দৈনিকবার্তা-কলাপাড়া, ৩১ অক্টোবর ২০১৫: কুয়াকাটা সংলগ্ন গভীর বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকা এখন জেলেদের জন্য অনিরাপদ হয়ে পড়েছে। প্রত্যেক মাসেই ঘটছে গণডাকাতির ঘটনা। সেই সঙ্গে ট্রলার,জাল, জ¦ালানিসহ জেলেদের অপহরণের ঘটনা ঘটছে। জলদস্যুদের মুক্তিপণ গুনতে গুনতে পেশায় দেখা দিয়েছে ভয়াবহ অনিশ্চয়তা। জেলেরা সাহস পাচ্ছেন না সাগরে মাছ শিকার করার। নিঃস্ব হওয়া ট্রলার মালিক কিংবা জেলেরা পেশা বদলের শঙ্কায় রয়েছেন। মৎস্য বন্দর মহীপুর-আলীপুরে এখন জেলে, ট্রলার মালিকসহ এ পেশায় জড়িতরা রয়েছে ডাকাত আর মুক্তিপণ আতঙ্কে। এখনও ডাকাতের কাছে আটক কিংবা নিখোঁজ রয়েছে অন্তত ১২ জেলে। আলীপুর-মহীপুর মৎস্য বন্দর ব্যবসায়ীদের হিসাব মতে গত তিন মাসে গভীর সাগরবক্ষে অন্তত এক শ’ ট্রলার ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। অপহরণ করা হয়েছে ২০টি ট্রলারসহ প্রায় এক শ’ জন জেলে। লুট করা হয় কয়েক কোটি টাকার জাল-জ¦ালানি, মাছ, ট্রলারের মেশিন, মোবাইল সেট।
সর্বশেষ ২৭ অক্টোবর আলীপুরের আবুল কোম্পানির এফবি এলমা ট্রলারে ডাকাতরা হানা দেয়। সশস্ত্র ডাকাতদল ১৭ জেলের তিন জনকে ট্রলারসহ মুক্তিপণের দাবিতে অপহরণ করে নেয়। এরা হচ্ছে রুহুল আমীন মাঝি, মো. শুক্কুর আলী এবং মো. শানু মিয়া। বাকি তিন জেলে আল-আমিন, মো. নাইম ও বজলুর রহমানকে সাগরবক্ষে ফেলে দেয়। ১৩ অক্টোবর ডাকাতের গুলিতে জখম হয় জেলে ফয়সাল, আহসান আলী, শাহআলম ও কাইয়ুম। এ সময় ডাকাতরা এফ বি মার্জিয়া আক্তার রিমা ট্রলারসহ জেলে নয়া মিয়া, আল-আমিন, আবুল কালামকে মুক্তিপণের দাবিতে অপহরণ করে নিয়ে গেছে। এর মধ্যে দুই লাখ টাকা মুক্তিপণ শোধ করে ফিরে এসেছে নয়া মিয়া। ২৪ আগস্ট দুপুরে সাগরবক্ষে গণডাকাতি শেষে ডাকাতরা রাঙ্গাবালী উপজেলার এফবি তিমন ট্রলারের মাঝি লালচান ও এফবি মায়ের আশীর্বাদ ট্রলারের মাঝি মো.বশিরকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। এখন পর্যন্ত এই দু’জেলে ফিরে আসেনি।
আলীপুর মৎস্য বন্দরের এক আড়ত মালিক জানান, সাগরবক্ষে ডাকাতিকালে ডাকাতরা দয়াল, মজনু, মাস্টার, আলীফ, বাচ্চু, এনামুল বাহিনী নামে পরিচয় দেয়। এগুলো ছদ্ম নাম। মূলতঃ ডাকাতের পেছনে রয়েছে খুলনা-বাগেরহাটের প্রভাবশালী দু-একজন গডফাদার। এর মধ্যে খুলনার ফুলতলার দামোদর এলাকার বাচ্চু বেগ (কালা বাচ্চু) ওরফে ব্লাক তা অধিকাংশ জেলে কিংবা ট্রলার মালিকরা খোলামেলা বলে বেড়াচ্ছেন। জেলেরা এও জানান, বাচ্চু এখন ভারতে অবস্থান করছে। তবে তার সহযোগী রয়েছে খুলনার ডুমুরিয়ার এনামুল। এরা জলদস্যুতার কাজে ২৮০ হর্স শক্তির উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন ট্রলার ব্যবহার করছে।
মহিপুর মৎস্য আড়তদার ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সভাপতি মো. ফজলু গাজী জানান, এ বছর তিনবার ডাকাতির কবলে পড়ে জেলে এবং মৎস্য ব্যবসায়ীরা চরম লোকসানে পড়েছেন। তাছাড়া প্রত্যেক বছরই জলদস্যুদের মুক্তিপণের টাকা দিতে হচ্ছে। তারা এখন সাগরবক্ষকে অনিরাপদ হিসাবে চিহ্নিত করছেন। একই সমিতির সাধারণ সম্পাদক নিমাই চন্দ্র দাস জানান, সাগরে জলদস্যুতা কোনভাবেই বন্ধ হচ্ছে না। সাগরে মাছ ধরতে গেলে ডাকাতরা মুক্তিপনের দাবিতে অপহরণ করে নিয়ে যায়। এ অবস্থার অবসান না ঘটলে জেলেরা পেশা ছেড়ে দেবে, তাদেরও গুটাতে হবে ব্যবসা-বাণিজ্য।
কুয়াকাটা-আলীপুর মৎস্য আড়তদার ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সভাপতি মো. আনসার উদ্দিন মোল্লা জলদস্যুদের কবল থেকে ফিরে আসা জেলেদের উদ্ধৃতি দিয়ে জানান, মুক্তিপণের টাকা জলদস্যুর পাশাপাশি খুলনা এলাকার প্রশাসন, নেতাদের জন্য খরচ হয়। তিনি আরও জানান, সুন্দরবনের পরিবেশ রক্ষার্থে পশ্চিম অংশে যখন নৌযান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা থাকায় এখন ওই অঞ্চল জলদস্যুদের জন্য নিরাপদ আস্তানায় পরিণত হয়েছে। কলাপাড়া থানার ওসি মোহা. আজিজুর রহমান জানান, সাগরবক্ষে ডাকাতিগুলো সাধারণত খুলনা-বাগেরহাটের জলসীমানায় হয়ে থাকে। ডাকাতির শিকার হওয়া কলাপাড়া উপজেলার জেলেরা এসে জানালে সঙ্গে সঙ্গে আইনী পদক্ষেপ নেয়া হয়। একই সঙ্গে সংশি।লষ্ট এলাকার পুলিশ-কোষ্টগার্ডকে অবহিত করা হয়।
কোস্টগার্ড পশ্চিমাঞ্চলীয় জোনের স্টাফ অফিসার (অপারেশন) লেফটেনেন্ট কমান্ডার ফজলুল করিম জানান, জেলেরা সত্যিকারভাবে চিহ্নিত করে বলতে পারছে না, কোন জায়গায় নিয়ে জেলেদের আটকে রাখা হচ্ছে। অন্যদিকে যেসব জেলে মুক্তিপণ দিয়ে বের হয়ে আসে, তাঁরাও এসে আর মুখ খুলছেনা। তাঁরা তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করছে না। তিনি এও জানান, যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে জেলেদের আইডি কার্ড দেয়া হলে জেলে কে আর কে জলদস্যু তা চিহ্নিত করতে প্রশাসনের সুবিধা হতো।