দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ২৪ ডিসেম্বর ২০১৫: রাজধানীর মিরপুরে-১ নম্বও সেকশনে জঙ্গি আস্তানা সন্দেহে ছয়তলার ভবনের একটি ফ্ল্যাটে মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) সদস্যরা অভিযান চালিয়েছেন। বুধবার গভীর রাত থেকে বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে চারটা পর্যন্ত এ অভিযান চলে। ওই ফ্ল্যাট থেকে সাতজনকে আটক করা হয়েছে।এঁদের মধ্যে তিনজন নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) সদস্য বলে পুলিশের দাবি। অন্যরা সন্দেহভাজন। আটককৃতদের মধ্যে তিনজন জেএমবি’র উচ্চ পর্যায়ের নেতা বলে জানিয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বলেছে, বাকি চারজনকে সন্দেহভাজন হিসেবে আটক করা হয়েছে। তারা হচ্ছেন- বিইউবিএটিএ’র চতুর্থ বর্ষের দুই ছাত্র নাহিদ ও মামুন, নাহিদের ভাগ্নে পিলখানা সদর দফতরের সীমান্ত স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাদশ শ্রেণীর ছাত্র রাজ এবং একটি অনলাইনের এইচআর-মার্কেটিংয়ের কর্মী রাসেল। রাজধানীর শাহ আলী থানার মিরপুর-১ এলাকার একটি ভবনে জেএমবি’র আস্তানায় অভিযান সমাপ্ত ঘোষণা করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। এ সময় ১৮টি গ্রেনেড-বোমা ও বিপুল পরিমাণে বিস্ফোরক উদ্ধার করা হয়।
ধারণা করা হচ্ছে, আস্তানাটি নিষিদ্ধ ঘোষিত জামায়াতুল মুজাহেদিনের (জেএমবি) গ্রেনেড- বোমা তৈরির কারখানা ছিল এবং সাম্প্রতিককালের সবগুলো জঙ্গি হামলায় ব্যবহৃত গ্রেনেড-বোমা এখান থেকেই সরবরাহ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। তবে আটকের আগে ছয়তলা ওই ভবনটি বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেয় জঙ্গিরা। এমনকি দু’টি গ্রেনেডের বিস্ফোরণও ঘটান তারা। সেখানে প্রচুর গ্রেনেড পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। অভিযানে নেতৃত্ব দেন ডিবির অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) ছানোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, বুধবার সন্ধ্যায় এক জেএমবি সদস্যকে গ্রেপ্তার করে ডিবি। তাঁর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, মিরপুর-১ নম্বর শাহআলী থানাধীন এ ব্লকের ৯ নম্বর সড়কের ৩ নম্বর বাড়িতে অভিযান শুরু করে পুলিশ। দিবাগত রাত তিনটার দিকে পুলিশ ওই ফ্ল্যাটে গেলে ভেতর থেকে দরজা খোলা হচ্ছিল না। এ সময় পুলিশ ভবনের ভেতর ও বাইরে অবস্থান নেয়। ফজরের আজানের পর পুলিশ এ বাড়ির সব লোকজনকে সরিয়ে দেয়। সকাল সাতটার দিকে ওই ফ্ল্যাটের দরজা ভেঙে পুলিশ ভেতরে ঢোকে। সেখান থেকে জেএমবির তিন সদস্যকে ও পাশের ফ্ল্যাট থেকে সন্দেহভাজন হিসেবে চারজনকে আটক করা হয়। ওই ফ্ল্যাটে প্রচুর গ্রেনেড ও বিস্ফোরক দ্রব্য পাওয়া গেছে। সেগুলো নিষ্ক্রিয় করা হয়।ঢাকার মিরপুরে একটি ছয়তলা ভবন ঘিরে রেখে সন্দেহভাজন জেএমবি সদস্যদের এক আস্তানায় দীর্ঘ সময় ধরে অভিযান চালায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
বৃহস্পতিবার ভোর রাত থেকে এই অভিযানে ‘বিপুল পরিমাণ’ বিস্ফোরক এবং কয়েকটি সুইসাইড ভেস্ট পাওয়া গেছে। নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনটির অন্তত তিনজন ‘গুরুত্বপূর্ণ’ সদস্যসহ মোট সাতজনকে আটক করার কথা জানিয়েছে পুলিশ। পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (গণমাধ্যম) জাহাঙ্গীর আলম জানান, আগের রাতে এক জেএমবি সদস্যকে গ্রেপ্তারের পর তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে শাহ আলী থানার ৯ নম্বর রোডের এ ব্লকের ওই বাড়িতে অভিযান চালানো হয়।
পুলিশের সঙ্গে র্যাব ও সোয়াট ইউনিটের সদস্যরা এ অভিযানে অংশ নেন। ওই বাড়ির ছয় তলার একটি ফ্ল্যাটে এক ডজনের বেশি হাতে তৈরি গ্রেনেড পাওয়ার পর পুলিশের বোমা নিষ্ক্রিকরণ ইউনিটের সদস্যরা পাশের একটি খালি জায়গায় সেগুলো নিষ্ক্রিয় করেন। দুপুরেও ভবনটির বাইরে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ও আইনশৃঙ্খল বাহিনীর বিপুল সংখ্যক সদস্যকে অবস্থান নিয়ে থাকতে দেখা যায়।ঘটনাস্থলে উপস্থিত মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি টের পেয়ে ভবনের ভেতর থেকে গ্রেনেডের বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এতে জানালার কাচ ভেঙে যায়। জবাবে পুলিশও গুলি করতে বাধ্য হয়।ভবনের অন্য বাসিন্দাদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার পরই সেখানে অভিযান চালানো হয় বলে জানান তিনি।আটকদের বয়স ২০ থেকে ৩৫ এর মধ্যে জানিয়ে তিনি মনিরুল বলেন, এদের মধ্যে অন্তত তিনজন জেমএবির গুরুত্বপূর্ণ নেতা। জিজ্ঞাসাবাদ করে বাকিদের পরিচয় জানা যাবে।
তিনি জানান, আটকদের ডিবি কার্যালয়ে নেওয়া হয়েছে। সাতজনের মধ্যে ছয়জনকে পাওয়া গেছে ওই ভবনের ছয় তলায়। আর বাকি একজনকে রাতেই বিস্ফোরকসহ গ্রেপ্তার করা হয়।এক প্রশ্নের জবাবে পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, হোসাইনী দালান, কামরাঙ্গীর চরসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে এর আগে যে ধরনের হাতে তৈরি গ্রেনেড উদ্ধার করা হয়েছিল, এই ভবনের বিস্ফোরকগুলোও সেরকম।পুলিশের বোমা নিষ্ক্রিকরণ ইউনিটের প্রধান পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার ছানোয়ার হোসেন বলেন, ছয়তলার পাশাপাশি দুটি ফ্ল্যাটে অভিযান চালানো হয়। একটি ফ্ল্যাট থেকে বিস্ফোরকসহ দুইজনকে আটক করা হয়। সেখানেই রান্না ঘরে, লোহার ট্রাঙ্ক এবং কাপড়ে প্যাঁচানো অবস্থায়ও বিস্ফোরকগুলো পাওয়া যায়।আর পাশের ফ্ল্যাট থেকে আটক বাকি চারজনের পরিচয় জানার চেষ্টা চলছে বলে এই পুলিশ কর্মকর্তা জানান।বাড়ির মালিকের বরাত দিয়ে ছানোয়ার বলেন, আটকরা চারমাস আগে ছয়তলার ফ্ল্যাটটি ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করে। ভাড়া নেওয়ার সময় তারা নিজেদের স্থানীয় একটি কলেজের ছাত্র হিসেবে পরিচয় দিয়েছিল।
এরা ওই বাসায় গ্রেনেড বানানোর কাজ করত বলে প্রাথমিকভাবে আমরা ধারণা করছি, বলেন তিনি। ছয়তলা ভবনের কয়েকজন বাসিন্দা জানান, রাত একটার দিকে ডিবির সদস্যরা এ বাড়িতে আসে। অভিযানের সময় তাঁরা রাত থেকে কয়েক দফায় বিস্ফোরণের শব্দ শোনতে পায়। রাতেই পুলিশ তিন যুবককে ধরে নিয়ে যায়। আর আজ সকাল ১০টার দিক চারজনকে নিয়ে যায়।ওই বাড়ির একজন বাসিন্দা জানান, তিন মাস আগে ওই বাসায় মেস ভাড়া শুরু হয়। েেবশ কয়েকজন যুবককে তাঁরা আসা-যাওয়া করতে দেখেছেন। তবে তাঁরা কী করতেন, তা জানেন না।একজন প্রত্যক্ষদর্শী দাবি করেন, পুলিশ ফ্ল্যাটে ঢুকতে তাঁদের সঙ্গে গেলে ধ্বস্তাধ্বস্তির ঘটনা ঘটে। একপর্যায়ে পুলিশ ভেতরে ঢুকতে সক্ষম হলেও ওই যুবকেরা বিস্ফোরণ ঘটায়। এ সময় পুলিশ তিনজনকে ধরে ফেললে অন্যরা পাশের কক্ষে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেয়।এ ঘটনায় উৎসুক জনতা ওই বাড়ির সামনে ভিড় করে। এতে ওই সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে পড়লে এর প্রভাব অন্যান্য সড়কে ছড়িয়ে পড়ে। বেলা একটার দিকে পুলিশ ওই বাড়ির সামনে থেকে সবাইকে সরিয়ে দেয় বৃহস্পতিবার ভোররাত থেকে মিরপুর-১ সেকশনে ব্লক এ’র নয় নম্বর বাসায় এ অভিযান চালানো হয়। র্যাব, পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগের ৫টি দলের কয়েকশ’ সদস্য বিকেল চারটা পর্যন্ত এ অভিযান চালান।
বাড়িটি ঘুরে এসে মনিরুল ইসলাম জানান, আস্তানাটিতে লেদ মেশিনসহ গ্রেনেড-বোমা তৈরির সকল উপকরণ পাওয়া গেছে। সেখানে যে পরিমাণ বিস্ফোরক উদ্ধার করা হয়েছে, তা দিয়ে ২০০টি গ্রেনেড-বোমা তৈরি করা সম্ভব। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, হোসনি দালানসহ সাম্প্রতিককালের বোমা-গ্রেনেড হামলার ঘটনায় ব্যবহৃত গ্রেনেড এখান থেকেই সরবরাহ করা হয় বলে ধারণা করা হচ্ছে। সেসব বোমা-গ্রেনেডের উপকরণের সঙ্গে এখানকার বিস্ফোরকের হুবহু মিল রয়েছে। অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের প্রধান এডিসি সরোয়ার হোসেন জানান, উদ্ধার করা ১৮টির মধ্যে ১৭টি গ্রেনেড ও একটি পাইপ বোমা। সেগুলো নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে।তিনি জানান, হোসনি দালানের ঘটনায় সম্পৃক্ত সন্দেহে বুধবার (২৩ ডিসেম্বর) একজনকে আটক করা হয়। তার কাছ থেকে তথ্য পেয়ে ভোররাত থেকে আমরা ওই বাসায় অভিযান চালাই।আমরা জানতে পারি, ওই বাসায় গ্রেনেড তৈরি করা হয়। ভোর থেকে অভিযান চললেও প্রথমে আমরা বাসায় ঢুকতে পারিনি। এরপর সকাল ৭টার দিকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সম্মিলিত চেষ্টায় আমরা প্রথমে তিনজনকে আটক করি। এরপর আটক করা হয় আরও চারজনকে।তিনি বলেন, ওই বাসার ছয়তলায় পাশাপাশি দু’টি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকতেন তারা। চারমাস আগে ছাত্র পরিচয়ে তারা ফ্ল্যাট দু’টি ভাড়া নেন। একটি ফ্ল্যাটে তিনজন ও অন্য ফ্ল্যাটে চারজন থাকতেন। এখানেই বোমা বানানোর কার্যক্রম চলতো।অভিযানে দুই ফ্ল্যাটের বাথরুম, রান্নাঘর, ট্রাঙ্কসহ বিভিন্ন স্থান থেকে ১৬টি গ্রেনেডভর্তি একটি বস্তা, ফেলে রাখা একটি গ্রেনেড, একটি পাইপ বোমা ও বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক উদ্ধার করা হয়েছে। গ্রেনেড-বোমাগুলো নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে। অভিযানে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে ১০ রাউন্ড রাবার বুলেট ও ২টি টিয়ারশেল ব্যবহার করা হয়েছে বলেও তিনি জানান।ডিবি’র যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, আটককৃদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বর্তমানে জেএমবি’র দু’টি গ্র“প কাজ করছে। আটককৃতরা শিবিরের সাবেক ক্যাডার ও সায়েদুর রহমানের দলটি ছাড়া অন্য যেটি কাজ করছে এর সদস্য।আটককৃতদের কাছ থেকে একাধিক পরিচয়পত্র পাওয়া গেছে বলেও তিনি জানান।তিনি আরও বলেন, ওই বাসার অন্য ফ্ল্যাটেও কোনো জঙ্গি সম্পৃক্ততা রয়েছে কি-না তা খতিয়ে দেখতে দিনভর অভিযান চালানো হয়। নাশকতার আশঙ্কায় অভিযান চলাকালে বাসাটির আশে-পাশের স্থানীয়দের সরিয়ে নেওয়া হয়। অভিযানের শুরুতে বাসায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ঢোকার চেষ্টা করলে বোমা মেরে বাসা উড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেয় জঙ্গিরা। এক পর্যায়ে দু’টি গ্রেনেডের বিস্ফোরণও ঘটান তারা। তবে এতে হতাহতের কোনো ঘটনা ঘটেনি।