Untitled-1

দৈনিকবার্তা-কুড়িগ্রাম, ১৫ অক্টোবর ২০১৫: ছিটমহল সমস্যার সমাধান করে আওয়ামী লীগ সরকার এখানকার বাসিন্দাদের ৬৮ বছরের বঞ্চনার অবসান ঘটিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিশ্বসভায় যেন বাংলাদেশ মাথা উঁচু করে চলতে পারে সে লক্ষ্যে সরকার কাজ করছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সবার সহযোগিতায় বাংলাদেশ গড়ে উঠবে দারিদ্র্য ও সন্ত্রাসমুক্ত এবং উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে ।বৃহস্পতিবার বিকেলে কুড়িগ্রাম সদর সরকারি কলেজ মাঠে আয়োজিত জনসভায় তিনি এ মন্তব্য করেন। জনসভায় বেশ কিছু উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। এসময় প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগ সরকারের বেশ কিছু উন্নয়ন প্রকল্পের কথা তুলে ধরেন। বিলুপ্ত ছিটমহলের বাসিন্দাদের ‘ফুলকুঁড়ি’ অভিহিত করে তাদের কল্যাণে ‘যা যা দরকার’ সব করার আশ্বাস দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।প্রথম সরকারপ্রধান হিসাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কুড়িগ্রামের বিলুপ্ত ছিটমহল দাসিয়ারছড়ায় পৌঁছে বৃহস্পতিবার সেখানে বিদ্যুৎ সেবা কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আপনাদের সার্বিক কল্যাণে যা যা করণীয়, আওয়ামী লীগ সরকার তা করবে। দুঃখের রজনী শেষ হয়েছে, নতুন সূর্যালোকে আলোকিত হয়ে আলোর পথের যে যাত্রা আপনারা শুরু করেছেন সে যাত্রা অব্যাহত থাক।সকালে হেলিকপ্টারে করে ফুলবাড়ী পৌঁছান শেখ হাসিনা। পরে সেখান থেকে ১১টার দিকে গাড়িতে করে পৌঁছান দাসিয়ারছড়ায়।কালিহাট গার্লস হাই স্কুল মাঠে সভামঞ্চ থেকে বিদ্যুৎ সংযোগ কার্যক্রম উদ্বোধনের পাশাপাশি কয়েকজন বাসিন্দার মধ্যে সৌরবিদ্যুৎ প্যানেল বিতরণ করেন তিনি।স্থানীয়দের নিয়ে আয়োজিত সমাবেশে তিনি বলেন, দাসিয়ারছড়া এখন ছিটমহল নয়, এটি বাংলাদেশের অন্তর্গত ফুলবাড়ির এলাকা। আমি ফুলবাড়িতে এসেছি। ফুলবাড়ি এখন নতুন প্রস্ফূটিত ফুলের এক বাগান। এখানকার নাগরিকরা এখন এক একজন ফুল।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজ আপনাদের মধ্যে আসতে পেরে অত্যন্ত আনন্দিত। আগেও আসার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু আসতে পারিনি।কেন সেটা আপনারা ভালো করেই জানেন। কোথায় যাব? কোনো ঠিকানা আপনাদের ছিলো না। আজ আপনাদের সে অসুবিধা আর নাই। আপনারা এখন বাংলাদেশের সন্তান, এদেশের নাগরিক, বাংলাদেশেরই আপনজন।বিলুপ্ত ছিটবাসীদের বিদ্যুৎ, স্বাস্থ্যসেবা এবং চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থা করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।ইতিমধ্যে কুড়িগ্রাম, নীলফামারি ও পঞ্চগড়ে পাঁচটি পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপন করা হয়েছে যেন যে কোনো অনভিপ্রেত পরিস্থিতি এড়ানো সম্ভব হয়। বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য এ তিন জেলায় ৪১ দশমিক ৭১ কিলোমিটার বিদ্যুৎ লাইন স্থাপন করা হয়েছে। এর মাধ্যমে ২৫ হাজার পরিবারকে পল্লী বিদ্যুতের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে। যে সব এলাকায় বিদ্যুৎ লাইন নেই, সেসব এলাকায় সোলার প্যানেল দেওয়া হচ্ছে। শিক্ষার জন্য এসব এলাকায় প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের কাজ চলছে বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী।নাগরিকত্বের স্বীকৃতি দিয়ে ৩১ জুলাই মধ্যরাতে স্থল সীমান্ত চুক্তি কার্যকরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ছিটমহলের বিলুপ্তি ঘটে। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের নাগরিকত্বের পাশাপাশি সরকারি সেবার অধিকারপ্রাপ্ত হয় ছিটবাসী।

৩৭ হাজার বাসিন্দাসহ নিজেদের সীমানায় ভারতের এ ধরনের ১১১টি ছিটমহল পেয়েছে বাংলাদেশ। একইভাবে ১৪ হাজার বাসিন্দাসহ ভারতের ভেতর বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল পেয়েছে প্রতিবেশী দেশটি।দাশিয়ারছড়ার বাসাবাড়িতে গেছে বিদ্যুতের তার, বসেছে মিটার। বৃহস্পতিবার বিদ্যুৎ সংযোগের উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী। ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশের পাওয়া ছিটমহলগুলোর মধ্যে কুড়িগ্রামে রয়েছে ১২টি। এ ছিটমহলগুলোর মোট বাসিন্দা ৮হাজার ১৩২ জন।এরমধ্যে দাসিয়ারছড়াতেই বাস করেন ৬ হাজার ৬০৮ জন।জনসভায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতার সময় মুজিব-ইন্দিরা মৈত্রী চুক্তি ও স্থল সীমান্ত চুক্তি হয়। ১৯৭৪ সালেই স্থল সীমান্ত চুক্তি সংসদে পাস করেন বঙ্গবন্ধু। তবে ভারত তাদের পার্লামেন্টে এটা করতে পারেনি। তারপরে পাস করতে করতে লাগলো ৬৮ বছর।বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশে যারা সরকার গঠন করেছিল তারা এই চুক্তি বাস্তবায়নে কোনও কাজ করেনি বলে অভিযোগ করেন তিনি।

জিয়া ক্ষমতায় আসে,জেনারেল এরশাদ ক্ষমতায় আসে, খালেদা জিয়া ক্ষমতায় আসে; কিন্তু কেউ এই চুক্তিগুলো বাস্তবায়নের জন্য ভারতের সঙ্গে যে আলাপ-আলোচনা করতে হবে সেই উদ্যোগ গ্রহণ করে নাই বা করবার মত মনে হয় সাহসও পায়নি।১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এ আলোচনা শুরু করলেও তখন পাঁচ বছরের মধ্যে ‘সমস্ত কাজ সম্পন্ন’ করতে পারেননি জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ২০০৯ সালে সরকারে এসে আবার সেই কাজে তিনি হাত দেন।স্থল সীমান্ত চুক্তির জন্য ভারতের পার্লামেন্টের সকল সদস্য ও নরেন্দ্র মোদীর সরকারকে তিনি ধন্যবাদ জানান। সেইসঙ্গে বাংলাদেশের প্রতিবেশী ভারতীয় রাজ্যের সরকারগুলোকেও ধন্যবাদ দেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।ছিটমহলের বাসিন্দাদের ৬৮ বছরের মানবেতর জীবন যাপনের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, দীর্ঘ বছর যে বঞ্চনা, যে কষ্ট; সেই কষ্ট আর আপনাদের থাকবে না।

সেই কষ্ট আল্লাহর রহমতে নেই। জাতির পিতা শুরু করেছিলেন, তিনি যদি বেঁচে থাকতেন তাহলে এই সমস্যা বহু আগেই সমাধান হয়ে যেত। বহু আগেই আপনারা আপনাদের ঠিকানা পেতেন, রাষ্ট্রের মর্যাদা পেতেন, সবকিছু পেতেন।এসময় ছিটমহলবাসীর জন্য নেওয়া নানা উন্নয়ন কর্মসূচির কথাও প্রধানমন্ত্রী তুলে ধরেন।তিনি জানান, ছিটমহলগুলোতে ডাথমিক, মাধ্যমিক ও মসজিদ-মন্দিরভিত্তিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। স্বাস্থ্য কেন্দ্র, ডিজিটাল তথ্য কেন্দ্র, রাস্তাঘাট নির্মাণের কাজও শুরু হয়েছে।দীর্ঘদিনের সুবিধা-বঞ্চিত মানুষের কর্মসংস্থানের জন্য কর্মসূচি হাতে নেওয়ার পাশাপাশি ভূমিহীন ও অতি-দরিদ্রদের জন্য ঘড়বাড়ি নির্মাণ ও ঋণদান কর্মসূচির কথাও শেখ হাসিনা বলেন।

অনেক সময় চলে গেছে। কিন্তু এই যে এতদিনের বঞ্চনা সেটা কীভাবে পূরণ করা যায়, আমরা সেজন্য অত্যন্ত আন্তরিক। আর সে কারণেই আজ আপনাদের মাঝে ছুটে এসেছি।সারা দেশের উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ইনশাল্লাহ, সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন আমরা প্রতি ঘরে ঘরে আলো জ্বালাতে পারব। শুধু বিদ্যুতের আলো নয়, শিক্ষার আলো জ্বালানো, স্বাস্থ্য সেবা দিব।বাংলাদেশ ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ হিসেবে বিশ্বসভায় মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করতে সরকারের লক্ষ্যের কথা এই অনুষ্ঠানেও বলেন তিনি। তিনি বলেন, আমরা আগেরবার যখন ক্ষমতায় ছিলাম, তখন এ অঞ্চলে মঙ্গা দূর করেছিলাম। বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় আসার পর আবারও এখানে মঙ্গা নেমে আসে। জনগণের ভোটে আবার আমরা ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসি, আবারও জনগণের স্বার্থে কাজ শুরু করি। এ অঞ্চলের মঙ্গা দূর করে উন্নয়ন কার্যক্রম শুরু করি।

শেখ হাসিনা বলেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদত বরণের পর যারাই ক্ষমতায় এসেছে, কোনো সরকারই স্থল সীমান্ত সমস্যা, সমুদ্রসীমা সমস্যা, ছিটমহল সমস্যার সমাধান করতে পদক্ষেপ নেয়নি। আওয়ামী লীগ সরকারে এসে এসব সমস্যার সমাধান করেছে। ছিটমহল সমস্যার সমাধান করে আওয়ামী লীগ সরকার এখানকার বাসিন্দাদের ৬৮ বছরের বঞ্চনার অবসান ঘটিয়েছে।তিনি বলেন, এখন থেকে আর ছিটমহল বলে কিছু নেই। সবাই বাংলাদেশের নাগরিক। প্রধানমন্ত্রী এসময় কুড়িগ্রামের উন্নয়নে সরকারের বিভিন্ন পরিকল্পনার কথাও উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, এখানে শিল্পোন্নয়ন ঘটানো হবে। রাস্তা-ঘাট নির্মাণ করা হবে। নদী ড্রেজিং করা হবে। জেলায় আলাদা স্টেডিয়াম বানানো হবে। কেবল কুড়িগ্রামই নয়, পুরো বাংলাদেশকে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে তোলা হবে।

ইতোমধ্যেই বিশ্বব্যাপী উন্নয়নের রোল মডেল হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ।জনসভায় যোগ দেওয়া কুড়িগ্রামবাসীকে শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের কাছে দাবি-দাওয়ার প্রয়োজন নেই। উন্নয়নের জন্য কী করতে হবে, তা আওয়ামী লীগ ভালোভাবে জানে। আমাদের উন্নয়ন নীতিমালা আছে। আমরা বাংলাদেশকে সম্পূর্ণ উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে চাই।এসময় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কড়া সমালোচনা করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, দেশের এই উন্নয়ন অনেকেরই পছন্দ হয় না। সে কারণে দেশকে অস্থিতিশীল রাখার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকে তারা। ২০১৩ সালে নির্বাচন বানচাল করতে বিএনপি-জামায়াত জোট মানুষ মেরেছে। তারা মানুষ নয়, তারা জানোয়ার। তারা মানুষের কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না। খালেদা জিয়া দেশে থেকে মানুষ পুড়িয়ে মেরেছেন, এখন বিদেশে বসেও ষড়যন্ত্র করছেন। শেখ হাসিনা সাফ জানিয়ে দেন, জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাস-মাদকসেবন বরদাশত করা হবে না। বাংলাদেশের মাটিতে জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসের স্থান হবে না। সরকার ইতোমধ্যেই জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাস দমনে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে।প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানাতে দাশিয়ারছড়ার প্রবেশমুখ থেকে শুরু হয়েছে তোরণ। এই রাস্তায় ইট-বালু বসেছে ছিটমহল বিলুপ্তির পর।

প্রধানমন্ত্রীর আগমন উপলক্ষে দাসিয়ারছড়াসহ কুড়িগ্রাম শহর ও এর আশপাশের এলাকা মনোরম সাজে সাজানো হয়। ফুলবাড়ী উপজেলা সদরের হেলিপ্যাড থেকে কালিরহাট পর্যন্ত রাস্তায় নির্মাণ করা হয় অসংখ্য তোরণ। সাজিয়ে তোলা হয় কুড়িগ্রাম শহর ও আশপাশের রাস্তাগুলো।সুধী সমাবেশে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের আগে তার বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, বিরোধদলীয় প্রধান হুইফ তাজুল ইসলাম, মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদ, দাসিয়ারছড়ার বাসিন্দা হৈমন্তী শুক্লাসহ অন্যরা বক্তব্য দেন।প্রধানমন্ত্রী দাসিয়ারছড়া থেকে ফিরে বেলা আড়াইটায় কুড়িগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ মাঠে এক জনসভায় বক্তব্য দেন। সেখানে কুড়িগ্রাম জেলায় ১৬টি উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন ও ১৫টি প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তিনি।উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর মধ্যে সদর উপজেলার ত্রিমোহনী এলাকায় নির্মিত সমন্বিত বীজ হিমাগার, রাজারহাট কৃষি-আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ সেন্টার, কুড়িগ্রাম টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার, রাজীবপুর ও নাগেশ্বরী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নবনির্মিত ৫০ শয্যার হাসপাতাল ভবন নির্মাণ প্রকল্প রয়েছে।