দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ৩১ অক্টোবর ২০১৫: যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রশ্নবিদ্ধ করতে ও থামিয়ে দিতেই বিতর্কিত করা হচ্ছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের কার্যক্রমের অনুসন্ধান চালানো উচিত।এ মন্তব্য ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির আহ্বায়ক ড. এম এ হাসানের।শনিবার রাজধানীর স্পেক্ট্রা কনভেনশন সেন্টারে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় বাস্তবায়ন ও নিরাপত্তা’ বিষয়ে আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে তিনি একথা বলেন। গোলটেবিল বৈঠকটির আয়োজন করে রিজিওনাল অ্যান্টি টেরোরিস্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট (রাত্রি)।বৈঠকের শুরুতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন রাত্রি’র নির্বাহী পরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আলী শিকদার (অব.)। সঞ্চালনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষক অধ্যাপক ড. জিনাত হুদা অহিদ।
গোলটেবিল বৈঠকে আরও বক্তব্য দেন শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. একে আজাদ চৌধুরী, অধ্যাপক ড. মেসবাহ কামাল, অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান, অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবীর, মুক্তিযুদ্ধ বিয়ষক গবেষক ড. এমএ হাসান, সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও কূটনীতিক ওয়ালিউর রহমান, ইসলামি চিন্তাবিদ হাফেজ মাওলানা জিয়াউল হাসান, সাবেক মন্ত্রী কর্নেল (অব.) জাফর ইমাম বীরবিক্রম, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ, অ্যাডভোকেট এএম আমিনুদ্দিন, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ, ব্যারিস্টার আহসান হাবীব ভূঁইয়া ও রাত্রির নির্বাহী পরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আলী শিকদার।বৈঠকটির সঞ্চালনা করেন ড. জিনাত হুদা অহিদ। বৈঠকে বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদক নঈম নিজামও উপস্থিত ছিলেন।
মূল প্রবন্ধে যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচার ব্যবস্থা বিতর্কিত করা এবং দুই বিদেশি হত্যাকাণ্ডসহ দেশে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টার প্রতিবাদ করা হয়।একইসঙ্গে রায় বাস্তবায়ন ও সাক্ষীদের নিরাপত্তা নিয়েও সরকারের কাছে সুপারিশ তুলে ধরা হয়। ড. হাসান বলেন, অ্যামনেস্টি মহাসচিব আইরিন চলে যাওয়ার পর তারা কেনো এ ভূমিকায় গেলো তার অনুসন্ধান করা দরকার। এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক মেজবাহ কামাল বলেন, অ্যামনেস্টি ডলারের কাছে বিক্রি হয়ে গেছে, তাদের কার্যক্রম খতিয়ে দেখতে হবে। যুদ্ধাপরাধের বিচার কেনো এতো প্রয়োজন তা স্পষ্ট করা দরকার উল্লেখ করে ড. হাসান বলেন, আমরা বোঝাতে পারিনি, ন্যায় ও সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতেই এ বিচার।এই সরকার ক্ষমতায় না এলে বিচার হতো না। আর বর্তমান সরকার না থাকলে বিচারের রায় বাস্তবায়িত হবে কিনা- তা প্রশ্নসাপেক্ষ।তারা (যুদ্ধারাধী পক্ষ) লবিস্ট নিয়োগ করতে পারে, সরকার কি লবিস্ট নিয়োগ করতে পারে না? প্রশ্ন রাখেন ড. হাসান।
ড. হাসান বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের মিশনগুলোতে আলাপ-আলোচনা হয় যুদ্ধাপরাধী আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও মতিউর রহমান নিজামীর পক্ষে। তারা সরকার, বিচারব্যবস্থা ও রাষ্ট্রকে কোণঠাসা করতে চায়।কোণঠাসা করতে পারলেই বিচার হবে না।নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) মো. আবদুর রশীদ বলেন, বিদেশি হত্যাকাণ্ড, শিয়া সম্প্রদায়ের ওপর হামলার মাধ্যমে সরকারকে অস্থিতিশীল করে অসাংবিধানিক সরকারের ক্ষেত্র তৈরি চেষ্টা চলছে। এতে সহযোগিতা করছে উন্নয়ন সহযোগীরা।তিনি বলেন, দু’জন বিদেশিকে হত্যা করা হলো। হামলা করা হলো শিয়া সম্প্রদায়ের ওপর। এ হামলাগুলো আর কিছু না। এগুলো প্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্রের ওপর আক্রমণ।
আবদুর রশীদ বলেন, সরকারের ভেতরে যদি অস্থিরতা সৃষ্টি করা যায়, তবে অসাংবিধানিক সরকার উত্থানের ক্ষেত্র তৈরি হয়। উন্নয়ন সহযোগীদের সহযোগিতায় এ ধরনের ক্ষেত্র তৈরিতে চেষ্টা চলছে। এ বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে জীবনের নিরাপত্তা দিতে হবে। আর এজন্য যুদ্ধাপরাধীসহ বড় বড় অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনতেই হবে।তিনি বলেন, বাংলাদেশকে নিয়ে ষড়যন্ত্রের রাজনীতি চলছে। নিরাপত্তাকে জিম্মি করে চলছে এ রাজনীতি। নীরিহ মানুষকে হত্যা করে রাজনীতির নামে এ অপরাজনীতি বন্ধ করা দরকার।একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির বলেন, শুধু দুই একজন ব্যক্তির বিচার করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শেষ করলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। এক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধাপরাধ বা মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত দল ও সংগঠনগুলোরও বিচার দ্রুত করতে হবে।শাহরিয়ার কবির বলেন, জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের বিচার হবে আর জামায়াত বসে থাকবে তা ভাবার কোনো কারণ নেই। তারা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে লবিস্ট নিয়োগ করেছে। সে লবিস্ট নিয়োগের ফলেই অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতো সংগঠনগুলো একতরফা বক্তব্য দিচ্ছে।
তিনি বলেন, শুধু কয়েকজন মানুষের বিচার করে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শেষ করলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। এজন্য জামায়াতসহ যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত অন্য সংগঠনগুলোর বিচারও করতে হবে। এক্ষেত্রে দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনালকে পুনরুজ্জীবিত করতে হবে। পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদেরও বিচার করার দাবি জানান তিনি।শাহরিয়ার বলেন, আমাদের দেশের আইনে আমাদের দেশের অপরাধীর বিচার হচ্ছে। তা নিয়ে কোনো বিদেশি সংগঠন প্রশ্ন তুলতে পারে না। এ অধিকার তাদের নেই। এটা স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার ওপর হস্তক্ষেপ।অ্যামনেস্টির অবস্থান ফাঁসির বিরুদ্ধে। কিন্তু আমেরিকায় ফাঁসি হতে পারে আর আমাদের এখানে হলেই দোষ বলেও মন্তব্য করেন শাহরিয়ার কবির।সরকারকে এ বিষয়ে কথা বলতে হবে- এমন দাবি করে তিনি বলেন, বিজয়ীরা যা করবে তাই মেনে নিতে হবে- এমন চিন্তা পশ্চিমারাই আমাদের মাথায় ঢুকিয়েছে। সে অনুযায়ীই আমরাও বিচার করছি।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের বিরুদ্ধে সরকারকে ব্যবস্থা নিতে সংস্থাটির স্বচ্ছতা খতিয়ে দেখার আহ্বান জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মেজবাহ কামাল।তিনি বলেন, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ডলারের কাছে বিক্রি হয়ে গেছে। তারা এখন মানবাধিকারের ব্যবসা করে। তাদের বিরুদ্ধে কী করা যায় তা সরকারকে খতিয়ে দেখতে হবে।তিনি বলেন. ট্রাইব্যুন্যালকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হচ্ছে, সক্রিয় করা দরকার। ট্রাইব্যুনাল সম্প্রসারণ করে তৃণমূল পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া দরকার।সরকারের সমালোচনা করে মেজবাহ কামাল বলেন, যুদ্ধপরাধীরা বিদেশে লবিস্ট নিয়োগ করছে। সরকার কেন লবিস্ট নিয়োগ করতে পারছে না। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মুক্তিযুদ্ধে তাদের (যুদ্ধাপরাধী) ভূমিকাকে তুলে ধরতে হবে।যুদ্ধাপরাধ নিয়ে বিদেশে প্রচারণায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতার অভিযোগ তুলে মেজবাহ কামাল বলেন, পরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে আমরা সহযোগিতা করবো। এই ধরনের অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ জানান।বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সব বিদ্যাপীঠে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পড়ানো বাধ্যতামূলক করার দাবি জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক বলেন, যে বিষয়েই শিক্ষার্থীরা পড়ুক না কেন মুক্তিযুদ্ধের ইতহাস পড়াতে হবে। দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়কে মুক্তিযুদ্ধের গবেষণা ও আলোচনা কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।
সবশেষে মেজবাহ কামাল জামায়াত নিষিদ্ধের দাবি জানান। তিনি সরকারের কাছে প্রশ্ন রেখে বলেন, কেনো এখনও জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হচ্ছে না?আন্তর্জাতিক বিচারের মানের অনেক ওপরে উঠে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনালে বিচার করা হচ্ছে। এতে অভিযুক্ত জামিন দেওয়াসহ নানা সুবিধা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এরপরও এ বিচার প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে। যা করছে তিনটি সংগঠন ও একজন সাংবাদিক।
তুহিন আফরোজ বলেন, আমরা আন্তর্জাতিক মানের অনেক ওপরে উঠে এ বিচার কাজ সম্পন্ন করছি। অভিযুক্তদের অনেক সুযোগ-সুবিধা দিয়েছি। কাউকে কাউকে জামিনও দেওয়া হয়েছে। এছাড়া তারা সংবাদ সম্মেলন করার সুযোগ পেয়েছেন। পৃথিবীর আর কোনো আদালতে এমন সুযোগ দেওয়া হয়নি। অথচ এ বিচার প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। আর এ ষড়যন্ত্র করছে তিনটি সংগঠন ও একজন সাংবাদিক। সংগঠনগুলো হলো- অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও আল জাজিরা এবং ব্যক্তিটি হলেন- এদেশের প্রখ্যাত একজন আইনজীবীর মেয়ের জামাই।
তিনি বলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসি বাহিনীর অপরাধের জন্য ন্যূরেমবার্গ ট্রায়ালের মাধ্যমে বিচার করা হয়েছিলো। সেখানে নাৎসিদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ তারা আগে নাৎসি বাহিনীকে নির্মূল করেছেন, তারপর বলছেন, মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যাবে না। আমরাও আগে নির্মূল করবো, তারপর মৃত্যুদণ্ড তুলে দেবো।তুহিন আফরোজ বলেন, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল নব্য হানাদার বাহিনী ও রাজাকারে পরিণত হয়েছে। একাত্তরে রাজাকার, আলবদর, আলশামসরা যেভাবে কথা বলতো,সেই একই ভাষায় কথা বলছে সংগঠনটি। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের বিচারের কথা বলে ঔদ্ধত্য প্রদর্শনও করছে।তিনি বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। কিন্তু তারা কতোটা স্বচ্ছ? তারা তাদের ওয়েবসাইটে ডোনারদের নাম উল্লেখ করে না। কাদের টাকায় তারা সংগঠন চালায়?