দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৫: নাড়ির টানে ছুটছে মানুষ। রাজধানীর রেল স্টেশন, বাস টার্মিনাল এবং লঞ্চঘাটে এখন ঘরমুখো মানুষের উপচেপড়া ভিড়। বৈরী আবহাওয়াও ঈদ যাত্রা ঠেকাতে পারেনি। নানা প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে আপনজনদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে কয়েকদিন ধরেই মানুষ রাজধানী ছাড়তে শুরু করেছে। তবে রোববার থেকে শরু হয়েছে আনুষ্ঠানিক যাত্রা। রোববার প্রচন্ড বৃষ্টির মধ্যেও ভোগান্তিকে সঙ্গে নিয়ে ঈদুল আজহা উপলক্ষে রাজধানী ছেড়েছেন হাজারো মানুষ। সোমবারও একই অবস্থা।নাড়ির টানে ছুটছে হাজারো মানুষ।সোমবার সকালের গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিতে ভোগান্তি তো ছিলই। ঘওে ফেরা মানুষের সেই ভোগান্তিটাকেই চরমে নিয়ে গেল দুঃসহ যানজট। এই ভোগান্তি নিয়েই শুরু মানুষের ঈদের আনন্দযাত্রা। সোমবারও মানুষ গ্রাম-গঞ্জের দিকে ধাবিত হচ্ছে স্রোতের মতো। পথে পথে ভোগান্তি কম নয়। আবার কোথাও রয়েছে দীর্ঘ যানজটও। তবে প্রিয়জনদের সঙ্গে ঈদ করার আনন্দের সামনে এসব প্রতিকূলতা তাদের কাছে তেমন কিছু মনে হচ্ছে না।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়- রাজধানীর মহাখালী, গাবতলী, সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে যাত্রী নিয়ে একের পর এক বাস ছেড়ে যাচ্ছে। কমলাপুর রেলস্টেশন যাত্রীদের ভিড় লেগেই আছে। যেসব যাত্রী ১৫ সেপ্টেম্বর ট্রেনের আগ্রিম টিকিট কিনেছেন তারা রোববারই বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছেন। আর যারা ১৬ সেপ্টেম্বর টিকিট কিনেছেন তারা সোমবার যাচ্ছেন। ট্রেনে যানজটের সমস্যা না থাকলেও শিডিউল বিড়ম্বনা কম- বেশি রয়েছে। নির্দিষ্ট সময়ে স্টেশনে ট্রেন না আসার অভিযোগ রয়েছে। এতে ঘরমুখো হাজারো যাত্রী পড়েছেন অসহনীয় দুর্ভোগে। গত দুইদিনে বেশ কয়েকটি ট্রেন ২০ মিনিট থেকে ২ ঘণ্টা ৩৫মিনিট পর্যন্ত দেরিতে ছেড়ে গেছে। গাবতলীর সোহাগ কাউন্টারে গিয়ে দেখা যায়, খুলনার টিকিট বিক্রি হচ্ছে ৬২১ টাকায়। এটা অন্যান্য সময়ের চেয়ে প্রায় ২০০ টাকা বেশি। যশোরের টিকিট বিক্রি হচ্ছিল ৫৪২ টাকায়। অন্য সময়ে এ টিকিট ৩শ’ থেকে ৪শ’র টাকা। ঈগল পরিবহনের যাত্রী মাহফুজুর রহমান জানান, মাগযুড়ায় যেতে ২৩০ টাকার টিকিট তাকে ৪০০ টাকা দিয়ে কিনতে হয়েছে।
দিনাজপুরগামী যাত্রী আবু বকর নাবিল পরিবহনের ৬০০ টাকার টিকিট কিনেছেন ৭০০ টাকায়।সদরঘাটে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে যাত্রীদের ভিড় বাড়ছে। পরিবার-পরিজন নিয়ে লঞ্চযাত্রীরা নির্ধারিত সময়ের আগেই ঘাটে পৌঁছছেন। কাঙিক্ষত লঞ্চের অপেক্ষায় হাজার হাজার মানুষ দাঁড়িয়ে আছেন টার্মিনালে। বরিশালামী যাত্রী ফারুক মিয়া বলেন, ঈদের সময় বাড়ি যাওয়া এক কঠিন বিড়ম্বনা। তারপরেও বাবা-মা এবং আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে ঈদে বাড়ি থাকলে আনন্দের কমতি থাকে না। ঈদের দু-একদিন আগে ভিড় বেশি থাকে, তাই আগে-ভাগে বাড়ি যাচ্ছি।যাত্রীরা অভিযোগ করেছেন, কাউন্টারে বাস আসতেও দেরি করেছে। এ ছাড়া সকালে যাঁরা ঢাকা থেকে দূর পাল্লার বাসের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন তাঁদের ঢাকার প্রবেশপথ থেকে বের হতেই তিন বা সাড়ে তিন ঘণ্টা লেগেছে।রাজধানীর কল্যাণপুর, শ্যামলী, গাবতলী, মহাখালী, সায়েদাবাদ, ফকিরাপুল, কমলাপুর এলাকার বাস কাউন্টারগুলোর সামনে গতকাল রোববার সারা দিন ঘরে ফেরা মানুষের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো।
বাস কর্তৃপক্ষ জানায়, যাঁরা পরিবারকে আগে বাড়িেেত পাঠিয়ে দিতে চান তাঁদের অনেকে থেকে ঢাকা ছাড়তে শুরু করেছেন। সোমবার এই ভিড় আরও বেশি হবে বলে মনে করছেন তাঁরা।এস আর পরিবহনের উপ-মহাব্যবস্থাপক প্লাবন বলেন, রোববার থেকেই বেশি সংখ্যক মানুষ ঈদে বাড়ি যাওয়া শুরু করেছে। প্রতিদিন এই সংখ্যা বাড়বে থাকবে। বাসের দেরি প্রসঙ্গে তিনি দাবি করেন তাঁদের বাস সঠিক সময়ে কাউন্টারে এসেছে; তবে যানজটের কারণে ঢাকা থেকে বের হতে বেশি সময় লেগেছে।ঢাকা থেকে শুভ বসুন্ধরা পরিবহনে লালমনিরহাট যাচ্ছেন গোলাম রাব্বানি। তিনি বলেন, সকালে বাসা থেকে বেরোনোর সময় বৃষ্টিতে দুর্ভোগে পড়েন। সকাল সায়ে আটটার বাসের জন্য তিনি কাউন্টারে গিয়ে নির্ধারিত সময়ে বাস পাননি। পরে সেই বাস ছাড়ে ১০টার দিকে। টেকনিক্যাল মোড় থেকে ঘুরে গাবতলী পার হতেই দুই ঘণ্টা লেগেছে তাঁর বাসের। এরপর তিনি সাভারে ও টাঙ্গাইল এলাকায় লম্বা যানজটে পড়েন। তখন গাড়ি ধীর গতিতে চলে। বিকেল পাঁচটার দিকে তিনি জানান, তিনি বগুড়া পৌঁছেছেন। অন্য সময় হলে এই সময়ের মধ্যে তিনি বাড়ির কাছাকাছি চলে যেতেন।
দেরি করে কাউন্টারে বাস আসার কারণ জানতে চাইলে শুভ বসুন্ধরার কাউন্টার ম্যানেজার মো. রফিক দেরি করার কথা স্বীকার করে বলেন, যে সময় গাড়ি বের করা হয়েছে সে সময় ঢাকার অফিসগামী মানুষের ভিড়, পশুর ট্রাকের চাপ ও যানজটের কারণে কাউন্টারে গাড়ি আসতে দেরি কয়েছে।বগুড়া গন্তব্যের আরেক যাত্রী আবুল কালাম এস আর পরিবহনে করে যাওয়ার জন্য বাসা থেকে বের হন দুপুর ১২টায়। তিনি জানান, বাস যথাসময়ে কাউন্টার থেকে ছেড়ে যায় কিন্তু গাবতলী পার হতে তাঁর দুই ঘণ্টা লেগে যায়। একই ভাবে তিনিও ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে দীর্ঘ যানজটে পড়েন।বাস কর্তৃপক্ষ জানান, বৃষ্টি হওয়ার কারণে রাস্তায় গর্ত ও কাদা সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে গাড়ি জোরে চালানো যাচ্ছে না। এ ছাড়া অনেকগুলো গাড়ি এক সঙ্গে ছাড়ার কারণে যানজটে পড়তে হচ্ছে। এ ছাড়া মহাসড়কে নানা অব্যবস্থাপনার অভিযোগ করেন তাঁরা। পশুবাহী ট্রাকের বিশৃঙ্খল যাতাযাতের কারণেও যানজট তৈরি হযৈছে বলে মনে করেন তাঁরা। তারা আরও জানান, সবচেযৈ বৈশি যাত্রীর চাপ থাকবে ঈদের আগে শৈষ কর্ম দিবস বুধবার।
টাঙ্গাইল: ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের রাবনা বাইপাস থৈকে গোড়াই পর্যন্ত ২৫ কি.মি রাস্তায় যানজট সৃষ্টি হয়েছে। গতরাতে র্বষ্টি, মহাসড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে দুর্ঘটনা ও গরুভর্তি ট্রাক বিকল হওয়ায় এ যানজটের র্সষ্টি হয়। গৈাড়াই হাইওয়ে থানার ওসি হুমায়ন কবির জানান, রাত ৩টার দিকে মহাসড়কের মির্জাপুরের ইসাইল এলাকায় দুটি ট্রাকের সংঘর্ষ হয়। এত দুজন সামান্য আহত হলেও ট্রাক দুটি রাস্তা থেকে সরাতে ফ্যায় ৪ ঘণ্টা লেগে যায়। অন্যদিকে, ভৈার সাড়ে ৬টার দিকে বাসাইলের করতিপাড়া বাইপাস এলাকায় ঢাকাগামী একটি গরুভর্তি ট্রাক বিকল। এ থৈকেই যানজটের শুরু হয়। এখন পর্যন্ত রাবনা বাইপাস থৈকে গৈাড়াই পর্যন্ত ২৫ কি.মি রাস্তায় যানজট রয়েছে। তবে যানজট নিরসনে পুলিশ কাজ করে যাচ্ছে বলেও তিনি জানান।
এদিকে, পবিত্র ঈদ-উল-আজহা উপলক্ষে বরিশাল-ঢাকা নৈৗপথে সৈামবার থৈকে শুরু হচ্ছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন সংস্থার (বিআইডব্লিউটিসি) ঈদ স্পৈশাল সার্ভিস।সরকারি এ সংস্থার সাতটি জাহাজের মাধ্যমে বিশেষ এ যাত্রী সেবা কার্যক্রম চলবে ৩০ সৈপ্টেম্বর পর্যন্ত।বরিশাল বিআইডব্লিউটিসি’র সহকারী মহা-ব্যবস্থাপক সেয়দ আবুল কালাম আজাদ জানান, শিডিউল অনুযায়ী এবারের স্পৈশাল সার্ভিসে পিএস টার্ন, পিএস মাহসুদ, পিএস অস্ট্রিচ, পিএস লৈপচা ও এমভি মধুমতি এবং এমভি বাঙালি জাহাজ যাত্রীসেবায় নিয়োজিত থাকবে। আর পিএস শেলাকে চাঁদপুরে স্ট্যান্ডবাই রাখা হবে। ফ্যয়োজন অনুযায়ী এটিকে স্পৈশাল সার্ভিসে যুক্ত করা হবে।তিনি জানান, ঢাকা থৈকে সংস্থার ৩টি জাহাজ ঈদে ঘরে ফৈরা যাত্রীদের নিয়ে বরিশাল ও চাঁদপুরের উদ্দেশ্যে ছৈড়ে যাবে। এর মধ্যে বিকেল ৫টায় পিএস শৈলা চাঁদপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হবে। আর এমভি মধুমতি সন্ধ্যা ৬টায় ও পিএস টার্ন ৭টায় বরিশালের উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসবে।
বিআইডব্লিউটিএ সূত্র জানায়, সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে যাত্রী পরিবহনে আগের চেয়ে এবার বাড়তি লঞ্চ ও জাহাজের সংখ্যা অনেক বৈশি রয়েছে। ফলে ঢাকা-বরিশাল নৈৗ-রুটের যাত্রীদের এবার ভোগান্তি অনেকটাই লাঘব হবে। পাশাপাশি বরিশাল নৌ-বন্দরসহ আশপাশের এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। এছাড়াও স্পৈশাল সার্ভিস চলাকালে এবারই সর্বফ্যথম নৌপথে দুর্ঘটনা ঘটলে যাত্রীদের তাৎক্ষণিকভাবে উদ্ধারের জন্য ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের একটি ডুবুরি দল এবং অসুস্থ যাত্রীদের দ্রুত চিকিৎসার জন্য একটি মেডিকেল টিম নৈৗ-বন্দরে উপস্থিত থাকবে।বরিশাল বিআইডব্লিউটিএ’র নৈৗ-নিরাপত্তা ও ট্রাফিক বিভাগের উপ-পরিচালক আবুল বাশার মজুমদার জানান, ফ্যতিবছর বরিশাল-ঢাকা রুটে বৈসরকারি ১১ থেকে ১৫টি লঞ্চ স্পৈশাল বা ঈদ সার্ভিসে যুক্ত হয়ে থাকে। আবার ঈদের সময় অন্যান্য রুটের আরো লঞ্চ ফ্যতিবছরই স্পেশাল সার্ভিসে যুক্ত হয়ে থাকে।এছাড়া এবার ডহ্যন লাইনের দু’টি ডে সার্ভিস লঞ্চ থাকছে। সবমিলিয়ে এবছর আগের চেয়ে বেশি লঞ্চ যাত্রী পরিবহনে নিয়োজিত থাকবে। ফলে অন্যান্যবারের তুলনায় এবার ঈদ যাত্রীদের ভোগান্তি অনেকটা লাঘব হবে।অন্যদিকে এবার বাড়তি লঞ্চ আর বাড়তি যাত্রীর কথা চিন্তা করে নৌ-বন্দর ও আশপাশের এলাকায় নৌ ও সড়ক পথে যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হবে।
যাত্রীদের জন্য টার্মিনাল ছাড়াও বন্দর ভবনের সামনে প্যান্ডেলের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। নৌ-বন্দর ও লঞ্চে চুরি-ছিনতাই ও অজ্ঞান পার্টির তৎপরতারোধে আনসার, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) ও পুলিশসহ সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা কাজ করবেন। যাত্রীদের তথ্য সেবাসহ বিভিন্ন সেবা প্রদানের জন্য তথ্যসেবা কেন্দ্র ও রোভার স্কাউটের সদস্যরা কাজ করবেন। এছাড়া পুরো এলাকায় সার্বক্ষণিক নজরদারি রাখতে জেলা প্রশাসন ও নৌ-বন্দর কর্তৃপক্ষের সমন্বয়ে মনিটরিং ব্যবস্থা চালু থাকবে। অতিরিক্ত যাত্রী বহনসহ অন্যান্য অপরাধ দমনে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হবে।বরিশাল জেলা প্রশাসক ড. গাজী মো. সাইফুজ্জামান বলেন, আসন্ন ঈদ-উল আজহায় সড়ক ও নৌপথের যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ইতোমধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন দফতরের কর্মকর্তাদের নিয়ে সভা হয়েছে।ঈদে ঘরমুখো মানুষদের সব ধরনের সেবা দিতে প্রশাসন সর্বোচ্চ সচেষ্ট রয়েছে বলে জানান তিনি।