BNP-DOINIKBARTA

দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ২২ অক্টোবর ২০১৫: দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিধি সংশোধনে রাজনৈতিক দল, পর্যবেক্ষক সংস্থা ও সুশীল সমাজের সঙ্গে সংলাপে বসবে না নির্বাচন কমিশন৷ নতুন করে রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের বিষয়ে কোনো পদক্ষেপও নেবে না৷ পৌর নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসার অজুহাতে কমিশন বিষয়গুলো পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে৷ কেন্দ্রের পাশাপাশি তৃণমূল নেতারাও যাতে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন দেয়ার ক্ষমতা পায় কমিশন সে সুযোগ তৈরি করছে৷ নির্বাচন পরিচালনাসংক্রান্ত বিধি সংশোধন করে এ ক্ষমতা দেয়া হচ্ছে৷ একই সঙ্গে দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজনের লক্ষ্যে দুটি বিধিমালার কমপক্ষে ২০টি ধারা সংশোধনের কাজ শুরু করেছে৷

নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আবদুল মোবারক বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বসার কোনো পরিকল্পনা আমাদের নেই৷ আইন পাশ হয়ে যাচ্ছে, এটা সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য৷ আমরা সেই আইনের আলোকেই বিধিমালা সংশোধন করব৷ বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিধির আলোকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিধিমালা সংশোধনের চিন্তা করছি৷ জাতীয় সংসদ নির্বাচন দলীয়ভাবে হয়৷ এখন থেকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনও দলীয়ভাবে হবে৷ তিনি বলেন, তাড়াতাড়ি বিধিমালা সংশোধন করতে হবে৷ কারণ ডিসেম্বরে পৌরসভা নির্বাচন৷ নভেম্বরে তফসিল দিতে হবে৷ এর আগেই শেষ করতে হবে সংশোধনীসংক্রান্ত কাজ৷ কোনো দলের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই স্থানীয় সরকার আইন সংশোধনের কাজ প্রায় শেষ করে এনেছেন সংশ্লিষ্টরা৷ এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশন বিধিমালা সংশোধনের ক্ষেত্রেও কারও সঙ্গে আলোচনা করছে না বলে জানা গেছে৷ এর আগে গণডতিনিধিত্ব আদেশ সংশোধন নিয়ে বর্তমান নির্বাচন কমিশন সংলাপের আয়োজন করে৷ এতে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ, সাংবাদিক প্রতিনিধিরা অংশ নেন৷ অথচ কমিশন এবার সংলাপের আয়োজন না করে নির্বাচনসংক্রান্ত বিধিমালা সংশোধনে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে৷ গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ অনুযায়ী নিবন্ধিত ৪০টি রাজনৈতিক দল শুধু জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়ার কথা৷ এখন থেকে স্থানীয় সরকার পর্যায়ের সব নির্বাচন দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠিত হবে৷ কাজেই সংসদ নির্বাচনের জন্য নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলো স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সুযোগ পাবে কিনা তা স্পষ্ট করতে হবে কমিশনকে৷ কিন্তু এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি বলে জানা গেছে৷

স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণের বিষয়ে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন টেলিফোনে বলেন, ‘ছোট-বড় সব দলের প্রার্থীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে৷ শুধু বড় দলগুলোর কাছে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে কুক্ষিগত হয়ে না পড়ে সে জন্যই এ পদক্ষেপ নিতে হবে৷ এতে তৃণমূল পর্যায়ের ছোট রাজনৈতিক দলগুলো বিকশিত হওয়ার সুযোগ পাবে৷

এদিকে, বিএনপিদল পুনর্গঠনে হাত দিয়েও তা শেষ হয়নি এখনো৷ এরই মধ্যে দলভিত্তিক স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানে মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত নতুন করে রাজনৈতিক চাপে ফেলেছে বিএনপিকে৷দলটির দায়িত্বশীল নেতারা মনে করছেন, স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুরোপুরি কবজায় নিতে দলীয়ভাবে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার৷ তা ছাড়া দলীয় প৪্রতীক ও মনোনয়নে নির্বাচন করে বিএনপিকে শেখ হাসিনার সরকারের অধীন নির্বাচনে আনার ফাঁদে ফেলার কৌশল থেকেও এ ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হচ্ছে বলে বিএনপির সন্দেহ৷

স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, তাঁদের দল স্থানীয় সরকারের সব নির্বাচনে অংশ নিয়ে আসছে৷ কিন্তু দলভিত্তিক স্থানীয় সরকারের নির্বাচন একটি নতুন প্রেক্ষিত৷ এ বিষয়ে দলের উচ্চপর্যায়ে আলোচনার পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে৷ তবে দলের উচ্চপর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ একজন নেতা বলেন, বিএনপির সামনে এখন দুটি পথ৷এক. সরকার যাতে দলীয় পরিচয়ে স্থানী সরকারের নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে, সেই পরিস্থিতি তৈরি করা৷ দুই. ফলাফল পূর্বনির্ধারিত, তা জেনেই এটাকে রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেওয়া৷

দলীয় সূত্রগুলো জানায়, দলভিত্তিক স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সঙ্গে বিএনপি নীতিগতভাবে একমত৷ কিন্তু সরকারের দমন-পীড়ন এবং ক্ষমতাসীনদের অধীন সমপ্রতি তিন সিটি করপোরেশনসহ স্থানীয় সরকারের একাধিক নির্বাচনের অভিজ্ঞতা থেকে এ ব্যবস্থার বিরোধিতা করছে দল৷

বিএনপির সূত্রে জানা গেছে, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দলের আগামী পৌর বা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে না যাওয়ার ভালো-মন্দ দিকগুলোর নানামুখী ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা হচ্ছে৷ তবে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি৷ লন্ডনে অবস্থানরত দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দেশে ফেরার পর এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে বলে জানিয়েছেন বিএনপির নেতারা৷এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটি ও দলের যুগ্ম মহাসচিব পর্যায়ের তিনজন নেতার সঙ্গে কথা হয়৷ তাঁরা বলেছেন, বর্তমানে বিএনপির যে অবস্থা, তাতে সরকারকে তাদের দলীয় ছকে নির্বাচনের পথ থেকে সরানোর মতো সামথর্্য নেই৷ তাই দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা দ্বিতীয় বিকল্প, অর্থাত্‍ নির্বাচনকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেওয়ার পক্ষে৷এই অংশের নেতারা মনে করছেন, নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসন ন্যূনতম নিরপেক্ষতা দেখাতে পারলে সরকারের দমন-পীড়ন ও বৈরী পরিস্থিতির মধ্যেও বিএনপির প্রার্থীরা ভালো করবেন৷ মাঠপর্যায়ে তাঁদের সেই জনসমর্থন আছে৷ তা ছাড়া ২০-দলীয় জোটের অন্যতম শরিক জামায়াতে ইসলামী দলীয় প্রতীক দাঁড়িপাল্লা নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিতে পারছে না৷ ফলে বিএনপির প্রার্থীদের আরও ভালো করার সুযোগ তৈরি করবে৷

এ ছাড়া দলের নেতাদের কারও কারও আশঙ্কা, বিএনপি স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে অংশ না নিলে মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে নতুন করে হতাশা সৃষ্টি করতে পারে৷ এই হতাশায় দলের অনেক সম্ভাবনাময় প্রার্থী সরকারি চাপে অথবা নিজেদের টিকে থাকার জন্য হলেও ক্ষমতাসীন দলে যোগ দিয়ে দিতে পারেন৷বিএনপির দায়িত্বশীল নেতাদের ধারণা, হুট করে দলীয় পরিচয়ে স্থানীয় নির্বাচনের সরকারি ছক পরিকল্পিত৷ বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলেও তিন সিটি নির্বাচনের মতোই মাঠে নামতে দেওয়া হবে না৷ ভয়ভীতি দেখিয়ে প্রার্থীদের এজেন্টদের কেন্দ্রে যেতে দেওয়া হবে না৷ এ পরিস্থিতিতে জেনেশুনে নির্বাচনে অংশ নিয়ে সরকারকে বৈধতা দেওয়া ঠিক হবে কি না, তা-ও ভাবছেন নেতারা৷

বিএনপির নেতাদের অনেকে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ প্রধান প্রধান সিটি করপোরেশনগুলোতে বিএনপি-সমর্থিত নির্বাচিত মেয়র ও পৌরসভার মেয়র, উপজেলার চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান এবং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের সরিয়ে দিয়ে সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার কথাও উদাহরণ হিসেবে সামনে আনছেন৷

বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একজন নেতা গত মঙ্গলবার বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনের কথা ওঠার পর ইতিমধ্যে বিভিন্ন এলাকায় পুলিশ ও সরকারের বিভিন্ন সংস্থার লোকেরা বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীদের মামলার খোঁজখবর নেওয়া শুরু করেছেন বলে তাঁরা খবর পাচ্ছেন৷ এ অবস্থায় নির্বাচনে গিয়ে ফল কী হবে, তা নিয়ে চিন্তা আছে দলে৷

অবশ্য এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মো. শাহজাহান বলেন, ‘মামলা, গ্রেপ্তার, নির্যাতন-নিপীড়ন এই ঝড়-তুফানের মধ্য দিয়েই আমাদের এগোতে হবে৷’বিএনপির দায়িত্বশীল একাধিক নেতা বলেছেন, সরকার এতটা তড়িঘড়ি ও হুড়মুড় করে দলীয় প্রতীক ও মনোনয়নে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেবে, তা তাঁদের ধারণায় ছিল না৷ এত বড় সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে জাতীয় সংসদে নিজেরা নিজেরা হলেও আলোচনা হবে৷ কিন্তু সরকার নিজেদের একতরফা সংসদকেও গুরুত্ব না দিয়ে অধ্যাদেশ আকারে আইন পাস করে নির্বাচনের দিকে এগোচ্ছে৷ এমন পরিস্থিতিতে এখন দল পুনর্গঠন, নাকি স্থানীয় সরকার নির্বাচনের প্রস্তুতি্তকোন বিষয়ে মনোযোগী হবে, তা নিয়ে কিছু দুর্ভাবনায় ফেলেছে বিএনপির নীতিনির্ধারকদের৷দলের নেতাদের কেউ কেউ মনে করছেন, দলভিত্তিক স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সরকারি সিদ্ধান্তে বিএনপির পুনর্গঠন প্রক্রিয়া নতুন আঙ্গিক ও গতি পাবে৷ সম্মেলনের মাধ্যমে দল পুনর্গঠনের চলমান উদ্যোগের পাশাপাশি সাংগঠনিক কাঠামোয় প্রার্থী বাছাইয়ের প্রক্রিয়ংা শুরু করা গেলে মাঠের নেতা-কর্মীদের জাগানো সম্ভব হবে৷বিএনপির নেতাদের মূল্যায়ন হচ্ছে, নির্বাচনে সরকারদলীয় প্রার্থীদের জিততে হলে কেন্দ্র দখল করে ভোট জালিয়াতির আশ্রয় নিতে হবে৷ আর তা করতে গেলে ৫ জানুয়ারির একতরফা সংসদ নির্বাচন এবং গত এপ্রিলে চট্টগ্রাম ও ঢাকার তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পর নতুন কেলেঙ্কারিতে পড়বে সরকার৷ এতে জনমনের পুরোনো ক্ষত দগদগে হবে৷ আর তাতে মাঠপর্যায়ে নতুন করে আন্দোলন দানা বাঁধার ক্ষেত্র তৈরি করতে পারে ৷