দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৫: নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটস এখন প্রবাসী বাংলাদেশিদের পদচারণে সরগরম। রাতভর আলোচনা,পরিকল্পনা। মাঝে মাঝে স্লোগান। হরদম মিলছে বাদাম-চানাচুর, চা-কফি। আছে পান-সুপারির আয়োজন। সর্বত্র উল্লাস, উচ্ছ্বাস, উত্তেজনা।এসবের ভিড়ে একটু ঢুঁ মরলে জানা যায় আসল ঘটনা। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিউইয়র্কে আসছেন। তাঁর আগমন ঘিরে এই তোড়জোড়।জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭০তম অধিবেশনে যোগ দিতে বুধবার রাতে নিউইয়র্কে আসবেন শেখ হাসিনা। সাধারণ পরিষদে ভাষণদেওয়া ছাড়াও এই সফরে তিনি বিভিন্ন দেশের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন। কথা বলবেন বাংলা সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে। অংশ নেবেন সংবর্ধনায়। আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর নিউইয়র্ক সফর নিয়ে বিনিন্দ্র রাত কাটাচ্ছেন দলের প্রবাসী নেতা-কর্মী ও সমর্থকেরা। অনেক সাধারণ প্রবাসীও আছেন এই দলে।
প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানাতে বিমানবন্দরে যাওয়া নিয়ে তাঁদের মধ্যে উৎসব-উৎসব ভাব। দলীয় নেতা-কর্মীদের আলাপ-আলোচনায় ঘুরেফিরে আসছে শেখ হাসিনার সফরের নানা বিষয়। তিনি কী পুরস্কার পাচ্ছেন, কোন কোন বিশ্বনেতার সঙ্গে বৈঠক করছেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সঙ্গে তাঁর কতবার দেখা হচ্ছে এসব নিয়ে চলছে আলোচনা। বেশ কিছু প্রবাসীর ভাষ্য, প্রধানমন্ত্রীর আগমন উপলক্ষে তাঁরা প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে কাজে-কর্মে যাচ্ছেন না। কাজ ফাঁকি দিয়ে জড়ো হয়েছেন জ্যাকসন হাইটসে।কানেকটিকাট থেকে আসা আবুল হোসেন বলেন, দলে তাঁর কোনো পদ-পদবি নেই। তবুও প্রাণপ্রিয় নেত্রীকে একনজর দেখতে কাজ ফেলে নিউইয়র্কে ছুটে এসেছেন তিনি।জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে শেখ হাসিনার বক্তব্য দেওয়ার সময় অদূরের সড়কপথে শান্তি সমাবেশ করার আয়োজন চলছে। নাগরিক সংবর্ধনায় কে মঞ্চে থাকবেন, কে ফুল দেবেন—এ নিয়ে চলছে টানা সভা। দলাদলি ও কোন্দলও হচ্ছে। দফায় দফায় পুলিশ এসে তা সামাল দিচ্ছে।ছাত্রলীগের সাবেক নেতা কাজী কয়েস বলেন, সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে প্রধানমন্ত্রীর নিউইয়র্ক সফর সফল হবে। এ জন্য সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে।আওয়ামী লীগের অন্যতম সংগঠক হাজি এনাম বলেন, সুবিধাবাদীদের চিহ্নিত করে আওয়ামী লীগকে শক্তিশালী করার দাবিতে নেতা-কর্মীরা ঐক্যবদ্ধ।এদিকে প্রধানমন্ত্রীর নিউইয়র্ক সফরের সময় ব্যাপক বিক্ষোভ-সমাবেশের ডাক দিয়েছে বিএনপি ও সমমনারা।
বিএনপির নেতা জিল্লুর রহমান বলেন, বিমানবন্দর, জাতিসংঘের সদর দপ্তর ও প্রধানমন্ত্রীকে সংবর্ধনা দেওয়ার এলাকায় তাঁরা বিক্ষোভ-সমাবেশ করবেন। প্রধানমন্ত্রীর নিউইয়র্ক সফরের সময় বিএনপি-জামায়াতের তৎপরতা পর্যবেক্ষণ করতে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে কমিটি করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতা শাহীন আজমল বলেন, দেশ ও প্রধানমন্ত্রীর ভাবমূর্তি বিনষ্টের যেকোনো অপচেষ্টা তাঁরা প্রতিহত করবেন। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিতে বুধবার নিউ ইয়র্কের পথে রওনা হচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যেখানে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ সমবেত হবেন টেকসই উন্নয়নের নতুন লক্ষ্য ঠিক করতে।১১ দিনের এই সফরে ৬০ সদস্যের বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কোরবানির ঈদের দিনটি তার সেখানেই কাটবে।সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যের (এমডিজি) মেয়াদ শেষ হচ্ছে চলতি বছর। ২৫ থেকে ২৭ সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্কে এক সম্মেলনে বিশ্বনেতারা আগামী ১৫ বছরের জন্য নতুন পরিকল্পনা ঠিক করবেন, যাকে বলা হচ্ছে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য বা এসডিজি।
পৃথিবীর ১৫০টি দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের উপস্থিতিতে এসডিজি সম্মেলনের শেষ দিন বক্তব্য দেওয়ার কথা রয়েছে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।তার উপ-প্রেস সচিব মামুন-অর-রশিদ বলেন, ২০০০ সালে এমডিজি প্রণয়নের সময়ও শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। সে সময় বাংলাদেশের মতামত গুরুত্বের সঙ্গে’ নেওয়া হয়েছিল। এমডিজি পূরণে বাংলাদেশের সাফল্য বিশ্বে নানাভাবে প্রশংসিত হচ্ছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে। এসডিজি প্রণয়নেও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে ‘বিশেষ গুরুত্ব’ দিয়ে দেখা হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী এর আগে জানিয়েছেন, জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনের ফাঁকে ২৮ সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্কে ‘শান্তিরক্ষা’ বিষয়ক উচ্চ পর্যায়ের একটি বৈঠকে অংশ নেবেন শেখ হাসিনা। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সঙ্গে ওই অধিবেশনের কো-চেয়ার থাকবেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।বিশ্ব শান্তিরক্ষা কার্যক্রমকে আরও জোরদার করতে ওই অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী ‘কিছু প্রতিশ্র“তি’ দেবেন বলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন।এবার নিউ ইয়র্কে অবস্থানকালে জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক সর্বোচ্চ পুরস্কার চ্যাম্পিয়ন্স অফ দি আর্থ’ এবং তথ্য-প্রযুক্তিতে অগ্রগতির স্বীকৃতি হিসেবে আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ সংস্থার (আইটিইউ) পদক তুলে দেওয়া হবে শেখ হাসিনার হাতে।তার উপ-প্রেস সচিব মামুন বলেন, সবকিছু মিলিয়ে এবছর জাতিসংঘে বাংলাদেশের অংশগ্রহণের গুরুত্ব ও তাৎপর্য ভিন্ন মাত্রা বহন করে। শেখ হাসিনা এবার জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক অভিবাসী ও উন্নয়ন কমিটির চেয়ারম্যান হতে যাচ্ছেন বলেও জানান তিনি।মামুন বলেন, উন্নত দেশগুলোর পরিবেশ দূষণের কারণে উন্নয়শীল দেশগুলোর ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিষয়ে যে দেনদরবার চলছে, যাকে ক্লাইমেট ডিপ্লোম্যাসি বলা হচ্ছে, তাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় রয়েছেন শেখ হাসিনা।
তিনি উন্নয়নশীল বিশ্বের কণ্ঠস্বর হিসেবে কাজ করবেন। তিনি ন্যায্য দাবি ও বৈষম্য হ্রাস করার বিষয়গুলোও তুলে ধরবেন। ৩০ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে বাংলায় ভাষণ দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এছাড়া চীনের প্রেসিডেন্টের আমন্ত্রণে ২৭ সেপ্টেম্বর লিঙ্গ সমতা ও নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে বিশ্ব নেতাদের এক বৈঠকে অংশ নেবেন।আইএস জঙ্গিদের সহিংসতা-উগ্রপন্থা দমন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের আয়োজনে আরেকটি সম্মেলনে শেখ হাসিনার বক্তব্য দেওয়ার কথা রয়েছে।২৯ সেপ্টেম্বর এমডিজি থেকে এসডিজিতে যাওয়া: বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা ও প্রত্যাশা’ শীর্ষক একটি অনুষ্ঠানে তিনি প্রধান অতিথি থাকবেন। বাংলাদেশের আয়োজনে ওই বৈঠকে বিভিন্ন দেশের নেতারা অংশ নেবেন বলে আশা করা হচ্ছে।এছাড়া কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৫ সেপ্টেম্বর ‘গার্লস লিড দ্য ওয়ে’ শীর্ষক একটি ফোরামেও শেখ হাসিনা বক্তব্য দেবেন।শেখ হাসিনার নিউ ইয়র্কে অবস্থানকালের যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের প্রেসিডেন্ট এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকও হতে পারে বলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন। আগামী ১ অক্টোবর পর্যন্ত নিউ ইয়র্কে অবস্থান করার কথা রয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার।