দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ২০ জানুয়ারি ২০১৬: দেশের জনগণের প্রত্যাশা পূরণে সব রাজনৈতিক দলকে এক সঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠায় বাঙালি জাতিকে আবার ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বানও জানান তিনি।রাষ্ট্রপতি বলেন, আমি সরকারি দল ও বিরোধী দলসহ সবাইকে জনগণের প্রত্যাশা পূরণের প্রতিষ্ঠান জাতীয় সংসদে যথাযথ ও কার্যকর ভূমিকা পালনের আহ্বান জানাই।বুধবার দশম জাতীয় সংসদের নবম অধিবেশনে রাষ্ট্রপতি তার ভাষণে এ আহ্বান জানান। বিকেল ৪টা ৪৫ মিনিটে রাষ্ট্রপতি তার ভাষণ শুরু করেন। প্রায় ৪০ মিনিট বক্তব্য রাখেন তিনি।ভাষণ শেষে রাষ্ট্রপতি সংসদের অধিবেশন কক্ষ ত্যাগ করেন। এরপর স্পিকার দিনের কার্যসূচি শেষ করেন এবং অধিবেশন আগামী রোববার (২৪ জানুয়ারি) বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত মুলতবি ঘোষণা করেন।রাষ্ট্রপতি বলেন, জাতীয় সংসদ দেশের সব উন্নয়ন কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দু। বর্তমান সরকার রাজনীতি থেকে হিংসা, হানাহানি ও সংঘাতের অবসানের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বাংলাদেশকে একটি উন্নত ও আলোকিত দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, পরমতসহিষ্ণুতা, মানবাধিকার ও আইনের শাসন সুসংহতকরণ এবং জাতির অগ্রযাত্রার স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে সরকারি দলের পাশাপাশি বিরোধী দলকেও গঠনমূলক ভূমিকা পালন করতে হবে।রাষ্ট্রপতি বলেন, নতুন প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ, সুখি, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে আমরা একটি স্বর্ণোজ্জ্বল অধ্যায় অতিক্রম করছি। রূপকল্প-২০২১ এবং দিনবদলের সনদের ভিত্তিতে প্রণীত প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ও ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার আওতায় বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন এবং এ কার্যক্রমে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের ফলে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি সাধিত হয়েছে।গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখা এবং উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জনের চ্যালেঞ্জ নিয়ে প্রতিকূলতার মধ্যে সরকারকে কাজ করতে হচ্ছে বলে জাতীয় সংসদে বছরের প্রথম অধিবেশনে দেওয়া রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের ভাষণে উঠে এসেছে।বুধবার ৩৬ মিনিটের এই ভাষণে যুদ্ধাপরাধের চলমান বিচার এবং শিশু রাজন ও রাকিব হত্যা মামলার দ্রুত বিচার হওয়ার প্রসঙ্গ টেনে রাষ্ট্রপতি আইনের শাসন এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠায় সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার আহ্বান জানান।
আবদুল হামিদ বলেন, বর্তমান সরকার শুরু থেকেই গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখা এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জনের চ্যালেঞ্জ নিয়ে দেশ পরিচালনা করছে।দায়িত্বগ্রহণের পর থেকেই গণতন্ত্রের বিকাশ, আইনের শাসন ও আর্থ সামাজিক সমৃদ্ধিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সুশাসন সুসংহত করার নিরলস প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। আমার বিশ্বাস সকল চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে রাষ্ট্র ও সমাজ জীবনে শান্তি, শৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখবে।শত প্রতিকূলতা, বাধা-বিপত্তি ও বৈরিতার’ মধ্যেও দেশে সুশাসন সুসংহতকরণ এবং গণতন্ত্র চর্চা ও উন্নয়ন কর্মসূচিতে তৃণমূল থেকে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে সরকারের প্রয়াস অব্যাহত রয়েছে বলে মন্তব্য করেন রাষ্ট্রপতি।তিনি বলেন, ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত গৌরবোজ্জ্বল স্বাধীনতা সমুন্নত এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুজ্জ্বল রাখতে, গণতন্ত্র ও আইনের শাসন সুদৃঢ় করতে এবং শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তুলতে, বাঙালি জাতিকে আবারও ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে।
একাত্তরের শহীদদের কাছে আমাদের অপরিশোধ্য ঋণ রয়েছে, আসুন ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে এবং দল-মত-পথের পার্থক্য ভুলে জাতির গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার মাধ্যমে আমরা লাখো শহীদের রক্তের ঋণ পরিশোধ করি।বিকাল সাড়ে ৪টায় স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে অধিবেশন শুরু হয়।সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ অধিবেশনে উপস্থিত ছিলেন।কোনো সংসদের প্রথম এবং নতুন বছরের প্রথম অধিবেশনে রাষ্ট্রপতির ভাষণ দেওয়ার বিধান রয়েছে। পরে পুরো অধিবেশন জুড়ে তার ভাষণের ওপর সংসদ সদস্যরা আলোচনা করে থাকেন। আলোচনা শেষে রাষ্ট্রপতিকে ধন্যবাদ জানিয়ে সংসদে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়।বুধবার অধিবেশন শুরুর পর স্পিকার রাষ্ট্রপতির আগমনের ঘোষণা দিলে সশস্ত্র বাহিনীর একটি বাদক দল বিউগলে ‘ফ্যানফেয়ার’ বাজিয়ে রাষ্ট্রপতিকে সম্ভাষণ জানান।
সংসদ কক্ষে রাষ্ট্রপতির ঢোকার পর নিয়ম অনুযায়ী জাতীয় সংগীত বাজানো হয়। সংসদে রাষ্ট্রপতির জন্য স্পিকারের পাশে লাল রঙের গদি সম্বলিত চেয়ার রাখা হয়।স্পিকারের ঘোষণায় অনুরোধের পর রাষ্ট্রপতি তার লিখিত ভাষণের সংক্ষিপ্তসার পড়া শুরু করেন। এসময় তার মূল বক্তব্য পঠিত বলে গণ্য করার জন্য স্পিকার শিরীন শারমিনকে অনুরোধ জানান আবদুল হামিদ।সংসদে দেওয়া বক্তব্যে রাষ্ট্রপতি সরকার ঘোষিত ভিশন-২০২১ এবং ভিশন-২০৪১ অর্জনে গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার ওপর জোর দেন।২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে বাংলাদেশ মধ্য-আয়ের দেশে পরিণত হবে এবং ২০৪১ সালে বিশ্বসভায় একটি উন্নত দেশের মর্যাদায় অভিষিক্ত হবে, এটাই জাতির প্রত্যাশা। আমি দৃঢ়ভাবে আশাবাদী রাষ্ট্র ও সমাজের সর্বস্তরে সুশাসন সুসংহতকরণ, গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ এবং জনগণের সর্বাত্মক অংশগ্রহণের মাধ্যমে আমরা এসব লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হব।
ভাষণে রাষ্ট্রপতি অর্থনীতি, বাণিজ্য-বিনিয়োগ, খাদ্য-কৃষি, পরিবেশ-জলবায়ু, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন খাতে সরকারের কার্যক্রম ও সাফল্য তুলে ধরেন।তিনি বলেন, আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি উন্নয়নের এ ধারা অব্যাহত রেখে সরকার নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হবে।এছাড়া মানব পাচার, সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ মোকাবেলায় সরকারের পদক্ষেপের প্রশংসা করেন। দেশের মাটি থেকে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ নির্মূল করতে বর্তমান সরকার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। বিগত মেয়াদের ধারাবাহিকতায় বর্তমান সরকার এ লক্ষ্যে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। এর ফলে দেশে নাশকতামূলক কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণে এসেছে এবং জনজীবনে স্বস্তি বিরাজ করছে।
সরকার রাজনীতি থেকে হিংসা, হানাহানি অবসান করতে টেষ্টা করছে মন্তব্য করে আবদুল হামিদ সরকার ও বিরোধী দলকে কার্যকর ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান।মহান জাতীয় সংসদ দেশের সকল উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু। বর্তমান সরকার রাজনীতি থেকে হিংসা, হানাহানি ও সংঘাতের অবসানের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বাংলাদেশকে একটি উন্নত ও আলোকিত দেশ হিসাবে প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।স্বচ্ছতা, জবাবদিহি, পরমতসহিষ্ণুতা, মানবাধিকার ও আইনের শাসন সুসংহতকরণ এবং জাতির অগ্রযাত্রার স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে সরকারি দলের পাশাপাশি বিরোধী দলকেও গঠনমূলক ভূমিকা পালন করতে হবে।
যুদ্ধপরাধীদের বিচারের বিষয়ে রাষ্ট্রপতি বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আন্তর্জাতিক আইন ও রীতিনীতির প্রতি সম্পূর্ণ ম্রদ্ধাশীল থেকে ১৯৭১ সালে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের বিচার সম্পন্ন করছে এবং বিচারের রায় কার্যকর হচ্ছে।যুদ্ধাপরাধীদের বিচারসহ অন্যান্য চাঞ্চল্যকর ও জনগুরুত্বপূর্ণ মামলাসমূহ নিস্পত্তির ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের ভূমিকা অত্যন্ত প্রশংসনীয়।এসময় সিলেটে শিশু রাজন হত্যা ও খুলনার রাকিব হত্যা মামলার কথাও তুলে ধরে রাষ্ট্রপতি, সম্প্রতি বিচারিক আদালত কর্তৃক বাংলাদেশের ইতিহাসে দ্রুততম সময়ে সিলেটের চাঞ্চল্যকর শিশু রাজন হত্যা মামলা এবং খুলনার শিশু রাকিব হত্যা মামলার বিচার কাজ সম্পন্ন হয়েছে।পদ্ম সেতুর কাজ শুরু হওয়ায় সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে আবদুল হামিদ বলেন, বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ সড়ক অবকাঠামো ৬ দশমিক এক-পাঁচ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ নিজস্ব অর্থায়নে শুরু হয়েছে।মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ১২ ডিসেম্বর ২০১৫ তারিখে মূল সেতুর পাইলিং এবং নদীশাসন কাজের উদ্বোধন করেন।”
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের কথা তুলে ধরে রাষ্ট্রপতি বলেন, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান সমুন্নত এবং সংসদীয় গণতন্ত্রের ধারা অব্যাহত রেখে ২০১৪ সালে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে দশম জাতীয় সংসদ গঠিত হয় এবং বর্তমান সরকারের ওপর দেশ পরিচালনার গুরুদায়িত্ব অর্পিত হয়।দশম জাতীয় সংসদের নবম অধিবেশন চলবে আগামী ২৯ ফেব্র“য়ারি পর্যন্ত।বুধবার) বিকেল সাড়ে ৩টায় কার্য উপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়।স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে কার্য উপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে অংশ নেন সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।শীতকালীন অধিবেশনের প্রতি কার্যদিবস শুরু হবে বিকেল সাড়ে ৪টায়। এই অধিবেশনে রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর ৪৫ মিনিট সাধারণ আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে। দশম সংসদের অধিকাংশ সংসদ সদস্য সাধারণ আলোচনায় অংশ নেবেন ।