দৈনিকবার্তা-রংপুর, ০৩ অক্টোবর ২০১৫: রাজধানীর গুলশানে ইতালিয়ান নাগরিক তাভেলা সিরাজি হত্যার এক সপ্তাহের মাথায় এবার রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার সরাইল ইউপি’র কাচু আলুটারী মহিষাওয়াল পাড়ায় ওসি কানিও (৬৫)নামে এক জাপানি নাগরিককে গুলি করে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। এঘটনায় প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৪ জনকে আটক করেছে পুলিশ। শনিবার সকাল ১১টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। এঘটনায় পুলিশ জড়িত সন্দেহে রিক্সা চালক মোন্নাফ (৩৫), ঘটনাস্থলের পাশের বাড়ীওয়ালা মুরাদ হোসেন (৩২) ও রংপুর নগরীর জাকারিয়া হোসেন (৪০) নামসহ ৪ জনকে আটক করা হয়েছে।
স্থানীয়রা জানায়, বিদেশী নাগরিক কানিও রিক্সায় করে উপজেলার কাচু আলুটারী মহিষওয়াল গ্রামে তার পরিচালিত একটি কৃষি খামারে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে দুটি মটরসাইকেল যোগে মুখোশধারী কয়েকজনের একদল দুর্বৃত্ত তার গতিরোধ করে এবং তাকে লক্ষ্য করে এলোপাথারী গুলি ছুড়তে থাকে। এতে ঐ বিদেশি নাগরিক গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান। পরে স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করে। ঘটনার পরেই জেলা প্রশাসক রাহাত আনোয়ার ও পুলিশ সুপার আব্দুর রাজ্জাক ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। সেই সাথে রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি হুমায়ুন কবির ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন বলে জানা গেছে।
তথ্য মতে, জাপানি নাগরিক ওসি কানিও স্থানীয় হীরা মিয়া নামে বাংলাদেশী এক লোকের সাথে কাচু আলুটারী মহিষাওয়াল গ্রামে দেড় একর জমি নিয়ে একটি উন্নত মানের বিদেশী ঘাস ও ঔষধী গাছের প্রকল্প চালাতেন। কিন্তু তার অংশীদার হীরা মিয়া ছাড়াই কয়েকদিন যাবৎ কানিও একাই তার পরিচালিত কৃষি খামারে যাতায়াত করতেন। আবার কেউ কেউ বলছেন, জাপানী নাগরিক রংপুর মহানগরীর মুন্সিপাড়ায় একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন। তবে জাপানী নাগরিক ওসি কানিও বাংলাদেশী বংশদ্ভুত নাগরিক বলে অনেকেই মন্তব্য করছেন। এদিকে পুলিশ ওসি কানিও বাংলাদেশী বংশদ্ভুত কি না তা নিশ্চিত করতে পারেনি। তবে তিনি এক বৎসরের ভিসা নিয়ে রংপুর মহানগরীতে চার মাস যাবৎ অবস্থান করছিলেন বলে জানা গেছে। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জয়নুল আবেদীন জানান, নিহত জাপানী নাগরিক ওসি কানিও কি কারণে খুন হলেন তা নিশ্চিত নন তিনি। তবে তার কাছে থাকা কোন মূল্যবান জিনিসপত্র খোয়া যায়নি বলে জানান।
উল্লেখ্য, গত ২৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীর গুলশানে ইতালিয়ান নাগরিক তাভেলা সিরাজীকে গুলি করে হত্যা করে কিছু দুর্বুত্ত এর রেশ কাটতে না কাটতেই এবার জাপানী নাগরিক ওসি কানিওকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। প্রসঙ্গত, গত সোমবার সন্ধ্যায় গুলশান ২ নম্বরের ৯০ নম্বর সড়কে ইতালিয় নাগরিক সিজার তাভেল্লাকে গুলি করে হত্যা করে দুর্র্বত্তরা। তিনি নেদারল্যান্ডসভিত্তিক আইসিসিও কো-অপারেশন নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্র“ফ (প্রফিটেবল অপরচুনিটিজ ফর ফুড সিকিউরিটি) কর্মসূচির প্রকল্প ব্যবস্থাপক ছিলেন। মাত্র পাঁচদিনের মাথায় শনিবার সকালে রংপুরের গ্রামে আরেক বিদেশীকে হত্যা করল দুর্বৃত্তরা।রংপুর শহরের মুন্সীপাড়ার স্থানীয় একটি পরিবারের দুই ভাই জাপানে থাকেন।
তাদের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে কনিও আলুটারি গ্রামে একটি ঘাসের খামার করছিলেন। সেখানে যাওয়ার পথে তিনি হামলার শিকার হন। কারা কেন এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, তাৎক্ষণিকভাবে তা জানা যায়নি।কাউনিয়া থানার ওসি রেজাউল করিম বলেন, দুর্র্বৃত্তরা মোটর সাইকেলে এসে তাকে তিনটি গুলি করে। একটি গুলি তার বুকে, একটি ডান হাতে এবং আরেকটি কাঁধে বিদ্ধ হয়।বাংলাদেশে চলাচলে নিজ নিজ দেশের নাগরিকদের প্রতি পশ্চিমা দেশগুলোর সতর্কতা জারির মধ্যে তাভেল্লা হত্যাকাণ্ড ঘটে। তা নিয়ে আলোচনার মধ্যে খুন হলেন জাপানি নাগরিক। রংপুরের পুলিশ সুপার আব্দুর রাজ্জাক সাংবাদিকদের বলেন, কনিও এবছর মে মাসে বাংলাদেশে আসেন। তিনি আলুটারি গ্রামের শাহ আলমের জমি ইজারা নিয়ে একটি ঘাসের খামার করেছেন।রংপুর শহরের মুন্সীপাড়ার জাকারিয়া নামে এক জনের বাড়িতে ভাড়া থাকতেন এই জাপানি। তার দুই ভাই জাপানে থাকেন, যাদের মাধ্যমে কনিওর বাংলাদেশে আসা এবং খামার ইজারা নেওয়া। পুলিশ সুপার রাজ্জাক বলেন, মুন্নাফের রিকশায় প্রতিদিন সকালে শহর থেকে খামারে যেতেন কনিও।
রিকশাচালককে উদ্ধৃত করে তিনি বলেন,কনিও আজ সকালেও রিকশায় করে মাহিগঞ্জ-হারাগাছা সড়ক থেকে একটি কাঁচা রাস্তা ধরে ৫০০ গজ দূরের নিজের ইজারা নেওয়া খামারের দিকে যাচ্ছিলেন। মাঝ পথে আলুটারি মহিষওয়ালা মোড়ে একটি মোটর সাইকেলে এক মুখোশধারী বসা ছিল। সেদিক থেকে আসে আরও দুজন মুখোশধারী।ঘাসের এই খামারটিতে কাজ করছিলেন হোসি কনিওতারা কনিওকে গুলি করে দ্রুত দৌড়ে মোটর সাইকেলে উঠে পালিয়ে যায়। পরে পাশের বাড়ি থেকে মুরাদ বের হয়ে কনিওকে একটি অটোরিকশায় তুলে হাসপাতালে নেওয়ার পথে তার মৃত্যু হয়।
রিকশাচালক জানিয়েছেন, মুন্সীপাড়ার হিরা নামে একজন প্রতিদিন এই জাপানির সঙ্গে রিকশায় এলেও শনিবার তিনি আসেননি।কনিওর সঙ্গে থাকা পাসপোর্টটি উদ্ধার করেছে পুলিশ। তার বয়স ৬৬ বছর। তার ভিসার মেয়াদ রয়েছে ২০১৬ সালের ৩১ মে পর্যন্ত।রংপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জয়নুল আবেদীন বলেন, মেল্টিপল ভিসা নিয়ে বাংলাদেশে আসেন কনিও। একটি প্রজেক্ট তৈরি করে ফান্ড গঠনে সহায়তা করছিলেন তিনি।তিনি বলেন, গত ২৮ অগাস্ট সর্বশেষ বাংলাদেশে আসেন এই জাপানি নাগরিক। তবে তার অবস্থানের ব্যাপারে পুলিশ প্রশাসনকে কিছু জানানো হয়নি।জাপানি এই নাগরিকের মৃতদেহ রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।জেলা পুলিশ সুপার ছাড়াও জেলা প্রশাসক রাহাত আনোয়ার ও র্যাব-১৩ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল কিসমৎ হায়াত ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। ঘটনাস্থলে পুলিশ ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) সদস্যদের তৎপর দেখা যায়।পিবিআই প্রধান উপ মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মাহবুবুর রহমান বলেন, আমরা এই ঘটনাটিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছি।
স্থানীয়ভাবে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা কাজ করছে। তবে টেকনিক্যাল বিষয়ে ঢাকা থেকে সরাসরি সহায়তা করা হচ্ছে। এদিকে, রংপুরের কাউনিয়ায় দুর্বৃত্তদের গুলিতে জাপানি নাগরিক হোসি কোমিও হত্যার ঘটনায় সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানিয়েছে ঢাকাস্থ জাপান দূতাবাসশনিবার নিজ দেশের নাগরিক হত্যার পর ঢাকায় নিযুক্ত জাপান দূতাবাসের মিনিস্টার মাচুনাগা গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপকালে এ দাবি জানান।তিনি বলেন, এ ঘটনায় আমরা খুবই মর্মাহত। সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে জড়িতদের খুঁজে বের করে বিচারের আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছি। কোমিও রংপুর শহররে মুন্সিপাড়ায় জাকারিয়া বালা নামের এক ব্যক্তির বাড়িতে ভাড়া থাকতেন। ঢাকার গুলশানে ইতালিয় নাগরিক সিজারি তাভেল্লার হত্যার এক সপ্তাহের মধ্যে আরেক বিদেশী নাগরিককে হত্যার এ ঘটনা ঘটল ।তবে এ হত্যার কারণ এবং কে বা কারা ঘটিয়েছে তাৎক্ষণিক পুলিশ তা জানাতে পারেনি।এ ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য চার জনকে আটক করেছে পুলিশ।