দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ২৬ নভেম্বর ২০১৫: সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বলছে,২০২৪ সালের মধ্যে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হতে পারবে না। অর্থাৎ ওই সময়ের আগে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পাবে না বলেই সংস্থাটির পর্যবেক্ষণ। সিপিডির সম্মানিত ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, ২০২৪ সালের মধ্যে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় যেতে যে তিনটি ক্যাটাগরি পূরণ করতে হয়, তা পূরণ করা অসম্ভব।বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর সিরডাপ অডিটোরিয়ামে আংকটাডের ‘দ্য লিস্ট ডেভলপমেন্ট কান্ট্রিস রিপোর্ট-২০১৫’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন দেবপ্রিয়।
এই সংবাদ সম্মেলনে গবেষণা পত্র উপস্থাপন করেন সিপিডির গবেষক তৌফিকুল ইসলাম খান, পরিচালক আনিসাতুল ফাতেমা ইউসুফ, পরিচালক ফাহমিদা খাতুন এবং অতিরিক্ত গবেষনা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রমুখ।ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হতে তিনটি ক্যাটাগরি তথা মাথাপিছু আয়, মানব সূচক উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক ঝুঁকি পূরণ করতে হবে। এই তিনটির মধ্যে বাংলাদেশ শুধু অর্থনৈতিক ঝুঁকি সংশ্লিষ্ট ক্যাটাগরি পার করেছে। মাথাপিছু আয়ের দিক থেকে স্বল্পোন্নত ৪৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ নিচের দিক থেকে দ্বিতীয়। আর মানব সূচক উন্নয়নের ক্ষেত্রে ৬৩.৮ শতাংশ পয়েন্ট অর্জন করেছে বাংলাদেশ।
তিনি আরো বলেন, তিন ক্যাটাগরির মধ্যে দুটি ক্যাটাগরি পূরণ করতে পারলে সেই দেশকে তিন বছর পর্যালোচনার মধ্যে রাখা হবে। তারপর সেই দেশ সেই অবস্থানে থাকলে এবং বাকি একটি ক্যাটাগরি পূরণ করতে পারলে তাকে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের করে দেয়া হবে। সেই অনুযায়ী বলা যায়, ২০২৪ সালের মধ্যে এই তালিকা থেকে বের হওয়া অসম্ভব।উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেতে করণীয় সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, প্রথমে সরকারকে উত্তরণ পূর্ব ও উত্তরণ-উত্তর পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। কেননা গৎবাধা পরিকল্পনা নিয়ে এই তালিকা থেকে বের হয়ে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় প্রবেশ করা যাবে না। এজন্য প্রথমে মানব সম্পদ উন্নয়নে গুরুত্ব দিতে হবে। এই মানব সম্পদ উন্নয়নে জোর দিলে আরো দুটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় জোর দেয়া সম্ভব হবে। তাহলো কৃষি ব্যবস্থা এবং গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন।
তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশ কৃষি ভূমি উৎপাদনে এক নম্বরে, কিন্তু শ্রমের উৎপাদনশীলতায় সবার থেকে পিছিয়ে। শ্রমের উৎপাদনশীলতার দিকে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে আমরা ৪৮তম। তাই কোন দেশ কৃষি উৎপাদনে উন্নয়ন ছাড়া উন্নত দেশে পরিণত হতে পারে না। সেই দিক থেকে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে।মধ্যম আয়ের দেশই সব কিছু নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, এইসব ক্যাটাগরি করা হয় শুধু আয়ের দিক থেকে। কিন্তু স্বল্পোন্নত দেশ ও উন্নয়নশীল দেশের তালিকা হয় ওই তিন ক্যাটাগরির উত্তরণের মাধ্যমে। মাথাপিছু আয়ের দিক থেকে অনেক উন্নত দেশ আছে, যারা এখনো স্বল্পোন্নত দেশের তালিকার মধ্যে। তাই আমাদের মাথাপিছু আয়ের চিন্তা বাদ দিয়ে সামষ্টিগত উন্নয়নের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।বাংলাদেশ মানবসম্পদ উন্নয়নে নজর দিলে ২০২৪ সালে স্বল্পোন্নত থেকে ‘উন্নয়নশীল’ দেশের কাতারে উন্নীত হতে পারবে বলে জাতিসংঘের এক মূল্যায়নে বলা হয়েছে। সদ্য প্রকাশিত বাণিজ্য ও উন্নয়ন বিষয়ক জাতিসংঘ সম্মেলন (আংকটাড) ২০১৫ সালের প্রতিবেদনে এই মূল্যায়ন তুলে ধরা হয়।তবে এই বিষয়টির সঙ্গে বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থান নিম্ন মধ্যম আয়ের বিষয়টিকে গুলিয়ে না ফেলতে আহ্বান জানিয়েছে সিপিডি।
স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে ইকোয়াটরিয়াল গিনিয়ার মতো দেশ রয়েছে, যার মাথাপিছু আয় ১৬ হাজার ৮৯ ডলার। এলডিসি থেকে উত্তরণের বিষয়টি অন্য আরও সূচকের উপর নির্ভরশীল, বলেন সংস্থাটির সম্মানীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।এলডিসি থেকে উত্তরণের জন্য আয়, মানব সম্পদ সূচক ও অর্থনৈতিক ঝুঁকি সূচক (ইভিআই)- এই তিনটি শর্তের মধ্যে অন্তত দুটি পূরণ করতে হবে।তবে প্রতিবেশী দেশ নেপাল ও ভুটান এর মধ্যেই এলডিসি থেকে বের হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় দুটি শর্ত পূরণ করেছে বলে প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে।প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশ এর মধ্যেই ইভিআই শর্ত পূরণ করেছে এবং মানব সম্পদ সূচকের শর্ত অর্জনের কাছাকাছি রয়েছে।
মাথাপিছু আয় দেখানো হয়েছে ৯২৬ ডলার, যা একহাজার ২৪২ ডলারের প্রয়োজনীয় আয়সূচকের অনেক নিচে রয়েছে।জাতিসংঘের ত্রিবার্ষিক এই প্রতিবেদনে আগের তিন বছরের মাথাপিছু আয়কে গড় করে দেখানো হয়। সে হিসেবে বাংলাদেশের বর্তমান মাথাপিছু আয় একহাজার ১০০ ডলার হলেও আগের তিন বছরের গড় হিসেবে মাথাপিছু আয় ৯২৬ ডলার দেখানো হয়েছে।২০১৮ সালে পরবর্তী প্রতিবেদনে ২০১৫, ২০১৬, ও ২০১৭ সালের পরিসংখ্যান ব্যবহার করা হবে।আংকটাড প্রতিবেদন উপস্থাপনের সময় সিপিডির গবেষণা ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, এই (২০১৫) প্রতিবেদনে আমরা এর মধ্যেই একটি শর্ত পূরণ করেছি। মানবসম্পদ সূচকের শর্তও ২০১৮ সালের মধ্যে সহজেই পূরণ হবে। কোনো দেশ পর পর দুটি প্রতিবেদনের মূল্যায়নে তিন শর্তের মধ্যে অন্তত দুটি পূরণ করলেই স্বাভাবিকভাবে এলডিসির মর্যাদা থেকে উত্তরণের যোগ্যতা অর্জন করে।সিপিডির এই গবেষক বলেন, বাংলাদেশ এর মধ্যে দুটি শর্ত পূরণ করলে ২০২১ সালের প্রতিবেদনে মানোন্নয়নের তালিকায় থাকবে।
পরবর্তী তিন বছর পর্যবেক্ষণের আওতায় থাকবে। এভাবে ২০২৪ সালের মধ্যে চূড়ান্ত উত্তরণ ঘটবে।তবে চূড়ান্ত উত্তরণ ঘটার পরও যে কোনো দেশ আরও তিন বছর স্বল্পোন্নত দেশের সুবিধা পাবে বলে জানান তিনি।স্বল্পোন্নত দেশগুলো উন্নত বিশ্বের বাজারে শুল্কমুক্ত সুবিধা, কারিগরি সহযোগিতা ও আন্তর্জাতিক চুক্তিতে নমনীয়তার সুবিধা ভোগ করে।মানবসম্পদ সূচক উন্নয়নের জন্য স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর পরামর্শ দেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।লক্ষ্যমাত্রার জন্য নির্ধারিত সময় ২০২১ সালের আগেই বাংলাদেশ নিম্ন-মধ্যম-আয়ের দেশে রূপান্তরিত হওয়ায় কোনো কোনো রাজনৈতিক নেতা এর মধ্যেই বলতে শুরু করেছেন, ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ ‘উচ্চ মধ্যম-আয়ের দেশে পরিণত হবে।
দেবপ্রিয় বলেন, ২০২১ সালের মধ্যে নিম্ন-মধ্যম-আয়ের দেশে রূপান্তরিত হওয়ার বিষয়টি স্লোগান হিসেবে ভাল। কিন্তু বাস্তবসম্মত নয়।কারণ ওই সময়ের মধ্যে নিম্ন-মধ্যম-আয়ের দেশে রূপান্তরিত হতে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় প্রায় চারগুণ বাড়িয়ে চার হাজার ১২৫ ডলারে নিতে হবে বলে জানান তিনি।প্রতিবেদনে দেখা যায়, কৃষি জমির উৎপাদনশীলতার ক্ষেত্রে তালিকার শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু কৃষিশ্রমের উৎপাদনশীলতার বিংশতিতম অবস্থানে রয়েছে।
দেবপ্রিয় বলেন, এর অর্থ হল আমরা জমির সদ্ব্যবহার করছি, কিন্তু কৃষকের উৎপাদনশীলতা আরও বাড়াতে হবে। এই বিষয়ে উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে।কৃষিক্ষেত্রে রূপান্তর ছাড়া পৃথিবীর কোনো দেশ উচ্চ আয়ের দেশ হতে পারেনি।মাত্র চারটি দেশের এলডিসি মর্যাদা থেকে উন্নয়ন ঘটেছে; ১৯৯৪ সালে বতসোয়ানা, ২০০৭ সালে কেপ ভার্দ, ২০১১ সালে মালদ্বীপ ও ২০১৪ সালে সামোয়া।এখন জাতিসংঘের এলডিসির তালিকায় ৪৮টি দেশ রয়েছে। এগুলোর মধ্যে যোগ্যতা অর্জন করায় ইকোয়াটরিয়াল গিনিয়াকে ২০১৭ সালের জুনে এবং ভানুয়াতুকে একই বছরেরর ডিসেম্বরে এলডিসির তালিকা থেকে বের করে নেওয়ার কথা রয়েছে।