দৈনিকবার্তা-গৌরনদী (বরিশাল), ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৬: বরিশালের উজিরপুর উপজেলার সাতলা ইউনিয়নের আলামদী গ্রামের বেশ কিছু কৃষক পরিবার ও সংখ্যালঘু হিন্দু পরিবার ওই এলাকার চিহ্নিত ভুমিদস্যু ও সাবেক ইউপি সদস্য, সন্ত্রাসের গড ফাদার মোতালেব বিশ্বাসের সন্ত্রাসের কাছে জিম্মি হয়ে আছে। হত্যার হুমকী, মারধর ও নির্যাতনের মুখে তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা অচল হয়ে আছে। থানা পুলিশের কাছে অভিযোগ করেও কোন সুবিচার পাচ্ছেন না ভূক্ত ভোগীরা।
এক সময় নদী ও বিল থেকে মাছ ধরে বাজারে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহকারী আব্দুল মোতালেব বিশ্বাস, যার ঠিকমত তিনবেলা খাবার জুটত না, প্রতারনা, জোর জবরদস্তি ও জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে সে এখন অগাধ টাকা পয়সা ও ভূ সম্পত্তির মালিক। তার প্রতারনার হাত থেকে রেহাই পায়নি অন্ধ ভিকারীও। তার হাতে অত্যাচার, নির্যাতন, প্রতারনা ও হয়রানীর শিকার হয়ে সর্বস্ব হারিয়ে পথে বসতে চলেছে এলাকার অনেকগুলো পরিবার। স্থানীয় থানা পুলিশের দ্বারস্ত হলেও ভুক্তভোগীরা কোন ঘটনারই প্রতিকার পান না। জোর জবরদস্তি প্রতারনা ও জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে অর্জিত অবৈধ টাকার জোরে তিনি ম্যানেজ করে ফেলেন থানা পুলিশকে বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর।
বুধবার দুপুরে সরেজমিন ওই গ্রাম ঘুরে প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগীদের দেয়া বর্ননা থেকে জানাগেছে, ওই এলাকার মৃত মোহাম্মদ আলী বিশ্বাসের ছেলে আব্দুল মোতালেব বিশ্বাস, এক সময় দিনের তিনবেলা যার ঠিকমত খাবার জুটত না, এলাকাবাসীর দয়া ও উৎসাহে এরশাদের শাসন আমলে সে স্থানীয় সাতলা ইউপির সদস্য পদে নির্বাচনে অংশ নেয়। এলাকাবাসী তখন তার অসহায় অবস্থার কথা বিবেচনা করে দয়া দেখিয়ে তাকে ভোট দিয়ে ইউপি সদস্য পদে নির্বাচিত করেন। নির্বাচিত হওয়ার পরই পরই পাল্টে যায় তার আচার আচরন। গ্রামের কতিপয় সন্ত্রাসী ও টাউটদের সাথে নিয়ে তিনি গড়ে তোলেন নিজস্ব বাহিনী। এদেরকে সাথে নিয়ে তিনি প্রতারনা, জোর জবরদস্তি ও জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে কেড়ে নেন সহজ-সরল নিরিহ কৃষক পরিবার ও নিরিহ সংখ্যালঘু হিন্দু পরিবারের সহায় সম্পত্তি। এলাকার অসহায়দের সম্পদ দখলকারী হিসেবে চিহ্নিত ওই ভূমিদস্যু মোতালেব বিশ্বাস ইউপি সদস্য পদে বহাল থাকাকালে ত্রানের টিন দেয়ার কথা বলে ওই এলাকার অন্ধ ভিখারী তৈয়ব হাওলাদারকে উজিরপুর উপজেলা সদরে নিয়ে প্রতারনার মাধ্যমে একটি দলিলে টিপসই করিয়ে তার পৌনে ১০ শতাংশ জমি ছাপ কবলা দলিল করে নেয়।
অন্ধ ভিখারী তৈয়ব হাওলাদার এ প্রতিনিধিকে জানান, শিশু কাল থেকে তিনি অন্যের বাড়িতে থেকে মানুষের বাড়ি বাড়ি ভিক্ষাবৃত্তি করে খেয়ে বড় হয়েছেন। তার পিতার রেখে যাওয়া পৌনে ১০ শতাংশ জমি যে আছে এ খবর তিনি জানতেন না। সম্প্রতি জমিজমা নিয়ে প্রতিবেশী নুর মোহাম্মদ হাওলাদারদের সাথে মোতালেব বিশ্বাসের বিরোধ বাধলে নুর মোহাম্মদ হাওলাদারদের লোকজন সাবরেজিষ্ট্রি অফিসে তাদের জমির দলিল তল্লাশী দেয়। এ সময় ত্রানের টিন দেয়ার নামে তার সাথে প্রতারনা করে নেয়া জমির দলিলটি বেড়িয়ে আসে। এর পরই তিনি জানতে পারেন যে, পৈত্রিক সুত্রে পাওয়া তার একখন্ড জমি ছিল। সে জমিটিও প্রতারনা করে কেড়ে নেয়া হয়েছে। পরে ওই জমি ফেরত পাওয়ার জন্য তিনি আদালতে মামলা করেন। ওই মামলা বর্তমানে চরমান আছে। অন্ধ ভিখারী তৈয়ব হাওলাদার বলেন, প্রতারনা করে আমার জমি কেড়ে নেয়া ভূমিদস্যু মোতালেব বিশ্বাসের আমি বিচার চাই। আমি এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চাই।
আলামদী গ্রামের অপর ভূক্তভোগী নুর মোহাম্মদ হাওলাদার, মোঃ দেলোয়ার হাওলাদার জানান, তাদের পিতা মৃত জেন্নাত আলী হাওলাদার তার জীবদ্দশায় ১৯৫৭ সালে স্থানীয় রাজেন্দ্র নাথ সমাদ্দার, সুনিতী বালা সমাদ্দার গংদের কাছ থেকে সাড়ে ৩৯ শতক জমি ক্রয় করেন। ওই জমির অপর ক্রেতা ছুরাত আলী হাওলাদার ও সুন্দর আলী হাওলাদারের কাছ থেকে ১৯৬৫ সালে তিনি আরও সাড়ে ১৯ শতক জমি কিনে মোট ৫৮ শতক জমির মালিক হন। সেখান থেকে গত ১৯৮৭ সালে তিনি মোতালেব বিশ্বাসের কাছে সাড়ে ১৯ শতক জমি বিক্রি করেন। সেই থেকে মোতালেব বিশ্বাস ওই সাড়ে ১৯ শতক জমি ভোগ দখল করে আসছিলেন। সম্প্রতি জালিয়াতির মাধ্যমে ওই ৫৮ শতক জমির ভূয়া ওয়ারিশ তৈরী করে তার কাছ থেকে একটি ছাপ কবলা দলিল নিয়ে মোতালেব বিশ্বাস আমাদের বাকী ৩৯ শতক জমিসহ পুরো ৫৮শতক জমি জোর পুর্বক দখল করে নিয়েছে। আমরা এর প্রতিকার চাইতে থানা পুলিশের দ্বারস্ত হয়েছিলাম। ভূমি দস্যু মোতালেব বিশ্বাস থানা পুলিশকে ম্যানেজ করে ফেলায় পুলিশ আমাদের সহয়তা করেনি।
মোঃ সরোয়ার হাওলাদার জানান, আমাদের জমির জবরদখল নিতে ভুমিদস্যু মোতালেব বিশ্বাস পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া থেকে আমাদের গ্রামে ডিপ টিউবওয়েল বসাতে আসা শ্রমিক আব্দুল খালেককে ম্যানেজ করে তাকে আতœগোপনে পাঠিয়ে তার স্ত্রী মরিয়ম বেগমকে বাদি করে আমাদের ৮ জনের নামে অপহরন ও গুমের মামলা করায়। যার ১নং সাক্ষী হয় মোতালেব বিশ্বাস। পরে আতœগোপনে থাকা খালেক পুলিশের হাতে আটক হলে ওই মামলা থেকে আমরা অব্যাহতি পাই। একই গ্রামের সেলিম বিশ্বাস অভিযোগ করেন, সন্ত্রাসের গড ফাদার মোতালেব বিশ্বাস তার সন্ত্রাসী বাহিনীর সহয়তায় গত বৈশাখ মাসে আমার বাড়িঘরে হামলা চালিয়ে ঘর জরজা ভাংচুর ও লুটপাট করে। এ সময় আমার স্ত্রী জায়েদা বেগম, মেয়ে হালিমা, লিজা, ফারজানাকে মারধর করে আহত করে আমার ১৮ শতক জমির ইরি ধান জোর পুর্বক কেটে নিয়ে যায়। এ ঘটনায় আমি উজিরপুর থানায় মামলা করেছি। পুলিশ মোতালেব বিশ্বাসের দ্বারা ম্যানেজ হয়ে এজাহার দায়েরের ৬ মাস পর আমার এজাহারের ধারা পরিবর্তন করে হালকা ধারা বসিয়ে মামলার চার্জশীট দিয়েছে। এ ছাড়া আমার প্রতিবেশী মোতালেব সরদারের স্ত্রী ভানু বিবিকে ম্যানেজ করে তার ঘর আগুন দিয়ে পুড়ে তাকে বাদী করে আমাকে ও ফরিদ মোল্লাকেসহ এলাকার ১০ জনের নামে মিথ্যা মামলা দেয়।
ভূক্তভোগী জলিল বিশ্বাস বলেন, আমাদেরকে ঘায়েল করতে মোতালেব বিশ্বাস আমাদের প্রতিবেশী মৃত মোজাফফর আলী বিশ্বাসের ছেলে টিপু বিশ্বাসকে বাদি বানিয়ে আমাকে ও কাঞ্চন মোল্লাকেসহ এলাকার ৮ জনকে আসামী করে একটি মিথ্যা চাঁদাবাজীর মামলা দেয়। ওই মামলায় মোতালেব বিশ্বাসের ভাই মান্নান বিশ্বাস ও জাকির বিশ্বাসকে স্বাক্ষী করা হয়। মোতালেব বিশ্বাস তার ভাই মান্নান বিশ্বাস ও জাকির বিশ্বাস আমাকে ও সেলিম বিশ্বাসসহ এলাকার অনেকের নামে একাধিক মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানী করছে। প্রতিপক্ষকে জব্দ করতে মোতালেব বিশ্বাসের জুড়ি মেলা ভার। নিজের স্বার্থে তিনি পারেন না এমন কোন অপকর্ম নেই। তিনি খুলনার কুখ্যাত খুনী এরশাদ শিকদারের মত ভয়ংকর। ভুক্তভোগীরা সকলে একযোগে বলেন, এই ভয়ংকর লোকটি গত বছর পবিত্র হজ করে এসেছে। তাতেও তার মনোভাবের কোন পরিবর্তন হয়নি। সে একের পর এক মিথ্যা মামলা দেয়ার পাশাপিিশ হামলা, মারধর, লুটপাট, নির্যাতন চালিয়ে ও হয়রানী করে এলাকার লোকজনকে অতিষ্ট করে তুলেছে। তার বাহিনীর হত্যার হুমকী, তাদের হাতে মারধর ও নির্যাতনের শিকার হওয়ার ভয়ে নুর মোহাম্মদ হাওলাদার, মোঃ দেলোয়ার হাওলাদার, সরোয়ার হাওলাদারদের পরিবারের সদস্যদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা অচল হয়ে আছে। হত্যার হুমকীর মুখে তারা কেউ একা চলাফেরা করছেন না। অন্যের সাহায্য নিয়ে তাদের বাজার ঘাটে বের হতে হয়। ভুক্তভোগীরা এই ভয়ংকর লোকটির কু কর্মের হাত থেকে মুক্তি চান। এ ব্যাপারে তারা প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছেন।
পুলিশের বিরুদ্ধে আনা ভূক্তভোগীদের অভিযোগকে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন দাবি করে উজিরপুর থানার ওসি মোঃ নুরুল ইসলাম (পিপিএম) জানান তারা যেটা বলেছে ও রকম কোন বাহিনী মোতালেবের নেই। মোতালেব বিশ্বাসের সাথে অভিযোগকারীদের জমিজমা নিয়ে বিরোধ রয়েছে। ইতোপুর্বেও আমরা অভিযোগ পেয়ে ব্যাবস্থা নিয়েছি। পুনরায় অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যাবস্থা নেয়া হবে।