দৈনিকবার্তা-চট্টগ্রাম, ২৭ ডিসেম্বর ২০১৫: ঢাকার পর এবার চট্টগ্রামের এক বাসায় নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জেএমবির আস্তানার সন্ধান পাওয়ার কথা জানিয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ; সেখান থেকে উদ্ধার করা হয়েছে স্নাইপার রাইফেল, বিস্ফোরক ও গুলি ।এ ছাড়া সেখান থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১৪টি পোশাক, নেমপ্লেট ও র্যাংক ব্যাজ এবং জেএমবি নিয়ে করা পুলিশ সদর দপ্তরের একটি পরিপত্রের কপিও উদ্ধার করা হয়েছে। নগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (উত্তর-দক্ষিণ) বাবুল আক্তার জানান, হাটহাজারি থানার আমান বাজার এলাকায় হাজী ইছহাক ম্যানসন নামের ওই দুই তলা বাড়ির নিচতলায় শনিবার রাত দেড়টা থেকে রোববার ভোর ৬টা পর্যন্ত অভিযান চালান তারা।তিনি জানান, গত ৫ অক্টোবর খোয়াজনগর এলাকায় গোয়েন্দা পুলিশের অভিযানে গ্রেপ্তার জেএমবি সদস্যদের বিষয়ে তদন্ত করতে গিয়ে চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থান থেকে নাহিম, রাসেল ও ফয়সাল নামে ২৫ থেকে ২৭ বছর বয়সী তিন যুবককে গ্রেপ্তার করা হয়। নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশের (জেএমবি) সামরিক কমান্ডার ফারদিনের আস্তানা থেকে এবার মার্কিন নৌবাহিনীর ব্যবহৃত অত্যাধুনিক এমকে-১১ স্নাইপার রাইফেল উদ্ধার করেছে নগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি), যেটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে দেড় হাজার গজ দূরে টার্গেট পূরণ করতে পারে। বাংলাদেশে প্রথম এ অস্ত্র পাওয়া গেল।
জেএমবির আস্তানা থেকে অত্যাধুনিক রাইফেল, সেনাবাহিনীর পোশাক ও পুলিশের পরিপত্রের উদ্ধারের ঘটনায় দেশের আইন-শৃংখলা বাহিনীর গোপনীয়তা নিয়েও এখন প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষ করে অত্যাধুনিক এই অস্ত্র কীভাবে দেশে প্রবেশ করেছে এবং পুলিশের গোপন পরিপত্র জেএমবির হাতে কীভাবে গেছে সেটি নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে বলেও মত দিয়েছেন এক নিরাপত্তা বিশ্লেষক। এ নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন সিএমপির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও। সেটি নিয়ে নতুন করে তদন্ত করা হবে বলে জানিয়েছেন তিনি। শনিবার মধ্যরাত ১২টা থেকে গভীররাত ৪টা পর্যন্ত হাটহাজারী উপজেলাধীন সিটি করপোরেশনের ১ নম্বর পাহাড়তলী ওয়ার্ডের জয়নব কমিউনিটি সেন্টারের পেছনে হাজী ইছহাক ম্যানশন নামের একটি দোতলা বাড়িতে এ অভিযান চালানো হয়। অভিযানে জেএমবি চট্টগ্রাম অঞ্চলের সামরিক কমান্ডার ফারদিনের আস্তানা থেকে তার তিন সহযোগিসহ আমেরিকার তৈরি একটি এমকে-১১ স্নাইপার রাইফেল, ১৯০ রাউন্ড গুলি, ১০টি ডেটোনেটর, বোমা তৈরির বিভিন্ন সরঞ্জাম, দুই কেজি জেল এক্সপ্লোসিভ, সোনাবাহিনীর ১৪টি পোশাক, নেমপ্লেট ও বেইজ র্যাংক, ডায়েরি, মানচিত্র এবং সাংগঠনিক বিভিন্ন নথিপত্র উদ্ধার করা হয়।অভিযানে নেতৃত্বদানকারী নগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ কমিশনার (উত্তর-দক্ষিণ) বাবুল আক্তার বলেন, জেএমবির চট্টগ্রাম অঞ্চলের সামরিক কমান্ডার ফারদিনের আস্তানা থেকে বিপুল পরিমাণ বোমা তৈরির সরঞ্জাম, সাংগঠনিক নথিপত্র, গুলি উদ্ধার করা হয়েছে। প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে পাওয়া গেছে মার্কিন নৌবাহিনীর ব্যবহৃত স্বয়ংক্রিয় এমকে-১১ স্লাইপার রাইফেল, যেটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে দেড় হাজার গজ দূরে টার্গেট পূরণ করতে পারে। এটি মার্কিন নৌবাহিনীর সদস্যরা ব্যবহার করে থাকেন।’
নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) দেবদাস ভট্টাচার্য বলেন, জেএমবির আস্তানায় এতোদিন একে ২২ রাইফেল, বোমা তৈরির সরঞ্জাম পাওয়া গেলেও এবার তাদের কাছ থেকে অত্যাধুনিক এমকে-১১ স্নাইপার রাইফেল পাওয়া গেছে। এ ছাড়া তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন সাংগঠনিক নথির সাথে জেএমবির বিষয়ে পুলিশের করা একটি গোপন পরিপত্রও পাওয়া গেছে। যেটি আমাদের জন্য এলার্মিং। সেটি কীভাবে তাদের কাছে গেল সেটি এখন আমরা খতিয়ে দেখব। এ ছাড়া তারা কী উদ্দেশ্য নিয়ে সেনাবাহিনীর পোশাক, র্যাংক বেইজ, নেমপ্লেট মজুদ করেছিল সেটিও খতিয়ে দেখা হবে। মার্কিন নৌবাহিনীর ব্যবহার করা অস্ত্র কীভাবে তাদের হাতে আসলো সেটিও এখন চিন্তার বিষয়। সব কিছুই এখন তদন্ত করে দেখা হবে।অত্যাধুনিক এই অস্ত্রটি বান্দরবান থেকে কিনে আনা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। আটক তিন জেএমবি সদস্য এটি সেখান থেকে সংগ্রহ করেছিল।
এ প্রসঙ্গে নিরাপত্তা বিশ্লেষকমেজর(অব.)এমদাদুল ইসলাম বলেন,জেএমবির আস্তানা থেকে সেনাবাহিনীর পোশাক,নেমপ্লেট, র্যাংক বেইজ উদ্ধার হওয়ার বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর। এগুলো চট্টগ্রামের বায়েজিদ এলাকায় খুচরা বাজারে বিক্রি করা হয়। সেই সুবাদে যে কেউ এসব পোশাক ও সরঞ্জাম কিনতে পারে যাতে করে এগুলো কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ব্যবহার করতে পারে খুব সহজেই। এটি নিয়ে নতুন করে ভেবে দেখার সময় এসেছে।সম্প্রতি পার্বত্য এলাকয় একটি পাহাড়ি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর যে পাঁচ সদস্য সেনাবাহিনীর অভিযানে মারা গেছে তাদের পরনেও সেনাবাহিনীর পোশাক ছিল বলে জানান তিনি।
তিনি আরো বলেন, জেএমবির আস্তানা থেকে মার্কিন নৌবাহিনীর ব্যবহৃত এমকে-১১ স্নাইপার রাইফেল উদ্ধার করা হয়েছে। এ রকম একটি অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র তাদের হাতে কীভাবে আসলো কিংবা কীভাবেই বা দেশে প্রবেশ করেছে সেটিও ভেবে দেখা দরকার। এসব অস্ত্রের ব্যবহার যদি জেএমবি সদস্যরা শুরু করে তাহলে বড় ধরনের প্রাণহানি ঘটতে পারে। সাধারণত ভারতের কিছু বিছিন্নতাবাদীদের হাতেই এসব অস্ত্র পাওয়া যায়।পুলিশের নথিপত্র প্রসঙ্গে মেজর (অব.) এমদাদ আরো বলেন, একটি সরকারি বাহিনীর গোপন নথি কীভাবে জেএমবির হাতে গেলো সেটি খুব গুরুত্বসহকারে খতিয়ে দেখতে হবে। কেননা পুলিশের যে পরিমাণ লোক নিয়োগ করা হচ্ছে, সেখানে একশ’ জনের মধ্যে যদি জেএমবি মনোভাবাপন্ন ৫ জনও ঢুকিয়ে দেয়া যায়, তাহলে তাদের দমিয়ে রাখা কষ্টকর হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে পুলিশেও জেএমবির লোক ঢুকেছে কি না সেটি খতিয়ে দেখতে হবে। বিশেষ করে পুলিশে লোক নিয়োগে যাচাই-বাছাইয়ের বিয়ষগুলো আরো কড়াকড়ি করতে হবে।
এর আগে গত ৫ অক্টোবর নগরীর কর্ণফুলী থানার খোঁয়াজনগর এলাকায় জেএমবির চট্টগ্রামের সামরিক কমান্ডার জাবেদের আস্তানা থেকে ৯টি গ্রেনেড ও বিপুল পুরিমাণ গুলি, বিস্ফোরক ও অস্ত্র তৈরির মেশিন উদ্ধার করেছিল নগর গোয়েন্দা পুলিশ। এ সময় সেখান থেকে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। যদিও অভিযানের সময় সামরিক কমান্ডার জাবেদ গ্রেনেড বিস্ফোরণে নিহত হয়েছিল বলে পুলিশের দাবি। চলতি বছরের ২৮ ফেব্র“য়ারি নগরীর হালিশহর থানার গোল্ডেন আবাসিক এলাকার ১ নম্বর সড়কের গোলাম মাওলা লেইনের ১/১৯ নম্বর ভিয়া ম্যানশনের ২য় তলায় অভিযান চালিয়ে পরিমাণ বিস্ফোরকসহ সামরিক বাহিনীর সরঞ্জাম উদ্ধার করেছিল র্যাব। নতুন জঙ্গি সংগঠন শহীদ হামজা ব্রিগেডের আস্তানা থেকে উদ্ধার হওয়া এসব সরঞ্জাম দিয়ে একটি সেনাবাহিনীর ব্যাটালিয়ন চালানো সম্ভব বলে জানিয়েছিলেন র্যাবের ডিজি বেনজির আহমেদ।
র্যাবের তালিকা অনুযায়ী, উদ্ধার হওয়া বোমা ও সরঞ্জামের মধ্যে ছিল, ১২ বোর শর্ট গানের গুলি ১২টি, ‘ইম্প্রেসিভ এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস’ বিভিন্ন ধরনের বোমা ২২টি, বোমা তৈরির স্টিল বোতল ১২৩৫ পিস, বোমা তৈরির খালি পাইপ ২৪ পিস, অ্যালুমিনিয়াম ডাস্ট ৫৯ কেজি, সোডিয়াম ১৭ কেজি ৬শ’ গ্রাম, অ্যামোনিয়াম নাইট্রিক জিআর ৩ কেজি ৮শ’ গ্রাম, সালপার (২৫০ গ্রাম) এক কেজি, অ্যামোনিয়াম নাইট্রিক এক কেজি ওজনের ৬ কেজি, ম্যাগনেসিয়াম পাউডার ৫শ’ গ্রাম ওজনের এক পিস, নাইট্রিক পিউরিপাইড ৫ শ’ গ্রাম ওজনের ১৩ পিস, সালপার ১০ কেজি, গাউন পাউডার ৫শ’ গ্রাম, পটাশিয়াম ক্লোরাইড ৩৫ কেজি, বিভিন্ন ধরনের স্টিল বল ৫ কেজি, নাইট্রোবেনজেনি ৫ লিটার, ইডি সালফাইড ৪ কেজি, পিইটিএন ৫ শ’ গ্রাম, সোডিয়াম এভাইড ১শ’ গ্রাম, চেয়ার কোল ২ কেজি, লাইফ স্মোক এমকে-৮ ওরেঞ্জ ৪ পিস, বেয়নেট স্মোক সিগন্যাল ওরেঞ্জ-এইচ ডব্লিউ এক পিস, বেয়নট স্মোক সিগন্যাল ওরেঞ্জ-কেএমএ-৪৩ দুই পিস, প্লোটিং ওরেঞ্জ স্মোক সিগন্যাল-আইএফএফ-২০৩ দুই পিস, বেয়নট স্মোক সিগ্যানাল ওরেঞ্জ (চায়না) দুই পিস, স্মোক সিগন্যাল ওরেঞ্জ ৪ এম আই এন ১১ পিস, বেয়নট স্মোক সিগন্যাল কে-৩৫ দুই পিস বেয়নেট স্মোক সিগন্যাল জেএইচথ্রি দুই পিস, উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন রকেট প্যারাস্যুট প্লেয়ার দুই পিস, মাস্ক এক পিস, গ্লাভস এক পিস, সিরিঞ্জ এক পিস, ব্লেন্ডোর মেচিন এক পিস, জঙ্গল বুট ৮৬ জোড়া, পিটি সু ৯৭ জোড়া, নাইলন বেল্ট ৯৬ জোড়া, মোজা ১৮৫ জোড়া।অভিযানে থাকা গোয়েন্দা পুলিশের বোমা নিস্ক্রিয়করণ ইউনিটের এসআই সন্তোষ চাকমা বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি স্নাইপার রাইফেলটি অত্যাধুনিক। চট্টগ্রামে এ ধরনের রাইফেল এর আগে আর উদ্ধার হয়নি।বাবুল আক্তার জানান, ওই বাসা ভাড়া নিয়েছিল জেএমবির আঞ্চলিক কমান্ডার ফারদিন। আগে গ্রেপ্তার হওয়া কয়েকজনের কাছে ওই আস্তানার কথা জানা গেলেও ওই বাসার ঠিকানা আগে পুলিশ জানতে পারেনি।
এর আগে গত বুধবার মধ্যরাত থেকে ঢাকার মিরপুরের এক বাড়িতে প্রায় ১৪ ঘণ্টা ধরে অভিযান চালিয়ে জেএমবির তিন সদস্যসহ সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। ওই বাসায় পাওয়া যায় ১৬টি হাতে তৈরি গ্রেনেড, ককটেল ও ‘সুইসাইড ভেস্ট’।হাটহাজারি থানাধীন আমান বাজার এলাকায় হাজী ইছহাকের ওই বাড়ি পড়েছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকার মধ্যে। চারদিকে সীমানা প্রাচীর দিয়ে ঘেরা ভবনটির পাশে আধাপাকা আরও কয়েকটি বাসা আছে।
বাড়ির মালিক হাজী ইছহাক পরিবার নিয়ে দ্বিতীয় তলায় থাকেন। নিচতলার তিন কক্ষের বাসাটি সাত মাস আগে ভাড়া নিয়েছিলেন এক যুবক, যিনি নিজের নাম বলেছিলেন নাফিজ।
হাজী ইছহাক বলেন, ছয় হাজার টাকায় বাসা ভাড়া নিয়েছিল সে। বলেছিল, চট্টগ্রাম ও ঢাকায় তার বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা আছে, পরিবার নিয়ে এখানে থাকবে। দেড় বছর বয়সী একটা বাচ্চা আর স্ত্রীকে নিয়ে সে বাসায় উঠেছিল। তবে মাস দেড়েক আগে স্ত্রী-সন্তানকে বাসা থেকে নিয়ে যায়। এরপর অধিকাংশ সময় বাসায় কেউ থাকতো না। নাফিজ মাঝেমধ্যে আসতো, বাকি সময় তালা লাগানো থাকতো।বাড়ির মালিক জানান, প্রায় মাস খানেক বাসাটি খালি থাকার পর সপ্তাহ দুই আগে ‘নাফিজ’ এসে ভাড়া পরিশোধ করেন।বাসা ভাড়া নেওয়ার সময় নাফিজ একটি মোটর সাইকেল নিয়ে এলেও পরে আর সেটি দেখা যায়নি বলে জানান ইছহাক।তিনি জানান, নাফিজ এমনিতে আশপাশের কারও সঙ্গে কথা বলতেন না। তার বাসায়ও বাইরের লোক তেমন একটা আসত না।মাস খানেক আগে ২৫/২৬ বছর বয়সী এক যুবক ওই বাসায় এলে তাকে ‘নাফিজ’ চাচত ভাই এবং বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী বলে পরিচয় দিয়েছিলেন। গোয়েন্দা কর্মকর্তা বাবুল বলেন, ফারদিন পরিচয় গোপন করে নাফিজ নামে বাসাটি ভাড়া নিয়েছিলেন। পুলিশ তাকে খুঁজছে।