দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৫: দলীয় প্রতীকে দেশের প্রথম পৌর নির্বাচন নিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিবউদ্দিন আহমদের আশা ছিল সুন্দর একটা নির্বাচন হবে। অবশ্য তার কাছে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ নিয়ে হাজির হয়েছিল আওয়ামী লীগ-বিএনপি। এছাড়া দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করা বিএনপি এ নির্বাচনে অংশ নেয়ায় দেশবাসীর আশা ছিল নৌকা-ধানের শীষে হাড্ডা-হাড্ডি লড়াই হবে। সে মোতাবেক বুধবার ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনায় ভোটগ্রহণ শুরু হলেও অঘটন ঘটে যায় ভোট শুরুর তিন ঘণ্টার মধ্যে। ঘটনাস্থল চট্টগ্রামের সাতকানিয়া। বিএনপি ও আওয়ামী লীগের দু’পক্ষের সংঘর্ষে সেখানে মো. নুরুল আমিন (৪০) নামে এক ব্যক্তি নিহত হন। বিকেল ৪টায় ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ভোট কেন্দ্র দখল,প্রার্থীদের ভোট বর্জন আর হামলার খবর পাওয়া যায়। আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীসহ বেশ কয়েকজন গুলিবিদ্ধও হন। আর ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ায় আহত হন অর্ধশতাধিক। আহতদের মধ্যে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতা-কর্মীই বেশি। এছাড়া বিভিন্ন প্রার্থীর বাড়িতে হামলার অভিযোগও পাওয়া যায়। ক্ষমতাসীন দলের একজন মনোনীত মেয়র পদপ্রার্থীসহ বিএনপির ২৮এবং স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থীদের মধ্যে ছয়জন ভোট বর্জন করেছেন। এছাড়া ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয়েছে দেশের প্রায় ১৭ টি ভাটকেন্দ্রে।
বরগুনা পৌরসভা নির্বাচনের ভোটগ্রহণ শুরুর কয়েক ঘণ্টার মাথায় ভোট বর্জন করেন বরগুনা সদর পৌরসভায় আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী অ্যাডভোকেট কামরুল আহসান মহারাজ।ভোট বর্জনের পর তার সমর্থকরা বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষ বাধায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ছোড়া গুলিতে ভোট বর্জনকারী আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থীসহ চারজন গুলিবিদ্ধ হন। গুলিবিদ্ধ অন্যরা হলেন- রাহাত, নাজমুল ও নয়ন। গুলিবিদ্ধ সবাইকে বরগুনা শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজে ভর্তি করা হয়েছে।বরিশালের ঝালকাঠির নলছিটি পৌরসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দুই আওয়ামী লীগ নেতাকে কুপিয়ে জখম করা হয়েছে। গুরুতর অবস্থায় বুধবার বেলা দেড়টার দিকে তাদের উদ্ধার করে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ (শেবাচিম) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আহতরা হলেন- উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা আবু সাঈদ মোস্তাফা কামাল এবং নলছিটির সুবিদপুর ইউনিয়ন যুবলীগ সভাপতি সেলিম ওরফে গালকাটা সেলিম।
কুয়াকাটার পাঞ্জুপাড়া ভোটকেন্দ্র দখল নিয়ে আওয়ামী-লীগ ও বিএনপির কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে সাতজন আহত হয়েছন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ ফাঁকা গুলি ছুড়েছে। সকাল সোয়া ৯টার দিকে এ সংঘর্ষ হয়। আহতদের কলাপাড়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে। ফেনীর দাগনভূঞাঁ পৌরসভায় বিএনপি মেয়র প্রার্থী সাইফুর রহমান স্বপনকে মারধর করা হয়েছে। সকাল সাড়ে ৯টায় পৌরসভার করিমপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে গেলে নৌকা প্রতীকের সমর্থকরা তাকে মারধর করেন বলে স্বপন অভিযোগ করেন। সোনারগাঁও পৌরসভার আওয়ামী লীগের অ্যাডভোকেট এটি ফজলে রাব্বীর (নৌকা) সমর্থকদের সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী বর্তমান মেয়র সাদেকুর রহমানের (জগ) সমর্থকদের সংঘর্ষে ওসিসহ আহত হয়েছেন ৪ জন। আহতদের নাম পরিচয় তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি।
বরগুনা প্রশাসনের বিরুদ্ধে বিরূপ আচরণের অভিযোগ এনে বরগুনা সদর পৌরসভার আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী অ্যাডভোকেট কামরুল আহসান মহারাজ ভোট বর্জন করেছেন। বেলা ১২টার দিকে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী অ্যাডভোকেট কামরুল আহসান মহারাজ প্রশাসনের বিরুদ্ধে বিরূপ আচরণের অভিযোগ তুলে ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন। একইসঙ্গে তিনি বিদ্রোহী প্রার্থী টাকা দিয়ে প্রশাসন কিনে নিয়েছে বলেও অভিযোগ করেন। ভোটের দিন অন্তত এক ডজন পৌরসভায় গোলযোগের জন্য পরস্পরকে দায়ী করে নির্বাচন কমিশনে নালিশ জানিয়েছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি।বিএনপি প্রার্থীরা ত্রাস সৃষ্টি করেছে, নির্বাচন কমিশনারদের সঙ্গে বৈঠকের পর সাংবাদিকদের বলেছেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য এইচ টি ইমাম।কমিশনারদের সঙ্গে বৈঠকের পর বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছেন, শতাধিক ভোটকেন্দ্র দখল করে ক্ষমতাসীনরা সহিংসতা সৃষ্টি করেছে।
বিক্ষিপ্ত গোলযোগ এবং জালভোটের অভিযোগের মধ্যে বুধবার সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত ২৩৪টি পৌরসভায় ভোটগ্রহণ চলে। চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় সংঘর্ষে একজন নিহত হয়েছে,মাধবদীর পুরো পৌরসভা এবং অন্যান্য স্থানের ১৭টি কেন্দ্রে ভোট স্থগিত হয়েছে।দলীয় প্রতীকের অনুষ্ঠিত এই ভোটের একদিন আগেও নানা অভিযোগ নিয়ে ইসিতে গিয়েছিল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। ভোটগ্রহণ শেষের আগে ও পরেও তাদের প্রতিনিধি দল পুনরায় ইসিতে যায়।নির্বাচন কমিশনার আবদুল মোবারক, আবু হাফিজ, জাবেদ আলী ও মো. শাহনেওয়াজ বড় দুটি দলের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে কথা বলেন। সাত বছর পর নৌকা-ধানের শীষের লড়াইয়ে বাংলাদেশের ২৩৩ পৌরসভায় নির্বাচন শেষ হয়েছে বিক্ষিপ্ত গোলযোগ আর অনিয়মের মধ্য দিয়ে।
বুধবার সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত এসব পৌর এলাকাগুলোর সাড়ে ৩ হাজার কেন্দ্রে ভোটগ্রহণের পর শুরু হয়েছে গণনা। তবে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে যারা কেন্দ্রের চৌহদ্দির মধ্যে প্রবেশ করেছেন, তাদের সবার ভোট নেওয়া হবে।ভোট গণনা শেষ হলে সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে নির্বাচনের বেসরকারি ফল ঘোষণা করা বলে নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তরা জানিয়েছেন। সব পৌরসভায় একজন করে মেয়র, সংরক্ষিত ৭৩১টি ও সাধারণ কাউন্সিলরের ২ হাজার ১৯৩টি পদের এই নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন ১২ হাজার প্রার্থী। এর মধ্যে ২২২টিতে দুই বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রার্থীরা মুখোমুখি লড়াইয়ে ছিলেন।৭০ লাখ ৯৯ হাজার ১৪৪ জন ভোটারের মধ্যে কতজন শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রে গিয়ে তাদের মতামত দিয়েছেন, সে তথ্য জানাতে পারেনি ইসি।
সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশনার মো. আবু হাফিজ বলেছেন, ভোটের হার ভালোই হবে। নারী ভোটারের উপস্থিতিও বেশ। তবে এ মুহূর্তে এ নিয়ে খোঁজ নিচ্ছি না আমরা। আইন-শৃঙ্খলাটাই এখন মুখ্য। ভোটে অনিয়মের সঙ্গে সম্পৃক্ততা’র অভিযোগে দুই জেলায় পুলিশের পাঁচ কর্মকর্তাকে এদিন সাময়িক বরখাস্তের নির্দেশ দিতে হয়েছে ইসিকে।সকালে ২৩৪ পৌরসভায় নির্বাচন শুরু হলেও নরসিংদীর মাধবদী পৌরসভার একটি কেন্দ্র দখল করে ব্যালটে সিল মারার ঘটনা ঘটে। জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের উপস্থিতিতে হামলা ও বোমাবাজিও হয়। পরে বিকালে ওই পৌরসভার ভোট স্থগিতের কথা জানান কমিশনার আবু হাফিজ।এছাড়া অন্তত ২০টি পৌরসভায় বিভিন্ন কেন্দ্রে গোলযোগ হয়েছে, সাতকানিয়া পৌরসভায় ভোটে কেন্দ্রের দেড় কিলোমিটার দূরে দুই কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন একজন।
ব্যালটে সিল মেরে বাক্স ভর্তি করার অভিযোগ আর সংঘর্ষের কারণে ১১ পৌরসভার ১৭টি কেন্দ্র স্থগিত করেছে কমিশন।এর মধ্যে চট্টগ্রামের চন্দনাইশে তিনটি, নীলফামারীর সৈয়দপুরে তিনটি, মাদারীপুরের কালকিনিতে দুটি, কুড়িগ্রামের উলিপুরে দুটি এবং কুমিল্লার বরুড়া, ময়মনসিংহের ভালুকা, জামালপুরের সরিষাবাড়ী, বরগুনা, চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ, নড়াইলের কালিয়া এবং পটুয়াখালীর কুয়াকাটা পৌরসভার একটি করে কেন্দ্র রয়েছে।প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর বিরুদ্ধে কেন্দ্র দখল, এজেন্টদের বের করে দেওয়াসহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ তুলে চট্টগ্রামের তিন পৌরসভায় বিএনপির তিনজন এবং বরগুনায় আওয়ামী লীগের প্রার্থীসহ মোট ২৩ মেয়র প্রার্থী ভোট চলাকালেই বর্জনের ঘোষণা দেন। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করা বিএনপি গত এপ্রিল ঢাকা ও চট্টগ্রামের তিন সিটির নির্বাচনের মাঝপথে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছিল। এবার পৌর ভোটে কেন্দ্রীয়ভাবে তেমন কোনো ঘোষণা দলটি না দিলেও ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে তাদের অভিযোগ অনেক।সকালে ভোট শুরুর দেড় ঘণ্টার মাথায় বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী অভিযোগ করেন, নির্বাচনের ফল পক্ষে নিতে সরকারি কারসাজির যে আশঙ্কা তারা প্রকাশ করে আসছিল, ভোটের মাঠে দিনের শুরুতেই তা সত্যি হতে শুরু করেছে।