন তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য। এমনকি দিবসটি উপলক্ষে গত কয়েক বছরে গাজীপুরের নলজানীতে শহীদ বরকতের মাতার কবরে শ্রদ্ধা জানাতে আগতদের নিরাপত্তাও নিশ্চিত করছেনা আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
মহান ভাষা আন্দোলনের অন্যতম শহীদ পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদের তরুণ আবুল বরকতের প্রিয় শহর ছিল ঢাকা। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষে এখানেই থাকার ছিল তার। পড়াশোনা শেষ করতে না পারলেও তার সে স্বপ্ন সফল হয়েছে, তবে এখানে অন্তিম শয়ান লাভ করে। বরকতকে এদেশে চির নিদ্রায় রেখে স্থির থাকতে পারেননি তাঁর পরিবার। তাই প্রিয়জনের মায়ায় জন্মভূমি ছেড়ে তারাও এদেশে চলে আসেন। আদরের বড় ছেলে আবুল বরকত ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের মিছিলে শহীদ হওয়ার পর তার বাবা-মাও সিদ্ধান্ত নেন ঢাকায় আসার, যাতে অন্ততঃ বছর বছর আজিমপুরের কবরস্থানে চিরনিদ্রায় ঘুমিয়ে থাকা ছেলেকে একটু আদর করে আসতে পারেন। কিন্তু ১৯৬৩ সালের ২১ জুলাই বরকতের বাবা শামসুজ্জোহা ভুলু মিয়া ভারতে মারা যাওয়ার পরের বছর বরকতের মা হাসিনা বানু ১৯৬৪ সালে আংশিক সম্পত্তি বিনিময় করে ভারত থেকে এদেশে চলে আসেন। নিবাস গাড়েন গাজীপুর মহানগরের চান্দনা গ্রামের ‘বাবলা বিথী’তে। শহীদ বরকতের একমাত্র ভাই আবুল হাসনাত রোগাক্রান্ত হয়ে ১৯৬৮ সালের ২১ সেপ্টেম্বর এখানেই মারা যান। তার ৩ ছেলে ও ৩ মেয়ে। বরকতের চার বোনই গতায়ু হয়েছেন ইতোমধ্যে। বরকতের ছোট ভাই আবুল হাসনাতের সন্তানরাই এখন আকড়ে ধরে আছেন ভাষা শহীদ বরকতের ব্যক্তিগত স্মৃতি। গাজীপুরের চান্দনা গ্রামে এখন বসবাস করছেন বরকতের তিন ভাতিজা এবং তাদের সন্তানরা। শহীদ বরকতের মা হাসিনা বানু ১৯৮২ সালের ২১ এপ্রিল এবাড়িতেই মারা যান। বরকত ও তাঁর মা, বাবা এবং ভাইয়ের মৃত্যু যেন একই সূত্রে গাঁথা। এদের সবাই মারা গেছেন বিভিন্ন বছরের বিভিন্ন মাসের একই তারিখ একুশে’তে। গাজীপুরের জয়দেবপুর, পূবাইল ও কালিয়াকৈরসহ বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বরকতের অন্যান্য আত্মীয় স্বজন।
রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আত্মদানকারী শহীদ বরকতের আদি নিবাস পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার ভরতপুর থানার বাবলা গ্রামে। গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা শেষে ১৯৪৫ সালে তালিবপুর হাই স্কুল থেকে প্রবেশিকা এবং বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে ১৯৪৭ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাসের পর সেবছরই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানে বিএ অনার্স শ্রেণীতে ভর্তি হন। শুরুতে তিনি ওঠেন মামা আব্দুল মালেকের আজিমপুরের বাসায়। পরে ছাত্রাবাসে। ১৯৫১ সালে দ্বিতীয় শ্রেণীতে চতুর্থ স্থান পেয়ে অনার্স পাস করে তিনি এমএ শেষ পর্বে ভর্তি হয়েছিলেন। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন শুরু হলে তিনি তাতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহন করেন। আন্দোলনের চুড়ান্ত পর্যায়ে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বিকালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেলের সামনে আমতলায় সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মী পরিষদের ডাকে সমাবেশে যোগ দেন বরকত। পাকিস্তান সরকারের জারি করা ১৪৪ ধারা ভেঙে ছাত্র-জনতার শ্লোগানে কেঁপে উঠে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। পুলিশের সঙ্গে কয়েক দফা বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এক পর্যায়ে পুলিশের গুলিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে হোস্টেলের ১২ নম্বর শেডের বারান্দায় লুটিয়ে পড়েন বরকত। গুলিবিদ্ধ বরকত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরী বিভাগে ভর্তি অবস্থায় রাত ৮টায় মারা যান। ওই রাতেই তাঁর আত্মীয়-স্বজনদের উপস্থিতিতে একজন ম্যাজিষ্ট্রেটের তত্ত্বাবধানে আজিমপুর গোরস্থানে শহীদ বরকতকে দাফন করা হয়। শহীদ হওয়ার দীর্ঘ সময় পর ২০০০ সালে শহীদ আবুল বরকতকে মরণোত্তর একুশে পদক দিয়ে সম্মানিত করা হয়।
পাকিস্তান শাসনামলে প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলো সবসময় বরকতের মা হাসিনা বানুর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতো। স্বাধীনতা লাভের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাসে হাসিনা বানু দেখা করতেন। বরকতের ভাতিজারা জানান, বঙ্গবন্ধু বরকতের মা হাসিনা বানুকে মা বলে সম্বোধন করতেন, আর হাসিনা বানু বঙ্গবন্ধুকে বলতেন ‘শেখজী’। ১৯৭৩-এর ফেব্রুয়ারিতে হাসিনা বানু মুর্শিদাবাদে ছিলেন। বঙ্গবন্ধু ভিসা ও বিমানের টিকেট পাঠিয়েছিলেন তাঁকে আনতে। ১৯৮২ সালের ২১ এপ্রিল হাসিনা বানু মৃত্যু বরণের আগ পর্যন্ত কমবেশি সব রাষ্ট্র প্রধান এই পরিবারের খোঁজখবর নিতেন। এখন তেমন কেউ আসেন না গাজীপুরের চান্দনা গ্রামের ‘বাবলা বিথী’তে। ইতোপূর্বে ২১ ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে সরকারী পর্যায়ে ভাষা শহীদদের খোঁজ-খবর নেওয়া হতো। কিন্তু এখন আর তেমনটা খোঁজ নেওয়া হয় না। এমনকি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে যাদের স্মরণে রাজধানীতে বই মেলা এবং রাষ্ট্রীয়সহ বিভিন্ন অনুষ্ঠাণের আয়োজন করা হয়, সেখানেও ভাষা শহীদদের কোন পরিবারের কাউকে আমন্ত্রণ জানানো হয় না। তবে দিনটি উপলক্ষে শুধু সাংবাদিকরা আসেন তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য। ভাষা শহীদদের পরিবারের সদস্যরা এখন অনেকটা অবহেলিত।
‘বাবলা বিথী’তে থাকেন শহীদ বরকতের ভাই মরহুম আবুল হাসনাতের তিন ছেলে আলাউদ্দিন বরকত, আইন উদ্দিন বরকত ও জালাল উদ্দিন বরকত। এদের মধ্যে একজন স্থানীয় একটি বোতাম ফ্যাক্টরিতে চাকুরী করেন। আর শেষোক্ত দু’জন ব্যবসা করেন। ১৯৮১ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ঢাকা-জয়দেবপুর সড়কের চান্দনা গ্রাম সংলগ্ন নলজানী মৌজায় হাসিনা বানুকে ৬৮ শতাংশ জমি দান করেন। এই জমির একাংশে পরিবারের সদস্যরা নিজ উদ্যোগে শহীদ বরকত স্মরণে বরকত স্মৃতি পাঠাগার ও একটি মসজিদ নির্মাণ করেন এবং অপর অংশে দোকান নির্মাণ করে তা দেখাশোনা করেন আবুল হাসনাতের ছোট ছেলে জালাল উদ্দিন বরকত। এ জমিরই একপার্শ্বে (পূর্ব-দক্ষিণে) চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন শহীদ মাতা হাসিনা বানু। প্রতিবছরের ২১ ফেব্রুয়ারি শাহাদাৎ বার্ষিকীতে শহীদ বরকত স্মরণে এখানেই পরিবারের পক্ষ থেকে এখানেই আয়োজন করা হয় মিলাদ ও দোয়া মাহফিল, কাঙ্গালী ভোজ ও আলোচনা সভা। এছরও সেসব কর্মসূচির আয়োজন করেছে বরকত পরিবার। অথচ সম্প্রতি স্থানীয় একটি প্রভাবশালী মহলের নজর পড়ে এ জমিটির ওপর। বরকত পরিবারকে ওই জমি থেকে উচ্ছেদ করতে বিষয়টি নিয়ে আদালত পর্যন্ত গড়ায়। মাসখানেক আগে এ বিষয়টির নিষ্পত্তি হলে ভোগ দখলে রয়ে যান বরকত পরিবার। ছয়-সাত বছর আগেও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রচুর লোক ও সরকারের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তারা আসতো চান্দনা গ্রামের বাবলা বিথীতে। বর্তমানে ২১ ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কয়েক কর্মকর্তা এসে নিজেদের দায়িত্ব পালন করছেন। বরকতের আত্মীয়দের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ডাকা হতো অতিথি হিসেবে। কিন্তু এখন কালের ব্যবধানে সব আবেগ যেন থিতিয়ে পড়েছে। আগে প্রতি বছর শুধু ২১ ফেব্রুয়ারি এলেই শহীদ পরিবারদের খোঁজ-খবর নেওয়া হতো। কিন্তু এখন আর তাদের খোঁজ আর কেউ করে না। ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিকভাবে মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি বরকতের স্বজনদের খুশি অনেক বেড়ে গেছে। এবছর ২১ ফেব্রুয়ারি তারা সবাই আসবেন আজিমপুরে শহীদ বরকতের কবরে এবং শহীদ মিনারে। শ্রদ্ধা জানাবেন প্রিয় স্বজন দেশ উজ্জ্বল করা মুখ শহীদ বরকতসহ সব ভাষা শহীদের প্রতি।
বরকতের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শহীদ পরিবারের সদস্য হিসেবে তাদের যেমন গর্ব আছে, তেমনি কিছু ক্ষোভ এবং অভিমানও রয়েছে। কারণ পারিবারিক উদ্যোগে বরকতের স্বজনরা চান্দনা গ্রামে তাদের বাসার সামনের রাস্তাটির নাম রেখেছেন ‘শহীদ বরকত স্মরণী’। স্থানীয় লোকজন এব্যপারে সহযোগিতার হাত বাড়ালেও প্রশাসনিকভাবে সহযোগিতা করা হয়নি বলে আক্ষেপ করলেন ভাতিজা আলাউদ্দিন বরকত। অনুযোগের সুরে আরেক ভাতিজা আইন উদ্দিন বরকত টুটু বলেন, বরকত বরকত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও দীর্ঘদিনেও তার নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন হল কিংবা কোন কিছুর নামকরণ করা হয়নি। তবে গত তত্ত্বাবধায়ক সরকার সরকার সাত বীরশ্রেষ্ঠ ও চার ভাষা শহীদের নামে স্মৃতি জাদুঘর, গ্রন্থাগার নির্মাণ এবং এগুলো তাদের নামে নামকরণের সিদ্ধান্ত নিয়ে নির্মাণ কাজ শুরু করেন। শহীদ বরকতের নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোল ঘেঁষে রাজধানীর পলাশীর মোড়ে ‘ভাষা শহীদ আবুল বরকত স্মৃতি জাদুঘর ও সংগ্রহশালা’ নির্মিত হয়। প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনার বর্তমান সরকারের স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক ২০১২ সালের ২৫ মার্চ এ জাদুঘরের উদ্বোধন করেন। এছাড়াও বিগত তত্ত্ববধায়ক সরকারের সময়ে তৎকালীন জেলা প্রশাসক মিজানুর রহমানের প্রচেষ্টায় গাজীপুর জেলা শহরে নির্মিত স্টেডিয়ামটির নামকরণ করা হয় ভাষা শহীদ আবুল বরকতের নামে।
তিনি বলেন, আমরা চাই অন্ততঃ গাজীপুরে শহীদ বরকতের নামে কোন বড় প্রতিষ্ঠাণের নামকরণ করা হোক। তার মতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সালাম-বরকত হল’ ছাড়া দেশে বরকতের নামে উল্লেখযোগ্য আর কোন প্রতিষ্ঠাণ নেই।
শহীদ আবুল বরকতের কবর ও স্মৃতি জাদুঘর ॥ ১৯৫২ সাল ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের সামনে আমতলায় সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মী পরিষদের ডাকে সমাবেশে যোগ দেন বরকত। ঢাকাসহ সারা দেশে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে তখন আন্দোলন তীব্র হয়ে উঠেছে। পাকিস্তান সরকারের জারি করা ১৪৪ ধারা ভেঙে ছাত্র-জনতার শ্লোগানে কেঁপে উঠে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। পুলিশের সঙ্গে কয়েক দফা বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এক পর্যায়ে পুলিশের গুলিতে লুটিয়ে পড়েন বরকত। সেদিন রাতেই (৮টায়) ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই ভাষা সংগ্রামী। পরে আজিমপুর গোরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়। ২০০০ সালে শহীদ আবুল বরকতকে মরণোত্তর একুশে পদক দিয়ে সম্মানিত করা হয়। তার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এবং ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিকে ধরে রাখতে পলাশী মোড় সংলগ্ন এলাকায় একটি শহীদ আবুল বরকত স্মৃতি জাদুঘর ও সংগ্রহশালা গড়ে তুলেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সেখানে এই ভাষা শহীদের ব্যবহৃত কাপ-পিরিচ, ঘড়ি, হাতে লেখা চিঠি, ভাষা আন্দোলনের ওপর প্রামাণ্যচিত্র, একুশে পদক (মরণোত্তর) ও তার ছবি সংরক্ষণ করা হয়েছে। জাদুঘরের দ্বিতীয় তলায় রয়েছে একটি পাঠাগার যেখানে ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের ওপর তিন শতাধিক বই রয়েছে।
বরকতের প্রিয় বন্দুকটির জন্য সরকারী উদ্যোগ প্রয়োজন ॥ শহীদ বরকতের ভাতিজা আইন উদ্দিন বরকত বলেন, ভাষা শহীদ বরকতের ব্যবহৃত কাপ-পিরিচ ও ঘড়ি তার পরিবারের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে বরকত স্মৃতি জাদুঘর ও সংগ্রহশালায় দেয়া হলেও সেগুলো এখনও সর্বসাধারণের প্রদর্শণের জন্য ‘ডিসপ্লে’ করা হয়নি। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে নিরাপত্তার অভাবে সেগুলো এখনো ‘ডিসপ্লে’ করা হয়নি। এ কারনে আমাদের সংরক্ষণে থাকা বরকতের হাতে লিখা চিঠিসহ তার ব্যবহৃত কিছু জিনিসপত্র এখনো সেখানে দেয়া হয়নি। এছাড়াও মুর্শিদাবাদের বাড়িতে যে খাটে বরকত ঘুমোতেন সে খাটটি এখনো তার খালাতো ভাই মরহুম আবুল হায়াতের গ্রামের বাড়ি মুর্শিদাবাদের কাগ্রামে রয়েছে। বরকতের কেনা বেলজিয়ামের তৈরী তার প্রিয় দো’নলা বন্দুকটিও উপযুক্ত লোক না থাকায় কাগ্রামের বাসিন্দা আলা উদ্দিন ওরফে আলু’র হেফাজতে রয়েছে। এ বন্দুক দিয়ে বরকতের গুলিতে তার বাড়িতে হানা দেয়া ডাকাত দলের এক সদস্য ইদু ডাকাত গুলিবিদ্ধ হয়ে বাম চোখ হারায়। পরবর্তীতে ইদু ডাকাত ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলে, বরকতের গুলিতে আমি একটি চোখ হারালেও তাতে আমার কোন আফসোস নেই, এতে আমি নিজেকে ভাগ্যবান বলে মনে করি। এঘটনার পর আবুল বরকত শহীদ হওয়ার পর বন্দুকটি প্রথমে তার ভাই আবুল হাসনাত সংরক্ষণ করেন। তিনি মারা যাওয়ার পর সেটি তার স্ত্রী (শহীদ বরকতের ভাবী) হাসনে বানু সংরক্ষণ করেন। পরবর্তীতে তিনিও মারা যাওয়ার পর উপযুক্ত কেউ না থাকায় (আগ্নেয়াস্ত্র সংরক্ষণের আইন অনুযায়ী) আলা উদ্দিন ওরফে আলু তার হেফাজতে নেন। পরিবারের পক্ষ থেকে বরকত স্মৃতি জাদুঘর ও সংগ্রহশালার জন্য খাটটি এদেশে আনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তবে আগ্নেয়াস্ত্র বহন ও সংরক্ষনের ব্যাপারে রাষ্ট্রীয় আইনের কারনে উদ্যোগ নেয়া সম্ভব নয়। আমাদের দাবী সরকারীভাবে এব্যাপারে উদ্যোগ নিয়ে তার প্রিয় বন্দুকটি বরকত স্মৃতি জাদুঘর ও সংগ্রহশালায় এনে সংরক্ষণ করা হউক। নতুবা তার এ স্মৃতিটি হারিয়ে যাবে।
বরকত পরিবারের আবেদন ॥ শুধু সম্মানী ভাতা নয়। আমরা শহীদদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও মর্যাদাও চাই বলে দাবী জানিয়েছে শহীদ বরকতের পরিবার। শহীদ বরকতের পরিবার জানায়, দেরীতে হলেও একুশের ভাষা শহীদ বরকত পরিবারকে ২০০৬ সাল থেকে সরকারিভাবে প্রতিমাসে পাঁচ হাজার টাকা করে সম্মানী ভাতা দেয়া শুরু হয়। পরবর্তীতে বর্তমান আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় এসে ২০১৪ সাল থেকে তা দ্বিগুণ করে প্রতিমাসে ১০ হাজার টাকা করে সম্মানী ভাতা দিচ্ছে। সম্প্রতি চাকুরিজীবিদের বেতন-ভাতাদি বাড়ালেও ভাষা শহীদদের সম্মানী ভাতা বাড়ানো হয়নি। কিন্তু সরকারের দেয়া সম্মানী ভাতার এ টাকা পেতে তাদের সংশ্লিষ্টদের তাগাদা ও নানা ধরনের তদবির করতে হয়। নানা কাঠ খড় পোড়াতে হয়। ভাষা শহীদ বরকত পরিবারের সদস্যরা মুক্তিযোদ্ধাদের মতো ভাষা শহীদ ও সৈনিকদের উত্তরসূরীদের চাকুরি ও ভর্তি কোটাসহ অন্যান্য রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধার দাবি করেছেন। এছাড়াও যে ক’জন ভাষা সৈনিক বর্তমানে বেঁচে আছেন মৃত্যুর পর তাদেরকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফনের জন্যও সরকারের কাছে দাবী করেছেন তারা। বরকত পরিবার সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করে জানায়, ঢাকা-জয়দেবপুর সড়ক সংলগ্ন গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের নলজানী এলাকায় সরকারের বরাদ্ধকৃত জমিতে শহীদ আবুল বরকতের মা হাসিনা বানুর কবর রয়েছে। হাসিনা বানুর মৃত্যুর পর প্রতিবছর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে ২১ ফেব্রুয়ারি ভোর রাত থেকেই শহীদ মাতার কবরে ফুল দিতে ও জিয়ারত করতে এবং শ্রদ্ধা জানাতে বিভিন্ন এলাকা হতে স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রী, শিশু ও নারী পুরষসহ অসংখ্য মানুষ এসে ভীড় জমায়। স্থানটি সড়কের পাশে হওয়ায় নানা দূর্ঘটনার আশংকা করছেন এলাকাবাসি। অথচ আগত এসব মানুষের নিরাপত্তা দিতে গত কয়েক বছর আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েনের আবেদন জানিয়েও কোন সাড়া পাওয়া যায়নি। বরকত পরিবার দিবসটি উপলক্ষে আগতদের নিরাপত্তার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি কামনা করেছেন।
শহীদ বরকতের ভাতিজা আলাউদ্দিন বরকত বলেন, শহীদের ভাতার টাকাটাই মুখ্য নয়। এখন ভাষা শহীদদের পরিপূর্ণ স্বীকৃতি ও মর্যাদা দরকার। তার চাচা বরকতসহ অন্য ভাষা শহীদদের স্বাধীনতা পদকসহ রাষ্ট্রীয় অন্যান্য পদক বা স্বীকৃতি দেয়ার আহ্বান জানান তিনি। পাঁচ থেকে ছয় বছর আগে দেশের বিভিন্ন সিটি করর্পোরেশনে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও সড়কের নামকরণ ভাষা শহীদদের নামে করার অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দেয়া হয়। কিন্তু তাতে তেমন কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।