1453828945_p-11

দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ২৯ জানুয়ারি ২০১৬: বছর ঘুরে আবারো দরজায় কড়া নাড়ছে অমর একুশে গ্রন্থ মেলা ২০১৬। আর মাত্র চারদিন পরেই বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বসবে মাসব্যাপী বই উৎসব। ভাষার মাস ফেব্র“ুয়ারি জুড়ে অনুষ্ঠিতব্য প্রাণের বই মেলা বাস্তবায়ন করতে কর্তৃপক্ষের নানা উদ্যোগের পাশাপাশি নির্ধারিত জায়গায় চলছে স্টল নির্মাণ ও সাজসজ্জার কাজ। দড়জায় কড়া নাড়ছে অমর একুশে গ্রন্থ মেলা । তাই রাজধানীর বাংলা বাজারে ছাপাখানায় দম ফেলার ফুসরত নেই কমীদের। একই সাথে চলছে বই বাধাই ও পৃষ্ঠাসজ্জার কাজও ।

রাজনৈতিক অস্থিরতা সহ নানা কারণে গত তিন বছর ধরে বইয়ের বাজারে বিরাজ করছে মন্দাভাব। তাই এবার লোকসান পোষানের আশা প্রকাশকদের। যদিও কাগজের আমদানি শুল্ক বাড়ায় বইয়ের বাড়তি দাম গুনথে হচ্ছে ক্রেতাদের। বাংলা বাজারকে বলা হহয় দেশের প্রকাশশনা প্রতিষ্ঠানের আতুড়ঘর ।বছর জুড়েই নানা বইয়ের প্রকাশনায় ব্যস্ত থাকেন এখানকার মানুষ।তবে এবার বইমেলা ঘিরে এই ব্যবস্থা বাড়ে বহুগুন। প্রায় সবগুলো প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানই মেলা উপলক্ষে প্রকাশ করা হয় নতুন নতুন বই। প্র“ফ রিডিং , পৃষ্ঠাসজ্জা,মলাট তৈরি, বইছাপানো সবই হয় বাংলা বাজারে । তাই এখন দম ফেলারর ফুসরত নেই সংশ্লিষ্টদের।বিএনপি জোটের টানা অবরোধ ব্লগার হত্যাসহ নানা ঘটনায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ে গেলা বচরের বইমেলায় ।

বিশ্বের দীর্ঘ সময়ব্যাপী এ মেলার কর্তৃপক্ষ ২৬ জানুয়ারির মধ্যে স্টল নির্মাণ সমাপ্ত করার নির্দেশ দিলেও বরাদ্দে বিলম্ব ও মিস্ত্রি সংকটসহ কয়েকটি কারণে শুক্রবার জানুয়ারির ২৯ তম দিনেও মেলায় ঢুকতেই কানে আসে হাতুড়ি- পেরেকের ঠুসঠাস শব্দ। সবাই চাইছে কর্তৃপক্ষের আল্টিমেটাম ফেল করলেও যাতে দু’-এক দিনের মধ্যেই স্টল নির্মাণ ও সাজসজ্জার কাজ শেষ করতে। কেউ রং করছেন। কেউ সাইনবোর্ড ঝোলাচ্ছেন। নিরাপত্তার জন্য তৈরি হচ্ছে ওয়াচ টাওয়ার। আলোর ব্যবস্থা করতে বসানো হচ্ছে ল্যাম্পপোস্ট। চলছে চলাচলের পথে ইট বসানোসহ নানা কর্মকাণ্ড। শেষ হয়েছে চারপাশে টিনের বেড়া দেয়ার কাজ। গভীর রাত পর্যন্ত কাজ চলছে। রংমিস্ত্রি হেদায়েত মোল্লা জানালেন, গত দু’দিন ধরে বার্নিশের কাজ করছেন। তিনটি স্টলে এবার রংয়ের কাজ করছেন তিনি। সব কাজ শেষ করতে তার আরো তিন-চার দিন লাগবে। ২৬ জানুয়ারি কাজ শেষ করার সময় বেঁধে দিয়েছিল বাংলা একাডেমি। হেদায়েত মোল্লা বলেন, প্রতিবারই এরকম টাইম দেয়া থাকে। এরকম টাইম দেয়ার দরকার তাই দেয়। সবাই যে যার মতোই কাজ করে।

এ বিষয়ে গ্রন্থমেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব ড. জালাল আহমেদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, এখনো কাজ শেষ হয়নি। আমরা হাতে কয়েকদিন সময় রেখেই তাদের সময় বেঁধে দিয়েছিলাম। সবকিছু তো আর সময় নির্ধারণ করে শেষ করা যায় না। আশা করি দ্রুতই সব কাজ শেষ হয়ে যাবে।পাতাবাহার প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী মুস্তফা পান্নাকে তার স্টলের কাজ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, রং করা হচ্ছে। আজরাতেই কাজ শেষ হয়ে যাবে। সাইনবোর্ড এনে রেখিছি। রং করা শেষ হলে টাঙিয়ে দেব। পহেলা ফেব্র“য়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অমর একুশে গ্রন্থমেলা উদ্বোধন করবেন। সে অনুযায়ী নিরাপত্তায় ৩০ জানুয়ারির পর থেকে মেলা উদ্বোধন পর্যন্ত পুরো এলাকা থাকবে আইনশৃংখলা বাহিনীর কঠোর নজরদারিতে। সে কারণে এ দিনের পর মেলায় কোনো রকম কাজ করা যাবে না বলে জানালেন মুস্তফা পান্না।এখনো মেলা প্রাঙ্গণে নতুন নতুন স্টলের জন্য খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। মাটি খুঁড়ছিলেন আলী মিয়া। তিনি জানালেন, মঙ্গলবারই কাজ শুরু করেছেন তিনি। উদ্বোধনের আগে যতটুকু শেষ করা যায় করবেন, বাকিটা উদ্বোধনের পরও করা যাবে।

বাংলা একাডেমি সূত্র জানায়, প্রায় পাঁচ লাখ বর্গফুট এলাকা নিয়ে বিশাল পরিসরে এবারে অনুষ্ঠিত হবে বইমেলা। সেই সঙ্গে এবারের মেলা হবে অনেক বেশি খোলামেলা পরিবেশে। ইতোমধ্যেই মেলায় অংশ নেয়া প্রকাশনা সংস্থা, সরকারি- বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যম সংস্থাকে স্টল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। মেলার মূল আকর্ষণ, সৃজনশীল প্রকাশনা সংস্থাগুলো থাকছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। সরকারি- বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনগুলোর স্টল থাকবে একাডেমি প্রাঙ্গণে। মেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব ড. জালাল আহমেদ বলেন, অন্য সময়ের তুলনায় এবারের বইমেলা বড় পরিসরে হচ্ছে। ৬৫০ ইউনিট হবে। ৪০২টি প্রতিষ্ঠানসহ ১৫টি চত্বর ও ১৫টি প্যাভিলিয়ন থাকবে। এবারের মেলায় রিপোর্টারদের (সাংবাদিক) সংগঠন ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) স্টল থাকছে। এবারের বইমেলায় খুদে পাঠকদের জন্য শিশু কর্নারসহ নানা ধরনের নতুন আয়োজন থাকছে।

অমর একুশে গ্রন্থমেলায় শিশুদের জন্য থাকছে বিশেষ আর্কষণ। যেখানে বই দেখা ও কেনার পাশাপাশি মনের আনন্দে খেলতেও পারবে শিশুরা। মেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের অংশে হচ্ছে এই শিশু কর্নার। যার নামকরণ করা হচ্ছে, বরেণ্য শিশু সাহিত্যিক রোকনুজ্জামান খান দাদাভাইয়ের নামে। ইতোমধ্যে শিশু কর্নারের জন্য ৩৯টি শিশু প্রকাশনা সংস্থাকে স্টল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে তিন ইউনিটের স্টল রয়েছে ৩টি, দুই ইউনিটের ১০টি ও এক ইউনিটের ২৬টি স্টল রয়েছে।বিশ্বের বৃহৎ বইমেলা ফ্রাংকফোর্ট বইমেলার আয়োজকদের দুইজন প্রতিনিধি এবারের বইমেলায় উপস্থিত থাকবেন। তারা ফ্রাংকফোর্ট ও একুশে গ্রন্থমেলার অভিজ্ঞতা বিনিময় করবেন। একই সঙ্গে এবারের মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাংলা ভাষায় বক্তব্য রাখবেন যুক্তরাজ্যের জো উইন্টার ও চেক প্রজাতন্ত্রের রিবেক মার্টিন।

এবার বইমেলা নান্দনিক ও রুচিসম্পন্ন করতে প্রস্তুতি নিচ্ছে বাংলা একাডেমিও। এ বিষয়ে জালাল আহমেদ জানান, মেলাকে নান্দনিকভাবে সাজানো হচ্ছে। মেলা প্রাঙ্গণের খোলা জায়গায় ফুলের গাছ দিয়ে সাজানোর পাশাপাশি স্থাপন করা হবে ফোয়ারাও। এবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মুক্ত মঞ্চটি মেলার অংশ হবে। এখানে মাসব্যাপী পথনাটক প্রদর্শিত হবে। আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে একাডেমি প্রাঙ্গণের মেলা মঞ্চে। এছাড়াও মেলা উপলক্ষে মেলা প্রাঙ্গণের রাস্তা নতুনভাবে রাঙানোর কাজ করছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। মেলা প্রাঙ্গণ ও এর আশেপাশের এলাকা ঘিরে তাই তৈরি হচ্ছে কঠোর নিরাপত্তা বলয়। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের স্টলগুলোর চতুর্দিকে টিনের ও বাঁশের দুই স্তরের নিরাপত্তা প্রাচীর তৈরি করা হয়েছে।

অতিরিক্ত সদস্য মোতায়েনের পাশাপাশি মেলায় প্রবেশের মুখে বসানো হবে চেক পোস্ট, দোয়েল চত্বর থেকে চারুকলা পর্যন্ত লাগানো হবে দুই শতাধিক ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা।মেলা এলাকার অভ্যন্তরে বসানো হচ্ছে ওয়াচ টাওয়ার। মাসব্যাপী মেলায় থাকবে স্থায়ী র‌্যাব-পুলিশের একাধিক ক্যাম্প। টিনের ও বাঁশের তৈরি দুই স্তরের নিরাপত্তা প্রাচীরের মাঝের ফাঁকা স্থানে সার্বক্ষণিক অবস্থান করবেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। এ প্রসঙ্গে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (মিডিয়া) মারুফ হোসেন সরদার জানান, মেলার অভ্যন্তরে পুলিশের ওয়াচ টাওয়ার তৈরি করা হচ্ছে। মেলা প্রাঙ্গণে সাদা পোশাকে অধিকসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন থাকবে। পাশাপাশি কোনো লেখক কিংবা প্রকাশক নিরাপত্তাহীনতায় ভুগলে পুলিশ তাদের জন্য বিশেষ নিরাপত্তারও ব্যবস্থা করবে।

মেলার আয়োজক প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান বাসসকে বলেন, অনেক নতুনত্ব থাকছে এবারের অমর একুশে গ্রন্থমেলায়। এবারই প্রথম গুচ্ছাকারে স্টল বিন্যাস করা হয়েছে। অন্যান্য বছরের চেয়ে মেলার পরিসরও বাড়ানো হয়েছে।তিনি বলেন, প্রায় ৫ লাখ বর্গফুট স্থানে ১৫টি গুচ্ছে থাকবে স্টলসজ্জা। প্রতি গুচ্ছে একটি করে প্যাভেলিয়ান থাকবে। এছাড়া ৪ ইউনিট, ৩ ইউনিট, ২ ইউনিট ও ১ ইউনিটের স্টলও থাকবে সব গুচ্ছে। শিশু কর্ণারটি সাজানো হচ্ছে নবরূপে। শিশুদের জন্য থাকবে খেলার জায়গাও। আর নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে নিñিদ্র করতে পর্যাপ্ত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যর পাশাপাশি দোয়েল চত্বর থেকে চারুকলা পর্যন্ত থাকবে সিসি ক্যামেরা।

এবারের মেলায় শুধু সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ৩১৪টি প্রকাশনা সংস্থাকে স্টল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে উল্লেখ করে শামসুজ্জামান খান বলেন, এরমধ্যে ১৩টি প্যাভিলিয়ন, ১৮টি চার ইউনিট, ৩৩টি তিন ইউনিট, ১১১টি দুই ইউনিট ও এক ইউনিটের স্টল দেয়া হয়েছে ১৩৯টি। তিনি বলেন, লটারির মাধ্যমে স্টলের স্থান বুঝে পাওয়ায় প্রকাশকরা এখন মহাব্যস্ত স্টল সজ্জার কাজে। একাডেমির সর্বত্র এখন ঠুকঠাক শব্দ, আর রঙের ঘ্রাণ পাওয়া যাচ্ছে।তিনি আরও জানান, মেলার পরিসর বৃদ্ধি পাওয়ায় মেলাকে নান্দনিকভাবে সাজানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে বাংলা একাডেমি। এবার মেলা প্রাঙ্গণের খোলা জায়গায় অন্যান্যবারের মত ফুলের গাছ দিয়ে সাজানোর পাশাপাশি স্থাপন করা হবে ফোয়ারা।

রাতের বেলায় ওই ফোয়ারা থেকে বের হবে রঙ-বেরঙের পানির ছটা। মেলার ১৫টি গুচ্ছকে ৫ ভাষা শহীদ, ৬ শহীদ বুদ্ধিজীবী ও ৪ শিশু সাহিত্যিকের নামে উৎসর্গ করা হয়েছে উল্লেখ করে মহাপরিচালক বলেন, শিশু সাহিত্যিক রোকনুজ্জামান খান দাদাভাইয়ের নামে শিশু কর্ণারটি উৎসর্গ করা হয়েছে।তিনি বলেন, শিশু কর্ণারে মোট ৩৯টি শিশু প্রকাশনা সংস্থাকে স্টল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। যার মধ্যে তিন ইউনিটের স্টল রয়েছে ৩টি, দুই ইউনিটের ১০টি ও এক ইউনিটের ২৬টি স্টল। তবে শিশু কর্ণারে কোন প্যাভিলিয়ন থাকবে না জানিয়ে তিনি বলেন, প্যাভিলিয়নের জন্য বরাদ্দকৃত জায়গায় শিশুদের জন্য খেলার স্থান করা হয়েছে।