ড.কামাল

দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৬: সংবিধান প্রণেতাদের অন্যতম ও গণফোরাম সভাপতি ড.কামাল বলেছেন, আজ সংবিধানের অবস্থা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।দেশের সর্বোচ্চ বিচার বিভাগীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিচারক নিয়ো দেয়া হচ্ছে দলীয়করণের মাধ্যমে। বাংলাদেশে কোনো দিন রাজতন্ত্র কায়েম হতে পারে না। এ দেশের সংবিধানের জন্য অনেক মূল্য দিতে হয়েছে।

শনিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) আয়োজিত বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও কার্যাকারিতা নিশ্চিতের লক্ষ্যে করণীয় শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে তিনি এ কথা বলেন। গোলটেবিল বৈঠকে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও সুজনের নির্বাহী সদস্য ড. শাহদীন মালিক।ড.কামাল বলেন, কোনো রাজনৈতিক দল নির্বাচনে তিনশ আসন পেলেও অযোগ্য কোনো লোককে বিচার বিভাগে নিয়োগ দিতে পারে না। একটি দেশের বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করতে না পারলে সে দেশের সাধারন মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায় না।তিনি এও বলেন, বিচার বিভাগে নিয়োগের ক্ষেত্রে কখনও দলীয়করণ হতে পারে না। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) আয়োজিত বৈঠকে ড. কামাল বলেন, নির্বাচন কমিশন হলো অ্যাম্পায়ার, তারা যদি নিরপেক্ষ না থাকে তাহলে বিচার বিভাগ স্বাধীন থাকবে কীভাবে।

বিচারকদের নৈতিকতা, সত্যবাদিতা ও ন্যায়বোধ না থাকলে যত আইনই থাকুক না কেন তাতে কোনো কাজ হবে না,বলেন এই প্রবীণ আইনজীবী।বিচরকরা কোন যোগ্যতায় নিয়োগ হলো- তা জনগণের জানার অধিকার আছে বলে মন্তব্য করে ড. কামাল বলেন, আমরা সেই যোগ্যতা দেখতে চাই। যোগ্য লোক নিজের দলের হলেও আপত্তি নেই, তবে অযোগ্য লোক কীভাবে নিয়োগ পায়- এটা জানার অধিকার জনগণের আছে। সংবিধান জনগণকে সে অধিকার দিয়েছে।বিচার বিভাগের বর্তমান অবস্থার সমালোচনা করে ড. কামাল বলেন, বিচার বিভাগ একটি স্তম্ভ, এই স্তম্ভকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হলে স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা থাকে না।বিচারপতিদের চায়ের আমন্ত্রণ পরিহার করার আহ্বান জানিয়ে বিচারপতি আব্দুল মতিন বলেছেন, আর চা’র দাওয়াত না, আর ডিনার পার্টি না। বিচারপতিরা যদি চায়ের দাওয়াতে যান তাহলে স্বাধীনতা পুরো কাটেল (বাতিল) হয়ে যায়, স্বাধীনতা থাকে না।

সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, নির্বাচন কমিশন, আদালত-বিচার বিভাগ অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। বিচার বিভাগ সম্পর্কে জনগণের মাঝে নেতিবাচক হতাশা আছে। প্রধান বিচারপতি নিয়ে বিতর্কের কোনো কারণ নেই বলেও মন্তব্য করেন তিনি। সাধারণ মানুষকে বিচার বঞ্চিত করার অধিকার আছে কিনা- এতে বোঝা যায় আমরা গণতান্ত্রিক দেশে আছি কিনা? আমাদের বলা হয় স্বৈরতান্ত্রিক প্রোডাক্ট।তিনি বলেন, যে সংগঠনগুলো নাগরিকের নিরাপত্তা দেবে, আজ তারাই জনগণকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারছে। এর প্রোটেস্ট করার দায়িত্ব বিচার বিভাগের। তা না হলে গণতন্ত্র হুমকির মধ্যে আছে এবং পড়বে।

সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন’র নির্বাহী সদস্য ও স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, তৃণমূল পর্যায়ে বিচার মানা হয় না, বিচারহীনতা, বিচার বঞ্চনা, আইনের শাসন পাওয়ার অধিকার পদে পদে লঙ্ঘিত হচ্ছে।তিনি বলেন, কিছু লোক বিচার করার জন্য বসেই আছেন, ইউনিয়ন পরিষদে যান, দেখবেন গ্রাম্য আদালতের প্রধান ইউপি চেয়ারম্যান। দলীয় লোক হয়ে কীভাবে নিরপেক্ষ বিচার করবেন- প্রশ্ন রেখে তোফায়েল আহমেদ এই কোর্টের থাকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। থানাতেও রাতের বেলা একজন উপপরিদর্শকের নেতৃত্বে আদালত বসছে, সেখানে ঘুষের ছড়াছড়ি। যে কারণে এখন আর জমি সংক্রান্ত মামলা কোর্টে না গিয়ে থানায় চলে যায়।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, আমরা আদালতের সমালোচনা করলে আদালত অবমাননা হয়ে যায়, কিন্তু সরকারের সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী একবার আদালতের আদেশ অমান্য করলেন, এবং বললেন আমি আমার কাজ করবো, দেখি আদালত কী করতে পারে। তারপরও তার প্রতি আদালত অবমাননা হলো না! আমরা গঠনমূলক সমালোচনা করলেই অবমাননা হয়ে যায়, তাহলে কী আমরা কথা বলবো না?ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা বলেন, এখন কোর্ট দুই ভাগে বিভক্ত। একটি আওয়ামী লীগ, আরেকটি বিএনপি। যদি আইনমন্ত্রী, এমপি বা বিচারপতির সন্তান হওয়া যায়, তাহলে তাদের কাছে ক্লায়েন্টরা যায়। তাহলে আমরা কীভাবে প্র্যাকটিস করবো? আইন ও বিচার বিভাগের জন্য সরকারের উন্নয়ন বাজেটে কম বরাদ্দ থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সুপ্রিমকোর্টের বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক। তিনি বলেছেন, আইন ও বিচারের উন্নয়নের চেয়ে দেশে মৎস্য ও পশুর উন্নয়নের জন্য প্রায় আড়াই গুণ বেশি খরচ হচ্ছে। দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য জাতীয় বাজেটে আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।

তিনি বলেন, গত অর্থবছরে উন্নয়ন বাজেটে আইন বিচার মন্ত্রণালয়েল বরাদ্দ ছিল ৩২৯ কোটি টাকা। আপরদিকে মৎস্য ও পশু মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন বাজেটে বরাদ্দ ছিল ৭৯৭ কোটি টাকা। অর্থ্যৎ আইন ও বিচারের উন্নয়নের চেয়ে দেশে মাৎস ও পশুর উন্নয়নের জন্য প্রায় আড়াই গুণ বেশি খরচ হচ্ছে।রাজধানীর মগবাজার-মালিবাগ ফ্লাইওভারের কিছু বাড়তি কাজ করার জন্য অতিরিক্ত ৪৩০ কোটি টাকার বর্ধিত ব্যয় অনুমোদিত হয়েছে। অর্থ্যাৎ এক কিলোমিটার বর্ধিত ফ্লাইওভারের খরচ সারা বছরের আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়ের সব উন্নয়ন কাজের বরাদ্দের চেয়ে ঢের বেশি- যোগ করেন তিনি।

এই সংবিধান বিশেষজ্ঞ বলেন, বড়দাগে আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ হয়ে থাকে মোট বাজেটের ০.৩-০.৪ শতাংশ। অপরদিকে তুলনামূলকভাবে মৱস্য ও পশু মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ ০.৫-০.৬ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ ১ হাজার ৪৬ কোটি টাকা। অপরদিকে তুলনামূলকভাবে মৎস্য ও পশু মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ ১ হাজার ৪৬৯ কোটি। অর্থাৎ মাছ ও পশু খাতের বাজেট বিচারক, কোর্ট-কর্মচারী ও আইনজীবীদের চেয়ে প্রায় দেড়গুণ বেশি।তিনি দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য জাতীয় বাজেটে আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ বাড়ানোর আহ্বান জানান।শাহদীন মালিক বলেন, বর্তমান বাস্তবতা হচ্ছে নির্বাচন কমিশন তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনে ব্যর্থ। দুদক সরকারি দলের দুর্নীতি দেখতে পায়না। সংসদ আছে তবে তার কার্যকর পদক্ষেপ নেই। আর আইনের শাসন না থাকলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা জনগণের কল্যাণ আনতে পারে না। আয়োজক সংগঠনের সভাপতি হাফিজ উদ্দীন আহমেদের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারের সঞ্চালনায় গোলটেবিল বৈঠকে আরো বক্তব্য রাখেন, সুপ্রিমকোর্টের সাবেক বিচারপতি আবদুল মতিন, সাবেক মন্ত্রী পরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার, বিশিষ্ট কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।