দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ১৩ অক্টোবর ২০১৫: জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় ঢাকার শেরেবাংলা নগরে জাতীয় সচিবালয় নির্মাণ প্রকল্পটির অনুমোদন দেওয়া হয়নি৷ লুই আই কানের মূল নকশা ঠিক রেখে আবারও পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে৷ লুই আই কানের মূল নকশা বাংলাদেশে না থাকায় প্রকল্পটি একনেক সভায় অনুমোদন দেওয়া হয়নি৷মঙ্গলবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সভা কক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে সভায় এ নির্দেশনা দেওয়া হয়৷
লুই আই কানের মূল নকশাসহ উপস্থাপন না করায় রমনা থেকে সচিবালয় শেরেবাংলা নগরে সরিয়ে নেওয়ার প্রস্তাব ফেরত পাঠিয়েছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)৷পরে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সাংবাদিকদের বলেন,প্রধানমন্ত্রী সভায় বলেছেন,এ প্রকল্প অনুমোদন দেওয়ার আগে আমাদের লুই আই কানের মূল নকশা এনে দেখতে হবে৷ আমাদের কাছে যে অনুলিপি আছে তাতে মূল নকশার বিচ্যুতি হচ্ছে কি না দেখতে হবে৷প্রধানমন্ত্রী মূল নকশা পাওয়ার পর এ প্রকল্প আবার একনেকে উপস্থাপনের নির্দেশ দিয়েছেন বলে পরিকল্পনামন্ত্রী জানান৷
তিনি বলেন, সভায় এ প্রকল্প নিয়ে বিভিন্ন রকম সুপারিশ এসেছে৷ এ কারণেই লুই কানের মূল নকশা অনুসরণ করতে প্রকল্পটি ফেরত দেওয়া হয়েছে৷এ সময় এক প্রশ্নের উত্তরে মন্ত্রী বলেন, প্রকল্পটি আপাতত ঝুলে গেছে৷লুই কানের নকশা মিলিয়ে দেখার পর আবার এ প্রস্তাব একনেকে তোলা হলে সে সময় চন্দ্রিমা উদ্যানে জিয়াউর রহমানের কবর থাকবে কি না জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, মূল নকশা না দেখে কিছু বলা যাবে না৷ মূল নকশায় দেখতে হবে- সেখানে একটি মাজার, নাকি আরও মাজার আছে৷এস্তোনিয়ায় জন্মগ্রহণকারী মার্কিন স্থপতি লুই কান ১৯৬২ সালে ঢাকায় জাতীয় সংসদ ভবন কমপ্লেঙ্ ও আশেপাশের এলাকা নিয়ে যে নকশা করেছিলেন,সেটি এখন যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে বলে পরিকল্পনামন্ত্রী জানান৷জাতীয় সংসদ ভবনের চারপাশে নিরাপত্তা বেষ্টনী নির্মাণ নিয়ে সমালোচনার প্রেক্ষিতে গতবছরও একবার ওই মূল নকশা আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল৷ সেজন্য স্থাপত্য অধিদপ্তর লুই কানের প্রতিষ্ঠান ডেভিড অ্যান্ড উইজডমের সঙ্গে যোগাযোগও করেছিল৷কিন্তু মূল নকশা আনতে কত টাকা লাগবে সেই হিসেব করতেই এক বছরের বেশি সময় পার করে দিয়েছে সংসদ সচিবালয় ও স্থাপত্য অধিদপ্তর৷রমনায় সচিবালয় সমপ্রসারণের জায়গা না থাকায় বর্তমানে বাণিজ্য মেলার খোলা মাঠ ও সংলগ্ন চন্দ্রিমা উদ্যানের কিছু জায়গা নিয়ে ৩২ একর জমির উপর নতুন জাতীয় সচিবালয় নির্মাণের একটি প্রস্তাব গত ৬ জুন পরিকল্পনা কমিশনের প্রাক মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায় তোলা হয়৷ কোনো ধরনের সমীক্ষা ছাড়াই প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করায় সে সময় বিষয়টি নিয়ে পরিকল্পনা কমিশন আপত্তি জানায় বলে কমিশনের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান৷পরিকল্পনা কমিশনের আপত্তি সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় গত জুলাই মাসে প্রকল্পটি এগিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হয়৷এ প্রকল্পের প্রস্তাবে ৩২ একর জায়গা চারটি ব্লকে ভাগ করে জাতীয় সচিবালয় কমপ্লেঙ্ নির্মাণের কথা বলা হয়৷ এর মধ্যে দুটি বড় ব্লকে ৩২টি বড় মন্ত্রণালয় এবং দুটি ব্লকে ১৬টি ছোট মন্ত্রণালয়কে স্থানান্তর করার পরিকল্পনা নেয় সরকার৷
এতে বলা হয়, প্রস্তাবিত সচিবালয়ের মূল ভবনের আয়তন হবে প্রায় ২ লাখ ৫৩ হাজার ৩১০ বর্গমিটার৷ এর সঙ্গে থাকবে ৫৪ হাজার ৫০৫ বর্গমিটার এসোসিয়েটস ভবন, ৫ হাজার ৮৪৩ বর্গমিটার অডিটোরিয়াম ও হলরুম, ২৪ হাজার ৭২৯ বর্গমিটার মসজিদ আর্কেড ও সমবায় ভবন, ১ হাজার ৩৮ বর্গমিটার এন্ট্রান্স প্লাজা, ৫ হাজার ২০০ বর্গমিটার চিলার রুম, ৬৮ হাজার ২৩৪ বর্গমিটারের সড়ক এবং ১ হাজার ৭৭২ মিটার সীমানা প্রাচীর৷গণপূর্ত অধিদপ্তরের মাধ্যমে দুই হাজার ২১৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১৮ সালের মধ্যে এ প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা বলা হয় প্রকল্প প্রস্তাবে৷পরিকল্পনা কমিশনের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান,এ প্রকল্প নেওয়ার আগে কোনো প্রাক-মূল্যায়ন করা হয়নি৷ সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের বিদ্যমান জনবল কাঠামো অনুযায়ী অফিসের জন্য কী পরিমাণ জায়গার প্রয়োজন হবে সে সম্পর্কেও কোনো তথ্য প্রকল্প প্রস্তাবে (ডিপিপি) বলা হয়নি৷এ প্রকল্পটির জন্য ১৯৭৪ সালে ১০টি ব্লকে চারটি নয়তলা ভবনসহ অফিস ব্যাংক, অডিটোরিয়াম, মসজিদ, কার পার্কিং সম্বলিত জাতীয় সচিবালয় নির্মাণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়৷ এজন্য যুক্তরাষ্ট্রের ডেভিড উইজডম অ্যান্ড এসোসিয়েশনের সঙ্গে চুক্তিও হয়েছিল৷পরবর্তীতে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে ওই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি৷১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তত্কালীন পরিকল্পনামন্ত্রী এ বিষয়ে একটি সভা করলেও বিষয়টি আর এগোয়নি৷একনেক সভা সূত্র জানায়, প্রকল্পটি প্রণয়ন করা হয়েছে লুই আই কানের অনুলপি নকশার ওপর নিভর্র করে৷ এখন প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে হলে যুক্তরাষ্ট্র থেকে লুই আই কানের মূল নকশা নিয়ে আসতে হবে৷ কোনো অনুলিপি নকশার ওপর নির্ভর করে প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া যায় না৷ এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, এ প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন দেওয়া হয়নি৷ পুনর্মূল্যায়নের জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রকল্পটি ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে৷ তাদের লুই আই কানের নকশা অপরিবর্তিতরেখে পরিকল্পনাতৈরি করে একনেকে আবার উত্থাপন করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে৷একনেক সূত্র জানায়, একনেক সভায় চূড়ান্ত অনুমোদনের সচিবালয় স্থানান্তরের প্রকল্পটি তোলা হলে তা অনুমোদন দেয়নি কমিটি৷
সূত্র জানিয়েছে, নগরীর আব্দুল গনি রোডের বর্তমান সচিবালয় কমপ্লেঙ্ েসমপ্রসারণের কোনো সুযোগ নেই৷ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ভুক্ত অনেক দফতর কমপ্লেঙ্রে বাইরে৷ বর্তমানে বাংলাদেশ সচিবালয় কমপ্লেঙ্ তত্কালীন প্রাদেশিক সরকারের সময় নির্মিত যা প্রয়োজনের তুলনায় অপর্যাপ্ত৷ এজন্য শেরেবাংলা নগরে জাতীয় সচিবালয় নির্মাণ প্রকল্পটি একনেকে বৈঠকে তোলা হয়৷এ প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে দুই হাজার ২শ’ ৯ কোটি ৭০ লাখ টাকা৷ সব টাকা সরকারের নিজস্ব তহবিল (জিওবি) থেকে মেটানো হবে৷
প্রকল্পের আওতায় ৩২ একর জায়গায় চারটি ব্লকে ভাগ করে জাতীয় সচিবালয় কমপ্লেঙ্ নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়৷ দু’টি বড় ব্লকে ৩২টি বড় মন্ত্রণালয় ও দু’টি ছোট ব্লকে ১৬টি ছোট মন্ত্রণালয়কে স্থানান্তর করা হবে৷ প্রকল্পের আওতায় অডিটোরিয়াম, সম্মেলন কেন্দ্র, ব্যাংক, পোস্ট অফিস, মসজিদ, কার পার্কিং ইত্যাদিও থাকবে৷অন্যদিকে দুই লাখ ৫৩ হাজার ৩শ’ ৯ দশমিক ৭১ বর্গমিটার মূল ভবন (চারটি ব্লক) ও ৫৪ হাজার ৫শ’ ৫ দশমিক ৮৮ মিটার অ্যাসোসিয়েট বিল্ডিং নির্মাণ করা হবে (দু’টি ব্লক)৷মসজিদের আয়তন হবে ২৪ হাজার ৭শ’ ২৯ দশমিক ১৪ বর্গমিটার৷ ৫৮ হাজার ৪৩ দশমিক ১৪ বর্গমিটার অডিটোরিয়ামসহ ১০ হাজার ৩৮ বর্গমিটার এনট্রান্স প্লাজা হবে৷ প্রকল্পের আওতায় অভ্যন্তরীণ বিদ্যুতায়ন, পানি সরবরাহ, ১০টি সিসি টিভি ও ৩২টি লিফট কেনা হবে৷ এছাড়া পাঁচ হাজার ১শ’ ৯৯ বর্গমিটার এলাকা জুড়ে চিলার রুম ও এক হাজার ৭শ’ ৭২ রানিং মিটার সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করা হবে৷ বহির্বিদ্যুতায়নের জন্য পাঁচ হাজার ৮শ’ ৬২ দশমিক ২৪ বর্গমিটার এলাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে৷
১৯৭৪ সালে ৪২ একর জায়গায় ১০টি ব্লকে চারটি নয়তলা ভবনসহ অফিস, ব্যাংক, অডিটোরিয়াম, মসজিদ, কার পার্কিং ইত্যাদি সম্বলিত জাতীয় সচিবালয় নির্মাণের চুক্তি হয়েছিলো৷ বাংলাদেশ সরকার ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি ডেভিড উইজডম অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটের সঙ্গে এ চুক্তি হয়৷ কিন্তু পরবর্তীতে এ কাজের কোনো অগ্রগতি হয়নি৷বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ ভবনের স্থপতি লুই আই কানের নকশা স্থাপত্য অধিদফতর সংশোধন করেছে৷ কারণ, ইতোমধ্যে পূর্বের জমির পরিমাণ ১০ একর কমে গেছে৷ ওই জমিতে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে৷এখন ১০ একর জমি অধিগ্রহণ করতে হলে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র ভাঙ্গতে হবে অথবা জিয়াউর রহমানের মাজার সরাতে হবে৷জিয়ার মাজার সরাতে হবে কি? এমন প্রশ্নের জবাবে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, কার মাজার সরাতে হবে কি-না লুই আই কানের নকশা দেখেই বোঝা যাবে৷ লুই আই কানের মূল নকশা না দেখে এখন কিছুই বলা যাবে না৷ একটি মাজার না আরও মাজার আছে সেই বিষয়টি দেখতে হবে তবে মূল নকশা পযনর্্ত অপেক্ষা করতে হবে৷