gabtoly-bg20131011064502

দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৫: ঈদুল আজহার বাকি আর মাত্র দুদিন। এরই মধ্যে পুরোদমে জমে উঠেছে রাজধানীর পশুর হাটগুলো। হাটে গরুও উঠেছে পর্যাপ্ত পরিমাণে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ট্রাক, পিকআপ, লঞ্চ ও স্টিমারে প্রতিদিন ঢাকায় আসছে অসংখ্য গরু। এবার সবকটি হাটেই দেশি গরুর পরিমাণ তুলনামূলক বেশি। দাম সর্বনিম্ন ২০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ১২ লাখ টাকা। কোনো ক্ষেত্রে ২০ লাখেরও বেশি দামের গরু উঠেছে এসব হাটে। তবে বেশিরভাগ ক্রেতার আগ্রহ দেশি মাঝারি গরুর প্রতি। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, মাঝারি গরু দামে সহনীয়, মানেও ভালো। এদিকে গত কয়েকদিনের বৃষ্টিতে কাদা ও বর্জ্যে হাটের স্বাভাবিক পরিবেশ বিঘ্নিত হওয়ায় বেচা-কেনায় ভাটার শঙ্কায় পড়েছিলেন বেপারি ও হাট সংশ্লিষ্টরা। কিন্তুআবহাওয়া কিছুটা অনুকূলে থাকায় স্বস্তি ফিরে এসেছে তাদের মধ্যে।

সরজমিন দেখা গেছে, ক্রেতা, গরু ব্যাপারি ও হাটের সার্বিক নিরাপত্তায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি হাট কমিটির পক্ষ থেকেও পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাদের নিজস্ব উদ্যোগে প্রতিটি পয়েন্টে নামানো হয়েছে স্বেচ্ছাসেবক। এছাড়া পশুর স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক টিমও তৎপর রয়েছে। আর প্রতারক চক্র কোনোভাবেই যেন জালটাকার বিস্তার ঘটাতে না পারে, সে জন্য জালটাকা শনাক্তে প্রতিটি হাটে একটি করে চেকিং বুথ বসানো হয়েছে।

রাজধানীর মোহাম্মদপুরের রায়েরবাজার পুলিশ লাইন্সের খালি জায়গায় হাট বসানোর অনুমতি দিয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন। বিকেলে দেখা যায়, মাঠ ছাড়াও রাস্তার দুই পাশে বিশাল এলাকা জুড়ে সারি সারি করে বেঁধে রাখা হয়েছে ছোট, বড় ও মাঝারি সাইজের অসংখ্য গরু। যার বেশিরভাগই দেশীয়। তখনো দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ট্রাক ও পিকআপে করে গরু আসছিল হাটটিতে। ক্রেতার উপস্থিতিও চোখে পড়ার মতো। গরু কিনে নিয়েও যাচ্ছেন অনেকে। শাহ আলম নামের এক যুবক গরুর রশি টেনে নিয়ে যাচ্ছিলেন মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডের দিকে। ৪৫ হাজার ৫০০ টাকায় গরু কিনেছেন। দামে খুশি কিনা জানতে চাইলে, সন্তোষজনক উত্তর তার।এই হাটে চুয়াডাঙ্গা থেকে সফিকুল, মুরো, সাঈদ ও আশাসহ সাত জন মিলে ২১টি গরু এনেছেন রোববার রাতে।

প্রতিবছর আগারগাঁও হাটে গরু নিয়ে আসেন তারা। এবার সেখানে হাট না থাকায় রায়েরবাজার হাটে গরু নিয়ে আসেন তারা। রোববার গরু নিয়ে এলেও দরদাম করেছে অনেক ক্রেতা। ৪০ হাজার থেকে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা গরুর দাম হাকছেন তারা। কিন্তু ক্রেতারা ১ লাখ ৪০ হাজার দামের গরুর দাম করছেন, ৯০ থেকে ৯৫ হাজার টাকা। তবে ১ লাখ টাকায় গরু বিক্রি করতে রাজি বলে জানান তাদেরই একজন সফিকুল ইসলাম। তিনি জানান, গত রাত থেকে ক্রেতারা আসছেন। তারা গরুর দাম যাচাই-বাচাই করছেন। আশা করছি, বৃহস্পতিবারের মধ্যে সবকটি গরু বিক্রি করতে পারব।

ঝিনাইদহ থেকে ১০টি গরু নিয়ে শনিবার রাতে হাটে এসেছেন ঝিনাইদহের জিল্লুর রহমান। প্রতিটি গরু ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা দাম হাকছেন। এরই মধ্যে ৫৫ হাজার ও ৪৮ হাজার ৫০০ টাকায় মাঝারি সাইজের দুইটি গরু বিক্রি করেছেন তিনি। এই দামে সন্তুষ্ট কিনা জানতে চাইলে, সন্তোষজনক উত্তর তারও। আগামী দুয়েকদিনের মধ্যেই সবকটি গরু বিক্রি হবে বলে আশা তার। হাটের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় সন্তুষ্ট তিনি। সরজমিন ঘুরে ও হাট সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রায়েরবাজার হাটে সর্বোচ্চ ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা দামের ৭টি গরু উঠেছে। ক্রেতাদের অনেকেই দাম জিজ্ঞেস করছেন।হাটের ইজারাদার সংশ্লিষ্টরা জানান, রায়েরবাজারের এই হাটটি এবারই প্রথম হলেও শুরু থেকেই বেশ জমে উঠেছে। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত প্রায় ৬ শতাধিক গরু বিক্রি হয়েছে। তবে এসব গরুর মধ্যে দেশীয় মাঝারি সাইজের গরুর পরিমাণই বেশি।

পশুর-হাট

ভারতীয় গরু এই হাটে নেই বললেই চলে। এছাড়া শনিবার থেকে এ পর্যন্ত সহস্রাধিক গরু বিক্রি হয়েছে। ক্রেতা ও ব্যাপারিদের সুবিধার্থে হাটের চারিদিকে ৭টি হাসিল কাউন্টার বসানো হয়েছে। এর সংখ্যা বাড়তেও পারে। প্রশাসনের পক্ষ থেকেও হাটের নিরাপত্তায় সবধরনের সহায়তা পাচ্ছেন বলেও জানান সংশ্লিষ্টদের অনেকেই।এদিকে রাজধানীর বিভিন্ন পশুর হাটে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে পশু কেনা-বেচায় কিছুটা সংশয় থাকলেও গতকালের আবহাওয়ায় তা অনেকটা কেটে গেছে। সকাল থেকে হাটগুলোতেও ক্রেতাদের ভিড় পর্যায়ক্রমে বাড়তে থাকে। বিকেলের পর সন্ধ্যা যতই গড়িয়ে আসছিল, হাটগুলোতে ক্রেতার সংখ্যাও ততই বাড়ছিল। পছন্দের গরু কিনে অনেককেই বাসায়ও নিয়ে যেতে দেখা গেছে। এসব হাটের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যে শঙ্কা ছিল, গতকালের আবহাওয়ায় তা অনেকটাই কেটে গেছে। ফলে ক্রেতার উপস্থিতিতে অনেকটা আশার সঞ্চার হয়েছে তাদের মাঝে। তারা আশা করছেন, আবহাওয়া যাই হোক, কেনা-বেচা নিয়ে তাদের আর কোনো শঙ্কা নেই। পোস্তগোলা হাটের ইজারাদার হাজি রুবেল জানান, গরু কেনা-বেচা শুরু হয়েছে। হাটে ক্রেতার উপস্থিতিও চোখে পড়ার মতো। আশা করছি, আজ মঙ্গলবার থেকে আরো পুরোদমে কেনা-বেচা শুরু হবে। এছাড়া হাটের সার্বিক নিরাপত্তা বিষয়েও তিনি প্রশাসনের সহযোগিতা পাচ্ছেন বলে জানান তিনি।

রাজধানীর সবচেয়ে বড় পশুর হাট গাবতলীতে এখন গরু বেশি, ক্রেতা কম। হাট ইজারার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে গরু আসছে, কিন্তু গত দুই দিনের বৃষ্টিতে ক্রেতারা হাটে আসেনি।অব্যবস্থাপনা ও বেপারিদের দুর্ভোগের কথা স্বীকার করলেন গাবতলী হাটের পরিচালক রাকিব ইমরান। তিনি বলেন, আমাদের হাট স্থায়ী অংশে ছাউনি আছে। কিন্তু হাট অনেক এলাকজুড়ে ছড়িয়ে গেছে। এত বিশাল এলাকাজুড়ে ত্রিপলের ছাউনি দেয়া সম্ভব নয়। তার দাবি হাটে অনেক গরু এসেছে। ক্রেতা নেই। কিছু গরু বিক্রি হয়ে গেলে জায়গা খালি হবে। হঠাৎ বৃষ্টির কারণে আমাদের এই সর্বনাশ হয়েছে। বেপারিরাও কষ্ট পাচ্ছে। বেপারিদের থাকা-খাওয়া সমস্যা আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, হাটে খাবারের অস্থায়ী দোকান বসেছে প্রচুর। তাই বেপারি ও গরুর খাবারের সংকট নেই। থাকার সংকট কিছুটা আছে বলে স্বীকার করেন তিনি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের সম্পত্তি কর্মকর্তা খালিদ আহমদ বলেন, হাটে নিরাপত্তা ও জনদুর্ভোগের বিষয়ে দেখার জন্য কর্পোরেশনের মনিটরিং টিম ও মোবাইল কোর্ট আছে। কিন্তু পুলিশের অসহযোগিতায় মোবাইল কোর্টগুলো কার্যকর করা যাচ্ছে না।

দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ১০টি হাটের অব্যবস্থাপনা দেখার জন্য মোবাইল কোর্টগুলো কাজ করছে বলে তিনি দাবি করেন। বেপারিদের থাকা-খাওয়াসহ অন্য কোনো অভিযোগ থাকলে ইজারাদারদের জমা রাখা ৫ শতাংশ জামানত বাজেয়াপ্তসহ আর্থিক দণ্ডের বিধান রয়েছে বলে তিনি জানান। ইজারাদার, করপোরেশন ও পুলিশের মধ্যে সমন্বয়ের অভাবে বেপারি ও ক্রেতাদের দুর্ভোগ বেড়েছে বলে স্বীকার করেন এই কর্মকর্তা। তিনি বলেন, আমি একজন সাধারণ দর্শক ছাড়া হাটে গিয়ে আমার কিছু করার নেই। আবর্জনা সরানোর বিষয়টি দেখছে কর্পোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ।নোংরা পানিতে ভরে গেছে পুরো এলাকা। পানি বের হবার কোন পথ নেই। এরই মাঝেই চলছে গরু কেনাবেচা। কেউ সেচে পানি কমানোর চেষ্টা করছেন। আবার কেউ পানিতেই দাঁড়িয়ে আছেন। গরুর পাশেই রাখা খাবারগুলোও ভিজে গেছে। নিরাপত্তার জন্য খোলা আইন শৃঙ্খলার বাহিনীর বুথেরও অবস্থা বেহাল। অগত্যা এর দায়িত্বে থাকা সদস্যরা বুধ ছেড়ে জায়গা নিয়েছেন পাকা হাসিল রুমের কক্ষে। রোব ও সোমবার বৃষ্টিস্নাত বিকেলে এমই চিত্র ছিল রাজধানীর শাহজাহানপুর কলোনীর গরুর হাটের।হাটে প্রবেশের গেটে আইন শৃংখলা বাহিনীর বুথ পানির উপর ভাসছে। বুথের ভিতর রাখা টেবিল ও চেয়ারও পানিতে ভিজে গেছে। হাঁটু পানির কারণে যে কেউ একটু চলাচল করলেই ঢেউ খেলছে পুরো এলাকায়। এলাকার বিভিন্ন ড্রেনের পানি ও বৃষ্টি পানি এক সাথে মিশে হয়ে গেছে একাকার।গরুর গোবর, কাদা আর নোংরা পানিতেই ভরে গেছে পুরো হাট।

তবে বৃষ্টির সময় বিক্রেদের অনেকে হাতে ছাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আর যাদের ছাতা ছিল না তাদের পুরো বৃষ্টিতেই ভিজতে হয়েছে। আর বৃষ্টি থামার পর বেশির ভাগই বিক্রেতাকেই গরুর গা মোটা কাপড় দিয়ে মুছতে দেখা দেছে। মূল রাস্তা থেকে হাটটি সামান্য ঢালু হওয়ার কারণেও পানি জমেই ছিল অনেক সময়। পানি নেমে গেলেও কাঁদা হবে এই হাটের নিত্য সঙ্গী। শত কষ্টকে উপেক্ষা করে অঝোড় বৃষ্টির পর দাঁড়িয়ে থাকা বিক্রেতাদের দু’টি চোখ শুধুই খুঁজে ফিরেছে ক্রেতাকে। আর বৃষ্টির পর ক্রেতার সংখ্যা কমতে থাকে। কারণ একটাই পানি মাড়িয়ে কোন ক্রেতাই ঢুকতে চাচ্ছিলেন না হাটে। তাই প্রতি মূহুর্তেই তাদের অপেক্ষা ছিল শুধু ক্রেতার জন্য। তবে পানি কিছুটা নেমে যাওয়ার পর ক্রেতারা প্যান্ট হাটু পযন্ত জড়িয়ে হাটে ঢোকার চেষ্টা করেছেন। এদের মধ্যে কেউ কেউ আবার বেপারীকে ডেকে রাস্তা থেকেই গরুর দাম জিজ্ঞেস করছেন।যারা গরু কেনার নিয়তে এসেছিলেন তাদের অনেকে হাটের বেহাল অবস্থা দেখে বাহির থেকে গরু দেখে চলে গেছেন। আর যারা হাটে প্রবেশ করতে চেয়েছিলেন তাদেরকেও ভিজতে হয়েছে নোংরা পানিতে।

সব মিলে বেশি দূর্ভোগে পড়েছেন দূর দুরান্ত থেকে ট্রাকে আসা গরু বেপারীরা। ঠিক বৃষ্টির সময়ে গরু আনার কারণে তাদের ট্রাকেই গরুর সাথে ভিজতে হয়েছে। তবে বৃষ্টি বিক্রেতাদের জন্য কিছুটা ভোগান্তির হলেও তা ছিল ক্রেতাদের জন্য সুখকর। দেখা গেছে, বিক্রেতা যে দাম বলেছেন ক্রেতা তার অর্ধেক বলে চুপ ছিলেন। ফলে দাম শুনেই লাখ টাকার আশায় গরু নিয়ে আসা বেপারীরা হতাশ। গাবতলী পশু হাটের হাসিলঘরে দায়িত্বরত কর্মী মো. সরোয়ার বলেন, আজ সকাল আটটা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত মাত্র ৫০টি গরু বিক্রি হয়েছে।পশুর হাটের ইজারাদারদের ব্যবস্থাপক মো. সানোয়ার হোসেন বলেন, গরু যথেষ্ট এসেছে, এখনো আসছে; কিন্তু ক্রেতা কম। তবে কেনাবেচা এখন পর্যন্ত কম হলেও আগামীকাল রাত থেকে বেচাকেনা বাড়তে পারে।মাগুরা থেকে গরু নিয়ে গাবতলী হাটে আসা দুলাল মিয়া জানান, তিনি ১৮টি গরু নিয়ে গত রাত ১২টার দিকে গাবতলী হাটে এসেছেন। তবে বেলা এখন পর্যন্ত একটি গরুও বিক্রি হয়নি।