দৈনিকবার্তা-সিলেট, ২১ জানুয়ারি ২০১৬: সিলেটের জনসভায় নৌকার পক্ষে ভোট চাইলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, নৌকায় শান্তি দেবে। নৌকা সমৃদ্ধি দেবে। নৌকা উন্নতি দেবে। নৌকায় এ দেশের মুক্তি এনে দেবে।বৃহস্পতিবার বিকেলে সিলেটের সরকারি আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে জেলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভায় শেখ হাসিনা এসব কথা বলেন। তবে কোন নির্বাচনের জন্য তিনি ভোট চেয়েছেন, তা উল্লেখ করেননি। চলতি বছরের মার্চ মাস থেকে ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। এই নির্বাচন এবারই প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকে হওয়ার কথা।প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর বক্তৃতায় সিলেটে একটি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় করে দেওয়ার ঘোষণা দেন। বক্তৃতায় উপস্থিত জনতাকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে দেশের স্বাধীনতা পেয়েছেন। নৌকা মার্কায় ভোট দিয়েছেন বলেই আজকে দেশের উন্নতি হচ্ছে। আগামী দিনেও নৌকা মার্কাকে কখনো ভুলবেন না। নৌকায় আগামীতে ভোট দেবেন তো। হাত তুলে দেখান। হাত তুলে ওয়াদা করেন। হাত তুলে ওয়াদা করেন যে, নৌকায় ভোট দেবেন। এরপর উপস্থিত জনতা হাত তুলে তাঁকে দেখান।
বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ করে শেখ হাসিনা বলেন, দেশের যখন উন্নতি হয়। মানুষ যখন শান্তি তে থাকে। আমরা দেখি একজনের মনে খুব অশান্তি দেখা দেয়। তিনি আগুন দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মারেন। মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলেন। তাঁদের হাতে কোনো মানুষই নিরাপদ থাকে না। তাঁদের মনে শুধু শান্তি নাই। আর সবাই শান্তিতে বসবাস করছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের মাটিতে কোনো জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদের স্থান হবে না। আপনারা সজাগ থাকবেন। আপনাদের খেয়াল রাখতে হবে যে, কোনো ছেলে-মেয়ে ওই সন্ত্রাসী ও জঙ্গিবাদীদের কাছে যেন যেতে না পারে। তারা শান্তিতে বসবাস করতে পারে, সেই ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ব্যাপারে দেশবাসীকে সজাগ থাকতে হবে। দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করে তিনি বলেন, জাতির পিতা আমাদের স্বাধীনতা দিয়ে গেছেন। এই স্বাধীনতা অর্থবহ করতে চাই।আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেই দেশের উন্নতি হয় মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগ এ দেশের স্বাধীনতা এনেছে। আর উড়ে এসে জুড়ে বসে ক্ষমতায় আসে। তারা আসে লুটপাট করতে, জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদ করতে। তাদের স্থান বাংলার মাটিতে হবে না। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে। উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে তুলব।
জনসভা শুরুর আগে বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে আলিয়া মাদ্রাসা মাঠেই বিভিন্ন প্রকল্পের ফলক উন্মোচনের আনুষ্ঠানিকতা সারেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই অনুষ্ঠানে তিনি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া আইসিটি ভবন, আবুল মাল আবদুল মুহিত ক্রীড়া কমপ্লেক্স, জৈন্তাপুর উপজেলা ফায়ার সার্ভিস স্টেশন, সিলেট এপিবিএনের ব্যারাক ভবন, সিলেট জেলার ওসমানীনগর থানা ভবন, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য নির্মিত হোস্টেল ভবন, ৩০ শয্যাবিশিষ্ট খাদিমপাড়া হাসপাতাল, সিলেট সদর এমসি কলেজের মাঠের সীমানাপ্রাচীর ও গেট, সিলেট শহীদ শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতালটি ১০০ শয্যাবিশিষ্ট শিশু হাসপাতালে রূপান্তর, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি ভবনের ফলক উন্মোচন করেন।
এ ছাড়া সিলেট আউটার স্টেডিয়াম, খসরুপুর বাজার জিসি- পৈলানপুর-বালাগঞ্জ জিসি সড়ক উন্নয়ন, হরিপুর জিসি-গাছবাড়ী জিসি সড়ক উন্নয়ন (কানাইঘাট অংশ), মৈয়াখালী বাজার-আর অ্যান্ড সুইচ (বারোহাল ইউপি অফিস) ভায়া হাটুবিল মাদ্রাসা সড়ক উন্নয়ন, নারী পুলিশ ডরমেটরি ভবনের ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ কাজ, শাহপরান থানা ভবন নির্মাণ, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের বিভাগীয় ও জেলা অফিস নির্মাণ, সিলেট বিভাগীয় ও জেলা এনএসআই কার্যালয় ভবন নির্মাণ, তামাবিল স্থলবন্দর নির্মাণ, হজরত গাজী বোরহান উদ্দিন (র.) মাজার তিনতলা ভিত্তিবিশিষ্ট মসজিদ, মহিলা ইবাদতখানা ও সংযোগ সড়ক নির্মাণকাজ, বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য), সিলেট বিভাগ এবং সিভিল সার্জন, সিলেট কার্যালয় ভবন নির্মাণকাজ এবং বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন সিলেট ইলেকট্রনিক সিটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী।এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হজরত শাহজালাল (র.)-এর মাজার এবং হজরত শাহ পরান (র.)-এর মাজার শরিফ জিয়ারত করেন। ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশ গড়া এবং এদেশের সামগ্রিক উন্নয়নের সঙ্গে আওয়ামী লীগের নাম জড়িত উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আমার কাছে দাবি করা লাগবে না। আমি সারা বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ঘুরেছি। সমস্যা কী আমার জানা। আমি এও জানি কী করে উন্নতি হবে।
তিনি বলেন, এইটুকু ভরসা আমাদের ওপর রাখবেন। নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে দেশের স্বাধীনতা পেয়েছেন, আগামী দিনেও ভুলবেন না আমাদের।নৌকাই শান্তি দেবে, নৌকাই উন্নতি দেবে।বিএনপিকে ইঙ্গিত করে শেখ হাসিনা বলেন, যারা উড়ে এসে জুড়ে ক্ষমতায় বসে তারা জঙ্গিবাদ করে। তাদের সময়ে দেশ এগিয়ে যায় না, কোনো উন্নয়ন হয় না।তিনি বলেন, আমাদের সময় পাঁচ কোটি মানুষ নিম্নবিত্ত থেকে উচ্চবিত্তে উঠে এসেছে। এই জাতি নিম্নবিত্তে থাকতে পারে না। এই দেশ উন্নত হবে, সমৃদ্ধ হবে। আওয়ামী লীগ বাংলার জনগণের সংগঠন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে দেশের উন্নতি হয়ই।প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাঙালি জাতিকে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না। জাতির পিতা এটা আগেই বলে গেছেন। আজকে বাংলাদেশ সারা বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল। যখন ২০০৮ সালে সরকার গঠন করি তখন ছিল বিশ্বমন্দা, তা কাটিয়ে উঠে আমরা দেশ পরিচালনা করি। দেশে ধারাবাহিক উন্নয়ন হয়েছে আমাদের আমলে।কিন্তু বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন দেশে জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদ বিরাজ করেছে। উল্টো আওয়ামী লীগ আমল হচ্ছে, শান্তি-উন্নয়নের। বিএনপির আমলে কোথায় গণ্ডগোল হয়নি? সবখানে তারা সস্ত্রাস সৃষ্টি করেছিল। যা থেকে সিলেটও বাদ যায়নি।
শেখ হাসিনা বলেন, ২০১৪ সালে নির্বাচন বানচালের নাম করে তারা যেভাবে মানুষ হত্যা করেছিল, সেটা পৃথিবীর ইতিহাসে আর আছে কিনা জানি না। তারা মায়ের সামনে মেয়ে, বাবার সামনে ছেলেকে আগুনে পুড়িয়ে মেরেছে। পেট্রোল বোমা দিয়ে মানুষ হত্যা করেছে একের পর এক। তবে মামলা হয়েছে, প্রত্যেক মানুষ হত্যাকারীর বিচার বাংলার মাটিতে হবেই, আমরা বিচার করবো।বিএনপির প্রসঙ্গ টেনে শেখ হাসিনা আরও বলেন, আমরা চাই শান্তি, ওরা চায় অশান্তি। আওয়ামী লীগ চায় ন্যায় প্রতিষ্ঠা হোক, ওরা চায় লুটপাট।প্রধানমন্ত্রী সিলেটে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়ে বলেন, বাংলাদেশে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না। আওয়ামী লীগই মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছে। আমাদের লক্ষ্য সব বিভাগেই মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হবে। দ্রুতই সিলেটে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় করে দেবো।প্রধানমন্ত্রী তার সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড তুলে ধরে বলেন, সিলেটে আজ ২২টি উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছি। আমরা সিলেট বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক করেছি। এর কাজ আমরা শুরু করেছিলাম, কিন্তু বিএনপি এসে সে কাজ বন্ধ করে দেয়।বিমান এখন লন্ডন থেকে সরাসরি সিলেটে আসে। ঢাকা-লন্ডন সরাসরি ফ্লাইট চালু করেছি। বিমানকে উন্নত করেছি। আমাদের লক্ষ্য ছিল, ডিজিটাল বাংলাদেশ করবো, করেছি। থ্রি-জি চালু করেছি, দ্রুতই ফোর-জি চালু করা হবে।
তিনি বলেন, দেশে শিক্ষার সম্প্রসারণ হচ্ছে। বিজ্ঞান ও কম্পিউটার শিক্ষার এর মধ্যে অন্যতম। দেড় কোটি মানুষকে চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছি। লাখো মানুষকে বিদেশে চাকরির ব্যবস্থা করেছি। প্রত্যেকটি ছেলে-মেয়ে আজ এগিয়ে যাচ্ছে, কর্মসংস্থান হয়েছে। কেউ বেকারত্বের অভিশাপ নিয়ে ঘুরে বেড়াবে না। সারা বাংলাদেশে অর্থনৈতিক অঞ্চল করছি, যেন কেউ বসে না থাকে। আমরা বেতন বাড়িয়ে দিয়েছি। কোনো সরকার ১২৩ শতাংশ বেতন বাড়াতে পারেনি, আমরা করেছি।শিক্ষা খাতের উন্নয়নেও প্রধানমন্ত্রী তার সরকারের নানা পদক্ষেপের কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, এক কোটি ২৮ লাখ ছাত্র-ছাত্রীকে বৃত্তি এবং উপবৃত্তি দিয়ে যাচ্ছি। বিনা পয়সায় বই দিচ্ছি। এবারও ঠিক সময়ে শিশুদের হাতে হাতে বই পৌঁছে দিয়েছি।শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, লেখাপড়া শিখতে হবে। মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছি। সে সুযোগ কাজে লাগিয়ে শিক্ষার্থীরা এগিয়ে যাবে।জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে স্বপ্ন দেখেছেন, সে অনুযায়ী স্বাধীনতার সুফল মানুষের দ্বারে দ্বারে পৌঁছে দেওয়াই আওয়ামী লীগের লক্ষ্য বলে জানান প্রধানমন্ত্রী।এর আগে, জনসভা মঞ্চের পাশে সিলেটের ২২টি প্রকল্পের উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী। তারপর দেশ ও জাতির কল্যাণ কামনা করে মোনাজাত করেন তিনি।