দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ৩১ অক্টোবর ২০১৫: নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে পৃথকীকরণের সুফল পেতে দ্বৈত শাসন বিলোপে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে পৃথকীকরণ বিষয়ে পৃথকীকরণের আট বছর শীর্ষক এক মুক্ত আলোচনায় বক্তারা এ মত প্রকাশ করেন।মুক্ত আলোচনায় বক্তারা বলেন, বিচার বিভাগ পৃথক করা হলেও প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, লোকবল সঙ্কটসহ লজিষ্টিক সাপোর্টের বিষয়ে নির্বাহী বিভাগের ইচ্ছার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। এটাকে দ্বৈত ব্যবস্থা হিসেবে আখ্যা দেয় আলোচকগন।
বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ সংক্রান্ত মাসদার হোসেন মামলায় স্বীকৃত দ্বৈত শাসন সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকে আঘাত করেছে। দ্বৈত ব্যবস্থা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য প্রধান বাধা বলে মত দেয় বক্তারা। বক্তারা বলেন ৭২’এর সংবিধানে স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা বিভাগের বিষয়ে সুস্পস্ট ভাবে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু রাজনৈতিক সরকারগুলো স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠায় সদিচ্ছার প্রমান দিতে ব্যর্থ হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর মাসদার হোসেন মামলায় ১২ দফা নির্দেশনা বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে পৃথকীকরণের পথ উন্মুক্ত হয়। ওই রায় নিয়ে অনেক বক্তব্য থাকলেও তা স্বাধীন বিচার বিভাগের যাত্রায় ইতিবাচক বলে বক্তারা মূল্যায়ন করেন।
শনিবার জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে এমুক্ত আলোচনার আয়োজন করে স্বেচ্ছাসেবী মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যানিটি ফাউন্ডেশন। সংগঠনটির চেয়ারম্যান ড.এ আই মাহবুব উদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের সঞ্চালনায় আলোচনায় অংশ নেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন, বিচারপতি আমিরুল কবীর চৌধুরী, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার, সুপ্রিমকোর্ট বার-এর সাবেক সভাপতি এডভোকেট জয়নুল আবেদীন, সুপ্রিমকোর্টের সাবেক রেজিস্ট্রার ইকতেদার আহদেম, বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সহ-সভাপতি এডভোকেট আব্দুল বাসেত মজুমদার, হিউম্যানিটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক এডভোকেট মুহাম্মদ শফিকুর রহমান প্রমুখ।
আইনজীবী,সাংবাদিকসহ সংশ্লিষ্টরা এ মুক্ত আলোচনায় অংশ নেন।আলোচনায় ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন বলেন, গণতন্ত শক্তিশালী হলেই বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতের পথ তরান্বিত হয়। গণতন্ত্র রক্ষা না করা হলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, সুশাসন ও আইনের শাসন রক্ষা হয় না।বিচারপতি আমিরুল কবীর চৌধুরী বলেন, নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের বিষয় সংবিধানের মৌলিক নীতিতেই বলা হয়েছে। তা সত্বেও পৃথক করতে দীর্ঘ সময় লাগছে। নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ আলাদা বিষয়ে বর্তমান বাস্তবতার আলোকে তিনি বলেন, আকাশে ঘুড়ি উড়িয়ে দিয়ে নাটাই হাতে রেখে দেবো তা হতে পারে না।
৭২’ এর সংবিধানে ফিরে যেতে হলে পুরোপুরি ফিরে যেতে হবে উল্লেখ করে আলী ইমাম মজুমদার বলেন, বিচারক স্বাধীন থাকুন, স্বাধীনভাবে কাজ করুন। অন্যের ওপর নির্ভরশীল হলে কিংবা কোন চাপে পড়লে ন্যায়বিচার নাও হতে পারে। ব্যক্তির নিরাপত্তার জন্য আইনের শাসন ও স্বাধীন বিচার বিভাগ অপরিহার্য বলে মত দেন তিনি।এডভোকেট আবদুল বাসেত মজুমদার বলেন, বিচার বিভাগ পৃথক হলেও দ্বৈত শাসনের গ্যাঁড়াকলে অনেক সমস্যা প্রতিনিয়ত সৃষ্টি হচ্ছে। মানুষের সত্যিকারের বিচার পেতে হলে বিচারক ও আইনজীবী সবারই দায়িত্ব আছে। বিচার বিভাগের পৃথককীকরণের পথ আরো অনেক বাকি আছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এডভোকেট জয়নুল আবেদীন বলেন, মাসদার হোসেন মামলার মূল স্পিরিট বাস্তবায়িত হচ্ছেনা। বিচারকরা প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছেন কি-না, তা দেখতে হবে। দ্বৈত শাসন জুডিশিয়ারিতে থাকতে পারে না।হিউম্যানিটি ফাউন্ডেশনের আয়োজনে মুক্ত আলোচনায় ‘বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের আরো অনেক পথ বাকি’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সংবিধান ও আইন বিশ্লেষক প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক মিজানুর রহমান খান। প্রবন্ধে তিনি বলেন, মাসদার হোসেন মামলার মাধ্যমে অধ:স্তন আদালতে যে দ্বৈত শাসন ব্যবস্থাকে মেনে নেয়া হয়েছে তা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকে গুরুতরভাবে আঘাত করেছে।
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর ৬ দফায় যে স্বাযত্বশাসনের কথা বলা হয়েছিল বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতে সেই রকম স্বায়ত্বশাসন দিতে হবে।প্রবন্ধে তিনি বিচার বিভাগে বিচারক সংকট, মামলা জটসহ বিদ্যামান বিভিন্ন সমস্যা তথ্যের ভিত্তিতে উপস্থাপন করেন। এছাড়াও আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ২০০৯ সালে রাস্ট্র পরিচালনায় আসার পর থেকে বিচার বিভাগের জন্য গৃহিত বিভিন্ন ইতিবাচক পদক্ষেপ উল্লেখ করে স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠায় ১২ দফা সুপারিশ মালা তুলে ধরেন। এর মধ্যে রয়েছে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে পৃথকীকরণকে আরো অর্থবহ ও কার্যকর করতে দ্বৈত শাসন বিলোপে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া।