দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ৩ নভেম্বর ২০১৫: দলীয়ভাবে স্থানীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে ভোট পড়ার হার কমে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন নির্বাচন কমিশন (ইসি) কর্মকর্তারা৷ তাদের মতে, ব্যালট পেপার ব্যবস্থাপনায় সময় বেশি লাগার কারণেই এমন অবস্থার সৃষ্টি হবে৷ সরকার ইতোমধ্যে স্থানীয় নির্বাচন দলীয়ভাবে সম্পন্ন করার জন্য অনুমোদন দিয়েছে৷ আগামী সংসদ অধিবেশনেই তা আইন আকারে পাশ করা হতে পারে৷ হয়েছে অধ্যাদেশও৷ তবে টেকনিক্যাল সমস্যায় পড়তে পারে কমিশন৷ কেননা, ব্যালট পেপার অনেক লম্বা আকৃতির হওয়ায় তা ভোটারদের সরবরাহকরণে বেশি সময়ের প্রয়োজন হবে৷ অন্যদিকে ভোটারদের ভোট দিতেও সময় বেশি লাগবে৷ দলীয়ভাবে পৌরসভা নির্বাচন অনুষ্ঠানে স্থানীয় সরকার ( পৌরসভা) (সংশোধন) অধ্যাদেশের গেজেট জারি করেছে আইন মন্ত্রণালয়৷ সোমবার এ অধ্যাদেশ জারি করেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ৷মঙ্গলবার লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগের সচিব মোহাম্মদ শহিদুল হক এ সংক্রান্ত গেজেট প্রকাশ করেন৷এ অধ্যাদেশের ফলে আসন্ন পৌরসভা নির্বাচন দলভিত্তিক হওয়ার সুযোগ তৈরি হল৷ আর দলীয় প্রতীকে দল মনোনীত প্রার্থীরা অংশ নেবে৷ স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নির্ধারিত প্রতীকে অংশ নেবে৷অধ্যাদেশে বিদ্যমান আইনের ২নং ধারায় নতুন দফায় সংসদ নির্বাচনের মতো গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর বিষয়ে সংজ্ঞা যুক্ত করা হয়েছে৷ সেই সঙ্গে ২০ নং ধারায় পৌরসভায় মেয়র ও কাউন্সিলর পদে রাজনৈতিক দল মনোনীত প্রার্থী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিধানটি যুক্ত হয়েছে৷ইসি কর্মকর্তারা জানান, অধ্যাদেশ নিয়ে পরবর্তী বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে কমিশন সভা আহ্বান করবে ইসি৷ এতে বিধিমালা চূড়ান্ত ও ভোটের তারিখ নিয়ে পর্যালোচনা করা হবে৷
নির্বাচন কমিশন এ অধ্যাদেশের সঙ্গে সমন্বয় রেখে নির্বাচন পরিচালনা বিধিমালা ও আচরণ বিধিমালা প্রণয়ন করবে৷ইসি সচিব মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, আমাদের প্রস্তুতি রয়েছে৷ এখন দ্রুততার সঙ্গে বিধিমালা চূড়ান্ত করে ভেটিংয়ের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়৷ নতুন সংশোধিত বিধিমালার আলোকে দলভিত্তিক পৌরসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে৷আগামী ডিসেম্বরে পৌরসভা নির্বাচন এবং ২৯ মার্চের মধ্যে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের পরিকল্পনা আছে ইসি’র৷ দেশে বর্তমানে পৌরসভার সংখ্যা ৩২৩টি আর ইউপির সংখ্যা সাড়ে চার হাজার৷ এক্ষেত্রে পৌরসভায় ১৩টি পদের বিরপীতে ৪০টি দল ও স্বতন্ত্র প্রার্থী অংশ নিলে ব্যালট পেপারের আয়তন হবে প্রায় এক মিটারের মতো৷ যা ভোটকেন্দ্রে সরবরাহ করা কঠিন হয়ে পড়বে৷ এতে ভোটাদের লাইনে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে৷ ইউপির ক্ষেত্রে এই পরিস্থিতি আরও মারাত্মক আকার নিতে পারে৷ কেননা, ইউপিতে ভোটার বেশি৷ ফলে অনেকেই ভোট না দিয়েই চলে যেতে পারেন৷ অন্যদিকে, এতোগুলো পদের জন্য ব্যালটে সিল মেরে তা ভাঁজ করতেও অনেক সময় লাগবে৷ আবার সিল মারার পর ভাঁজ করতে গিয়ে ভোট নষ্টও হতে পারে বেশি৷
কর্মকর্তাদের মতে, একদিকে সময় যেমন বেশি লাগবে অন্যদিকে ভোট নষ্ট হওয়ার হারও বেড়ে যাবে৷ বর্তমানে সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে ভোট নেওয়া হয়৷ দলীয়ভাবে নির্বাচন হলে এ সময়ের মধ্যে ব্যালট ও ভোটার ম্যানেজমেন্ট অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে৷ইসির উপ-সচিব পর্যায়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, এক্ষেত্রে ভোটারদের সঠিকভাবে ভোটদান পদ্ধতিও শেখাতে হবে৷ এর জন্যও ইসির লোকবল প্রয়োজন পড়বে বেশি৷ তাই এখন থেকেই বিষয়টি নিয়ে পরিকল্পনা করতে হবে, ভাবতে হবে আরও৷
নির্বাচন কমিশনার মো. আব্দুল মোবারক বলেন, আইন হলে সেভাবেই আমরা প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেবো৷ বিষয়টি নিয়ে আগেভাগে কিছুই বলা যাচ্ছে না৷ স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয়ভাবে করতে আইন সংশোধনে মন্ত্রিসভায় প্রস্তাব পাসের প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি বলেছে, সরকারের এই উদ্যোগের উদ্দেশ্য নিজেদের নেতাদের জিতিয়ে আনা৷বিএনপির মুখপাত্র আসাদুজ্জামান রিপন বলেন, বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরা মামলা-হামলার শিকার৷ তারা হুলিয়া নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন৷ এমন একটা প্রেক্ষাপটে যদি দলীয়ভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হয়, তাহলে সেই নির্বাচনে বিরোধী দলের প্রার্থীর পক্ষে নেতা-কর্মীদের কাজ করা কিংবা অংশগ্রহণ করা সম্ভব হবে না৷সরকার বিষয়টি বুঝতে পেরে, বিরোধী দলকে রাজনীতি ও নির্বাচনী ময়দান থেকে দূরে সরিয়ে রেখে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মতো একই পদ্ধতিতে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করতে চাচ্ছে৷ইউনিয়ন পরিষদ এবং পৌরসভা নির্বাচনের আগেই স্থানীয় সরকার আইন পরিবর্তনের এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে; যদিও আওয়ামী লীগ নেতারা আগেই এর পক্ষে অবস্থান জানিয়ে আসছিলেন৷রিপন বলেন, তারা নিজেদের প্রতিনিধিদের নির্বাচিত করে বিদেশিদের বোঝাতে সচেষ্ট হবেন যে তাদের সরকার ও দলের পক্ষে জনগণের সমর্থন রয়েছে৷ এটি একটি মেকি কৌশল৷ এই মেকি কৌশলের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের সংকট থেকে উত্তরণ হবে না৷তিনি স্থানীয় সরকার আইন সংশোধন না করে নির্দলীয়ভাবে নির্বাচনের বর্তমান পদ্ধতি চালু রাখতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান৷স্থানীয় সরকারের বিষয়টি জনগুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় আমরা দাবি করেছিলাম যেন সংশ্লিষ্ট সব মহলের মতামত যাচাই করা হয়৷ কিন্তু সরকার আমাদের দাবিকে পাশ কাটিয়ে একগুয়েমি মনোভাব প্রদর্শন করে তড়িঘড়ি করে আজ এই সংক্রান্ত পাঁচটি আইনের সংশোধন প্রস্তাব মন্ত্রিসভায় অনুমোদন কেরেছে৷ আমরা এতে বিস্মিত হয়েছি৷নির্দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের দাবি পাশ কাটাতেও দলীয় প্রতীকে স্থানীয় নির্বাচনের এই উদ্যোগ বলে বিএনপির দাবি৷ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা, জেলা পরিষদ, সিটি করপোরেশন নির্বাচন আইন সংশোধনের প্রস্তাব মন্ত্রিসভায় চূড়ান্ত অনুমোদন হয়েছে৷রিপন অভিযোগ করে বলেন, এই আইন সংশোধন হলে তা জটিলতা তৈরি করবে৷
সরকার কিন্তু সব ইউনিয়ন পরিষদ ও উপজেলা নির্বাচন করছে না৷ যেসব প্রতিষ্ঠানের মেয়াদোত্তীর্ণ হয়নি, সেসব প্রতিষ্ঠানে নির্বাচিত মেয়র, চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান, কাউন্সিলর ও মেম্বারগণের পদে থাকা নিয়ে তখন প্রশ্ন উঠবে৷ কারণ এক দেশে দুটি আইন তখন চলবে৷এক আইনে দলীয় প্রতীক ছাড়া কিছু লোক নির্বাচিত হয়েছেন৷ আবার অধ্যাদেশ জারি হওয়া পরে নতুন আইনে দলীয় প্রতীক ও মনোনয়নে নির্বাচিত হবেন অন্যরা৷স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে নির্বাচিতদের মেয়াদ ফুরোনোর পর প্রশাসক নিয়োগের বিধানও স্থানীয় সরকারের চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে মন্তব্য করে রিপন৷ পরবর্তী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগে বা নতুনদের শপথ নেওয়ার আগ পর্যন্ত সংসদ সদস্যরা তাদের স্ব স্ব পদে বহাল থাকতে পারেন৷ কিন্তু মেয়াদোত্তীর্ণ হলে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে প্রশাসক নিয়োগের বিধান রাখা হয়েছে প্রস্তাবিত আইনে৷ এতে স্থানীয় সরকারে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি থাকার যে ধারাবাহিকতা সাংবিধানিকভাবে থাকার কথা, তা ক্ষুন্ন হবে বলে আমরা মনে করছি৷ আগামী ডিসেম্বরে সারা দেশের সব পৌরসভায় দলীয় প্রতীকে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিব মো. সিরাজুল ইসলাম৷মঙ্গলবার দুপুরে ইসি সচিবলায়ের নিজ কার্যালয়ে তিনি সাংবাদিকদের এ কথা জানান৷ইসি সচিব বলেন, দলীয় প্রতীকে পৌরসভা নির্বাচন করার অধ্যাদেশের গেজেট আমরা পেয়েছি৷ গেজেট পাওয়ার আগেই প্রার্থীদের আচরণ বিধিমালা এবং নির্বাচন বিধিমালার একটা খসড়া তৈরি করে রেখেছিলাম৷ এখন তা খুব দ্রুত চূড়ান্ত করা হবে৷
তিনি আরও বলেন, মেয়র, সাধারণ কাউন্সিলর ও মহিলা কাউন্সিলর- এই তিন পদেই দলীয় প্রতীকে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে৷ এতে করে ব্যালটের আকার অনেক বড় হয়ে যাবে৷ ব্যালট ভাঁজ করা, সিল মারাসহ পুরো প্রক্রিয়াতেই স্বাচ্ছন্দ্যের বিষয় আছে৷ এতে ভোটাররাও স্বচ্ছন্দ্য বোধ করবে না৷ তাই সরকারি প্রেসগুলোর সঙ্গে বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে-নির্বাচন এক দফায় হবে, নাকি কয়েক দফায় ভোটগ্রহণ করা হবে৷ পৌরসভা নির্বাচন দলীয় প্রতীকে করার জন্য সোমবার (২ নভেম্বর) অধ্যাদেশ জারি করেন রাষ্ট্রপতি৷ যার গেজেট প্রকাশিত হয় মঙ্গলবার (৩ নভেম্বর)৷ এরপরই তা সংগ্রহ করে নির্বাচন কমিশন৷ ডিসেম্বরে ২৪৫ পৌরসভায় নির্বাচন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে ইসি৷সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ইসি সচিব বলেন, খসড়া বিধিমালা দ্রুত চূড়ান্তের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিংয়ের জন্য পাঠানো হবে৷ তাদের অনুমোদন পেলেই আরেকটি প্রজ্ঞাপন করে নির্বাচন বিধিমালা ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালার সংশোধনী প্রকাশ করা হবে৷ এজন্য খুব বেশি সময় নেব না৷ কারণ, ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন করতে চাই৷ সে মোতাবেক আমরা আমাদের প্রস্তুতি নেবো৷স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বিষয়ে তিনি বলেন, অধ্যাদেশ অনুযায়ী, যাকে রাজনৈতিক দল মনোনয়ন দেয়নি, তাকেই স্বতন্ত্র প্রার্থী বোঝাবে৷ তাই স্বতন্ত্র হিসেবে যে কারো নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ রয়েছে৷ মো. সিরাজুল ইসলাম আরও বলেন, কিভাবে কে প্রার্থী হবে, তা আইনে বা অধ্যাদেশে থাকে না৷ এগুলো বিধিমালায় থাকে৷ বিধিমালা চূড়ান্ত হলেই আমরা জানাবো৷
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে এ নির্বাচনের সাদৃশ্য থাকবে৷ তবে পৌর নির্বাচন যেহেতু দলগুলোর একেবারে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাদের অংশগ্রহণে হয়, তাই দলের কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের মনোনয়ন দেওয়ার প্রয়োজন আছে, নাকি এজন্য তারা ডেলিগেট কবরেন, এটা বিবেচনায় বিষয় আছে৷বিদ্রোহী প্রার্থীদের বিষয়ে তিনি বলেন, যে কোনো রাজনৈতিক দল তার গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তাদের নেতা, সমর্থক, কর্মীকে নিয়ন্ত্রণ করবে৷ সেটা দলের বিষয়৷ এটা সরকারের বা ইসির ভাবনার বিষয় নয়৷ কেউ দলের সিদ্ধান্তের বাইরে কাজ করলে, কী অ্যাকশন হবে, তা দল ঠিক করবে৷নির্বাচনের জন্য বিধিমালা করবো, কাউকে সুবিধা বা অসুবিধা দেওয়ার জন্য নয়, একটি সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচন করার জন্য৷ তাই কারো জন্য এটি খড়গ হবে না, বলেন তিনি৷আইন সংশোধনের পর অধ্যাদেশে রাজনৈতিক দল বলতে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত কোনো দলকে বোঝানো হয়েছে৷ এছাড়া স্বতন্ত্র প্রার্থীর সংজ্ঞায় বলা হয়েছে-এরূপ কোনো প্রার্থী, যিনি কোনো রাজনৈতিক দল কর্তৃক মনোনয়নপ্রাপ্ত নন৷এছাড়া নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়ে অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, কোনো পৌরসভার মেয়র ও কাউন্সিলর পদে নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য কোনো ব্যক্তিকে কোনো রাজনৈতিক দল কর্তৃক মনোনীত বা স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে হবে৷