দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ০৫ জানুয়ারি ২০১৬: বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সরকারকে উদ্দেশে করে বলেন, আমরা চাই আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সমাধান। গণতন্ত্রের জন্য এক সঙ্গে কাজ করতে। তিনি সরকারকে অবিলম্বে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘তারা জোর করে ক্ষমতায় আছে, তাই তাদেরই এটা করতে হবে।নয়া পল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনের সড়কে মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত জনসভায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এ কথা বলেন। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দুই বছর পূর্তি উপলক্ষে বিএনপি এই জনসভার আয়োজন করে। দলটি এই দিনটি ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ হিসেবে পালন করছে। আজকের জনসভায় খালেদা জিয়া ভবিষ্যতেও এই দিনটি পালনের ঘোষণা দেন।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে উদ্দেশে করে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেন, সঠিক পথে আসুন, গণতন্ত্রের পথে আসুন। তিনি সরকারকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, এটা না হলে কখন জনগণ জেগে উঠবে তা বলা যায় না।জনসভায় বিএনপি চেয়ারপারসন অভিযোগ করেন, বিরোধী দলকে দমনের জন্য সরকার একের পর এক আইন করছে। সংবিধান পরিবর্তন করেছে নিজের স্বার্থে। এই পরিবর্তনে জনগণের ভালোর জন্য কিছু নেই। তিনি বলেন, কেবল ২০১৪ সালের নির্বাচন নয় ২০০৮ সালে ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনও পাতানো নির্বাচন ছিল। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তৎকালীন সেনা প্রধান মইন ইউ আহমেদ ও প্রধান উপদেষ্টা ফখরুদ্দীন আহমদের সঙ্গে আলোচনা করে করেছিল। পৌরসভা নির্বাচনের সময় বিএনপির নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ না করায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, তিনি (সিইসি) কি এমন লাটসাহেব হয়েছেন যে দেখা করতে পারেন না।খালেদা জিয়া সিইসিকে অথর্ব ও মেরুদণ্ডহীন বলে উলে¬খ করেন। সিইসির কথা বলারও সাহস নেই বলে মন্তব্য করেন তিনি। খালেদা জিয়া বলেন, আওয়ামী লীগের অধীনে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। প্রথম দুই দফার উপজেলা নির্বাচন ও পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রমাণ হয়েছে নির্বাচন একটু সুষ্ঠু হলে বিএনপি জয়ী হয়।
পৌর নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে জয়ী করতে নির্বাচন কমিশন সব ধরনের ব্যবস্থা করেছে এমন অভিযোগ করে খালেদা জিয়া বলেন, দলীয় প্রতীকে পৌরসভায় মেয়র নির্বাচন দিয়ে আওয়ামী লীগ নিজেদের জনপ্রিয়তা দেখাতে চায়। জনপ্রিয়তা দেখানোর জন্য নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হওয়া উচিত। তখন বুঝবেন অবস্থাটা।নির্বাচন কমিশনের কঠোর সমালোচনা করেন খালেদা জিয়া। তিনি নির্বাচন কমিশনকে অথর্ব, আজ্ঞাবহ,মেরুদণ্ডহীন আখ্যা দিয়ে বলেন, আওয়ামী লীগ আর নির্বাচন কমিশন মিলে গণতন্ত্র হত্যা করেছে।পৌর নির্বাচনের আগে বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে কমিশনারের সাক্ষাৎ না করার সমালোচনা করে বিএনপির প্রধান বলেন, ‘তিনি (সিইসি) কী এমন লাটসাহেব হয়েছেন যে দেখা করতে পারেন না। সে নাকি অসহায়। অসহায় হলে পদত্যাগ করা উচিত। পদ ধরে আছে কেন?’খালেদা জিয়া অভিযোগ করেন, আওয়ামী লীগ রাজতন্ত্র কায়েম করছে। বিরোধী দলকে ফাঁদে ফেলার জন্য কথায় কথায় নতুন আইন করছে। কিন্তু আইন করে তাদের আটকানো যাবে না। সরকারকে খুন-জুলুম বন্ধ করে সঠিক পথে গণতন্ত্রের পথে’ আসার আহ্বান জানান তিনি। সরকারকে সতর্ক করে তিনি বলেন, এটা না হলে কখন জনগণ জেগে উঠবে তা বলা যায় না। আর জনগণ জেগে উঠলে তাদের ঠেকিয়ে রাখা যাবে না।
খালেদা জিয়া অভিযোগ করেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে জঙ্গিদের সম্পর্ক আছে। এ জন্য তারা বিদেশিদের বারবার জঙ্গিবাদের ভয় দেখায়। তারা বলে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে জঙ্গিবাদের উত্থান হবে। তাঁর অভিযোগ, জঙ্গিবাদ আওয়ামী লীগের তৈরি। আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় আসে, তখন জঙ্গিবাদের উত্থান হয়। উদাহরণ হিসেবে তিনি রমনার বটমূলে বোমা হামলা, বাংলা ভাই, শায়খ আবদুর রহমানের উত্থানের কথা বলেন। খালেদা জিয়া দাবি করেন, কিছু মানুষকে ধরে নিয়ে র্যাবের সদর দপ্তরে কিছুদিন রাখা হয়। তাদের খেতে দেওয়া হয় না, দাঁড়ি কামাতে দেওয়া হয় না। তারপর একসময় সামনে এনে বলা হয়, জঙ্গি ধরেছি। গুলশানে বিদেশি নাগরিক হত্যার পেছনে জড়িতদের কেন ধরা হয়নি তা-ও জানতে চান বিএনপির চেয়ারপারসন।
খালেদা জিয়া বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমলেও বাংলাদেশে কমানো হচ্ছে না। তেল, গ্যাস, বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে। তেল-গ্যাসের দাম কমানো উচিত।শিক্ষকদের যথাযথ মর্যাদা দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে খালেদা জিয়া বলেন, সিভিল সার্ভিসে বৈষম্য সৃষ্টি করা হচ্ছে। সরকার দু-একটি ক্যাডারকে প্রাধান্য দিচ্ছে। ২৬টি ক্যাডারের মানুষ আন্দোলন করছেন।বিএনপি চেয়ারপারসন প্রায় এক বছরের বেশি সময় পর জনসভায় ভাষণ দিলেন। এই সময়ের মধ্যে কেবল গত এপ্রিলে ঢাকার দুটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নিজ দল সমর্থিত প্রার্থীর পক্ষে প্রচার-প্রচারণায় নেমে কয়েকটি পথসভায় ভাষণ দেন। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দ্বিতীয় বর্ষপূর্তির দিনকে গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ হিসেবে পালন করে অবিলম্বে ‘সুষ্ঠু’ নির্বাচনের দাবি জানিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।আর এই নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সব দলের সঙ্গে আলোচনার উদ্যোগ নিতেও ক্ষমতাসীনদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। সমাবেশে তিনি বলেন,আমরা চাই আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সমাধান। গণতন্ত্রের জন্য এক সঙ্গে কাজ করতে।
নির্দলীয় সরকারের অধীনে নতুন নির্বাচনের দাবিতে গতবছর প্রথম তিন মাস টানা অবরোধ-হরতালে সাফল্য না পেলেও একবছরের মাথায় এ সমাবেশে আবারও নির্বাচনের দাবি তুলেছেন খালেদা জিয়া।তিনি বলেছেন, আওয়ামী লীগের উচিৎ ‘সবাইকে নিয়ে আলোচনা করে অবিলম্বে একটি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন করার জন্য সুষ্ঠু ‘পরিবেশ সৃষ্টি করা।জোর করে বসে আছে, নির্বাচনের ব্যবস্থা করার দায়িত্ব তাদের, বলেন খালেদা।আওয়ামী লীগ নেতাদের উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, সঠিক পথে আসুন, গণতন্ত্রের পথে আসুন। না হলে কিন্তু জনগণ কখন জেগে উঠবে বলা যায় না জনগণকে ঠেকিয়ে রাখা যাবে না।নির্দলীয় সরকারের অধীনে ভোটের দাবিতে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে খালেদার দল বিএনপি ও তার শরিকরা। ওই নির্বাচনে জয়ী হয়ে টানা দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ, আর দীর্ঘদিন পর বিএনপিকে সংসদের বাইরে থাকতে হয়।ওই নির্বাচনের আগে ও পরে বিভিন্ন সময়ে প্রধান দুই দলের মধ্যে সংলাপের বিষয়টি রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনায় এলেও কখনোই তা ফলপ্রসূ কোনো রূপ পায়নি।
গতবছর নির্বাচনের বর্ষপূর্তিতে বিএনপি গণতন্ত্র হত্যা দিবস এবং আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রের বিজয় দিবস পালনের ঘোষণা দিয়ে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি দিলে তৈরি হয় উত্তেজনা। পুলিশ ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে সমাবেশের পথ বন্ধ করে দিলে খালেদা টানা অবরোধের ঘোষণা দেন।এরপর তিনমাসে নরিজবিহীন সহিংসতা ও নাশকতায় দেড় শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়, যার পেছনে বিএনপিকেই দায়ী করে আসছেন আওয়ামী লীগের নেতারা।অবরোধ-হরতালের সেই কর্মসূচির পর নয়া পল্টনের এই সমাবেশই ছিল খালেদার বড় কোনো জনসভায় অংশগ্রহণ। সেখানে নেতাকর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার কেবল ‘গণতন্ত্রই হত্যা’ করেনি,‘মানুষ হত্যা’ করে দেশে ‘রাজতন্ত্র কায়েম করার’ চেষ্টায় আছে।ক্ষমতাসীনদের উদ্দেশে বিএনপিনেত্রী বলেন, মানুষ গুম করে, খুন করে রাজতন্ত্র কয়েম করার যে চেষ্টা আপনারা করছেন, আমার মনে হয় তা কোনো ভালো ফল বয়ে আনবে না।
সরকার বিএনপি নেতাকর্মীদের ফাঁদে ফেলার জন্য কথায় কথায় নতুন আইন করছেন বলে অভিযোগ করেন খালেদা। তিনি বলেন, জনগণকে কখনো আটকানো যায় না। যে আইনে জনগণের কোনো কল্যাণ করে না সেটা মানুষ কোনোদিন গ্রহণ করে না।গুম-খুন করে কেউ কোনোদিন ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারেনি বলে সরকারকে সতর্ক করেন বিএনপিনেত্রী।গত সপ্তাহে পৌর নির্বাচনে ভরাডুবির পর এটাই বিএনপির প্রথম প্রকাশ্য কর্মসূচি। নয়া পল্টনে খালেদা জিয়া ২০১২ সালে সর্বশেষ জনসভায় বক্তব্য দিয়েছিলেন।২০০৯-২০১৩ সালের মধ্যে কয়েকটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীদের জয়ী হওয়ার কথা মনে করিয়ে দিয়ে খালেদা বলেন, একটু ফেয়ার ইলেকশন হলেই বিএনপি তাতে জয়লাভ করে। কিন্তু আওয়ামী লীগের অধীনে কোনোদিন জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে হবে না।
খালেদা অভিযোগ করেন, বিরোধীদের ‘হয়রানি-নির্যাতনের’ জন্য সরকার পুলিশ বাহিনীকে ব্যবহার করছে।আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভাইয়েরা এখানে আছেন। তাদের প্রতি বলব, এরা তো এই বাংলাদেশেরই ছেলে। এতো অত্যাচার, এতো কষ্ট, গুম খুন করা .. এটা কি ঠিক?আপনাদের নিয়ে অন্যায় কাজ করাচ্ছে। আমি বলছি না পুলিশ বাহিনী খারাপৃ কিন্তু আপনাদের নষ্ট করছে।‘এসব’ বন্ধ করার দাবি জানিয়ে খালেদা বলেন, আমরা একসঙ্গে থাকতে চাই। বাংলাদেশ ছোট্ট একটি দেশ। আমরা যদি সকলে মিলে-মিশে থেকে কাজ করি, বাংলাদেশকে আমরা একটি সুন্দর দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারব।”
দীর্ঘদিন পর এই সমাবেশ ঘিরে সকাল থেকেই বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা যায়। দুপুরের আগে থেকেই ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে তারা জড়ো হতে থাকেন নয়া পল্টনে সভামঞ্চের সামনে।এক পর্যায়ে নয়া পল্টন সড়কের পূর্বে ফকিরেরপুল মোড় এবং পশ্চিমে কাকরাইলের নাইটিঙ্গেল রেঁস্তোরা পর্যন্ত সড়কে সমাবেশের বিস্তার ছড়িয়ে পড়লে পুলিশ যানচলাচল বন্ধ করে দেয়। বেলা ২টার পর দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের সভাপতিত্বে সভার কার্যক্রম শুরু হলে প্রথমে বক্তৃতা করেন ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক আকরামুল হাসান।খালেদা জিয়া বেলা পৌনে ৩টার দিকে জনসভা মঞ্চে এলে নেতা-কর্মীরা করতালি ও শে¬াগান দিয়ে তাকে স্বাগত জানান। খালেদাও হাত নেড়ে নেতা-কর্মীদের শুভেচ্ছার জবাব দেন।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ, মাহবুবুর রহমান, আসম হান্নান শাহ, জমিরউদ্দিন সরকার, আবদুল মঈন খান, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, নজরুল ইসলাম খান, জ্যেষ্ঠ নেতা শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, হাফিজউদ্দিন আহমেদ, হারুন আল রশীদ, মোহাম্মদ শাহজাহান ও রুহুল কবির রিজভীও সমাবেশ মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন।