দৈনিকবার্তা-ফেনী, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬: ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় ভাষা সৈনিক ড. গাজীউল হক একজন সাহসী সৈনিক হিসেবে আবির্ভূত হন। তাঁর নেতৃত্বেই ভাষা আন্দোলনে জীবন বাজি রেখে ছাত্রজনতা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের পাশবর্তী পুকুর পাড়ে তিনিসহ ১১জন ছাত্রনেতা ২০ ফেব্র“য়ারি গভীর রাতে বৈঠক বসে পরদিন একুশের প্রথম প্রহরে ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার কৌশল নির্ধারণ করেন। ওই কৌশল অনুযায়ী ২১ ফেব্র“য়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় আহুত ছাত্র-জনতার সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন ভাষা সৈনিক গাজীউল হক। সেই ২১ ফেব্র“য়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে বিশ্বসভায় স্বীকৃত ও পালিত হচ্ছে।কিন্তু ভাষা সৈনিক গাজীউল হক তাঁর নিজ জেলায় আজো উপেক্ষিত রয়েছেন। প্রয়োজনীয় উদ্যোগের অভাবে তাঁর এই বীরত্ব গাঁথা জানে না নতুন প্রজন্মে অনেকেই। তাঁর পৈতৃক বাড়িটি জীর্ণদশা, নেই কোন স্মৃতিচিহ্ন এবং বাড়ির সামনের রাস্তাটিও চলাচলের অনুপযোগী। সরকার যায় সরকার আসে কিন্তু ভাষা সৈনিক গাজীউল হকের স্মৃতি রক্ষায় কোন সরকারই এগিয়ে আসেননি।
ভাষা সৈনিক গাজীউল হক ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া উপজেলার রাধানগর ইউনিয়নের নিশ্চিন্তা গ্রামের প্রখ্যাত মাওলানা বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা মরহুম মৌলভী ছেরাজুল হক চিশতি (রহঃ), দাদা মৌলভী আবদুল বারী চিশতি (রহঃ)। বাড়ির সামনে অবস্থিত নিশ্চিন্তা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গাজীউল হকের প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি। বাড়ির সামনের পুকুর ও স্কুল মাঠে কেটেছে তাঁর দুরন্ত শৈশব ও কৈশোর। তিনি ছাগলনাইয়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে ৭ম শ্রেনি পর্যন্ত পড়ালেখা করেন। ১৯৪১ সালে ছাগলনাইয়া স্কুল থেকে মুলত গাজীউল হকের রাজনৈতিক জীবনের সূত্রপাত হয়। পরে ১৯৪২ সালে তাঁর পরিবারের সাথে তিনি বগুড়ায় চলে যান।
‘আমাদের গাজীউল হক’ বইটিতে তাঁর একটি উদ্বৃতিতে তিনি বলেছেন ‘এই বাড়িই আমার জন্মস্থান, এই বাড়িরই কোন জায়গায় আমার নাড়ি পোঁতা আছে।’ ‘আজ অনেক দিন পর পুকুরে গোসল করলাম আমার কাছে মনে হল আমি যেন জমজম কুপে গোসল করলাম’ এবং তিনি আরো বলেন- ‘হে আলো-বাতাস, মাটি তোমার কাছে আমি ঋণী’।
ভাষা সংগ্রামী গাজীউল হকের চাচাতো ভাই আবুল হাছনাত মোঃ আবদুল বারী বলেন, গাজীউল হকের স্বপ্ন ছিল তাঁর গ্রামের বাড়ির সামনে নারীদের শিক্ষা বিস্তারের জন্য একটি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় স্থাপন করা। তাঁর জীবদ্দশায় এ স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়নি। কিন্তু সরকারি উদ্যোগে যদি ভাষা সংগ্রামী গাজীউল হকের নামে একটি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় স্থাপন করা হয় তাহলে ভাষা সৈনিকের স্বপ্ন বাস্তবায়নের পাশাপাশি নারী শিক্ষা এগিয়ে যাবে এবং এলাকাবাসীও উপকৃত হবে।
তিনি ভাষা সৈনিক গাজীউল হকের নামে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সড়ক ও স্থাপনার নামকরণ, ছাগলনাইয়া উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনকে ভাষা সৈনিক গাজীউল হকের নামে নামকরণ, তাঁর গ্রামের বাড়িতে স্মৃতি জাদুঘর, গ্রন্থাগার এবং নিশ্চিন্তা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে ভাষা সৈনিক গাজীউল হকের স্মৃতি রক্ষার্থে শহীদ মিনার ও ম্যুরাল স্থাপনের দাবি জানান।এছাড়াও এলাকাবাসী ভাষা সৈনিক গাজীউল হকের নামে ছাগলনাইয়া বাজারের জিরোপয়েন্ট থেকে কালভার্টের দক্ষিণ পাশে পানুয়াঘাট হয়ে রেজুমিয়া পর্যন্ত সড়কটি নামকরণের দাবি তুলেন।এ প্রসঙ্গে ফেনী-১ আসনের সংসদ সদস্য শিরীন আখতার এমপি বলেন, ভাষা সৈনিক গাজীউল হকের নামে ইতোমধ্যে একটি রাস্তার নামকরণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য, ১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্র“য়ারি ঢাকার আরমানিটোলা মাঠে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গাজীউল হককে ভাষা সৈনিক খেতাবে ভূষিত করেন। গাজীউল হকের ‘ভুলব না ভুলব না ভুলব না এই একুশে ফেব্র“য়ারি ভুলব না’ গানটি গেয়ে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত প্রভাতফেরি করা হতো। তিনি রাষ্ট্রভাষা পদক ও সম্মাননা স্মারক, শেরেবাংলা জাতীয় পুরস্কারসহ একাধিক পদক ও পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যও ছিলেন তিনি। এছাড়া গাজীউল হক প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ (পিআইবি) এর চেয়ারম্যান ছিলেন। ২০০৯ সালের ১৭ জুন তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।