দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৫: রাজধানীতে রোববার বৃষ্টিতে সড়ক জুড়ে জলজট, তা থেকে যানজটে নগরবাসীর দুর্ভোগ চরমে পৌঁছায়। অফিস শেষে এক ঘণ্টার পথ তিন ঘণ্টায় পাড়ি দিয়ে অনেকে। রোবাবর মিরপুর, মোহাম্মদপুর, রামপুরা মৌচাকসহ সবখানেই সড়কজুড়ে ছিল এমন দুর্ভোগ। কেউ কাকভেজা হয়ে, কোমরপানি মাড়িয়ে হেঁটে বাসায় ফিরেছেন। আবার যানবাহনের জন্য অনেককে বৃষ্টিতে ভিজে বাসস্ট্যান্ডে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। রোববার দুপুরের দিকে মুষলধারে বৃষ্টিতে পথঘাট পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় দেখা দিয়েছে জলাবদ্ধতা। আর জলাবদ্ধতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে যানজট ও জনদুর্ভোগ। পূর্ব মধ্য বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় একটি লঘুচাপ সৃষ্টি হয়েছে। স্থল নিম্নচাপটি মহারাষ্ট্র ও এর তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থান করছে। এর ফলে রোববার ঢাকাসহ দেশের অনেক স্থানে মাঝারি ও ভারী বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বৃষ্টিপাতের প্রবণতা আরো বাড়তে পারে বলে জানায় আবহাওয়া অফিস।এদিকে ভোর থেকে রাজধানীতে একটানা বৃষ্টি হচ্ছে।
গত কয়েক দিনের প্রচণ্ড গরমের পর এই বৃষ্টি কিছুটা স্বস্তি ফিরিয়ে দিলেও একটানা বৃষ্টিতে নগরজীবনে দুর্ভোগ নেমে এসেছে। শনিবার ভোর থেকে শুরু হয়ে রোববার সকাল পর্যন্ত টানা বর্ষণে ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় পানি জমে গেছে। শহরের প্রধান সড়কগুলোসহ পাড়া-মহল্লার অলিগলির রাস্তাঘাটে পানি জমে গেছে। এতে রাজধানী জুড়ে সৃষ্টি হয় তীব্র যানজট। পাশাপাশি পায়ে হাঁটতে গেলে কাদা পানি ও খানাখন্দকে ভরা রাস্তায় জনজীবনে নেমে আসে চরম দুর্ভোগ। স্কুল, মাদ্রাসা, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীসহ অফিস আদালতগামী মানুষ বৃষ্টি ও যানজট উপেক্ষা করেই নিজ নিজ লক্ষ্যে যেতে হচ্ছে।আবহাওয়া অফিস জানায়, পূর্ব মধ্য বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় একটি লঘুচাপ সৃষ্টি হয়েছে। মৌসুমী বায়ুর বর্ধিতাংশের অক্ষ গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, উড়িষ্যা, গাঙ্গেয় পশ্চিম বঙ্গ ও বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চল হয়ে উত্তর পূর্ব দিকে আসাম পর্যন্ত বিস্তৃত।
মৌসুমী বায়ু বাংলাদেশের উপর মোটামুটি সক্রিয় এবং উত্তর বঙ্গোপসাগরে মাঝারি অবস্থায় বিরাজ করছে।রোববার সকাল ৯টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘন্টার আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, ঢাকা, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অনেক জায়গায় এবং রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় অস্থায়ী দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরণের বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টিপাত হতে পারে। সেই সঙ্গে খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরণের ভারি বর্ষণ হতে পারে। সারাদেশে দিনের তাপমাত্রা ১ থেকে ২ ডিগ্রি সে. এবং রাতের তাপমাত্রা সামান্য হ্রাস পেতে পারে। রোববার বিকেলে মিরপুর থেকে কারওয়ান বাজারে আসার পথে বৃষ্টিতে সড়কে আটকে ছিল শত শত যানবাহন। আগারগাঁওয়ের সামনে থেকে বিজয় সরণি পর্যন্ত আসতে যেখানে কয়েক মিনিট লাগার কথা, সেখানে গতকাল লেগেছে আধা ঘণ্টারও বেশি। একই অবস্থা ছিল খামারবাড়ি, ফার্মগেটসহ প্রতিটি মোড়ে। শাহবাগ থেকে মিরপুরে যাওয়ার রাস্তার চিত্রও ছিল একই রকম। অনেক জায়গায় ট্রাফিক পুলিশও ছিল নিরুপায়।
যানজটে আটকে পড়া কয়েকজন যাত্রী ক্ষোভ নিয়ে বলেন, অন্যান্য দিন রাস্তাঘাট কিছুটা ফাঁকা থাকলেও রোববার ছিল উল্টো। অন্য যেকোনো দিনের চেয়ে রিকশা বা অটোরিকশার ভাড়াও ছিল কয়েক গুণ বেশি। সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে নারী যাত্রীদের গেল কয়েকদিনের ভ্যাপসা ঘরমের পর রোববার সকাল থেকেই আকাশের কোনে দেখা দিল মেঘের আনাগোনা। কখনও রোদ , কখনও মেঘ এভাবেই চলছিল আকাশের লুকোচুরি খেলা। তবে রাতের আকাশের নিরব কান্নায় হিমেল শান্ত পরিবেশ যেন বয়ে বেড়াচ্ছিল প্রকৃতিতে। কিন্তু দুপুরের আগের ভারী বর্ষণের ফলে তলিয়ে গেল রাজধানীর ঢাকার সকল রাজপথ, ফুটপাত। রাজধানীর ধানমণ্ডি, নিউমার্কেট, কারওয়ান বাজার, ঝিগাতলা, বংশাল, নয়াবাজার, শান্তিনগর, মালিবাগ, মৌচাক, যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, শাহাবাগ, কাকরাইল, পল্টন, গুলিস্তানের এলাকার সব রাস্তায় তলিয়ে গেছে পানির নিচে। কোথাও এক হাঁটু কোথাওবা তারও বেশি পানিতে তলিয়ে গেছে এসব রাস্তা। কাকরাইল, মালিবাগ, শান্তিনগরসহ আরো কয়েকটি এলাকায় দেখা গেছে শুধু রাজপথ নয় ফুটপাতও ছিল পানির নীচে। বৃষ্টির পানিতে রাস্তাঘাট তলিয়ে যাওযায় বিপাকে পড়ছেন স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থী ও পথচারিরা।
এক হাঁটু ময়লা পানি থেকে নিজের পরিধেয় পোশাটিকে একটু রক্ষা করতে প্যান্টটাকে কিছুটা গুটিয়ে নিয়ে পায়ের জুতা হাতে উঠিয়ে হেঁটে চলছেন পথচারিরা। ভাঙাচোরা রাস্তা কিংবা খোলা ম্যানহোলের ভয়ে যখন তারা খুব সাবধানে পা চালাচ্ছেন। এরই মাঝে বিপত্তি সাধছে দ্রুত গতির গাড়ী কিংবা তিন চাকার রিক্সাগুলো। তাদের গতির বেগে পথচারিদের পোশাকের বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে ময়লা পানি। ত্যক্ত, বিরক্ত পথচারিরা আপন মনে বকে যাচ্ছেন গাড়ীর ড্রাইভার আর প্রশাসনের কর্তাদের। কিন্তু কে শোনে কার কথা!বৃষ্টির পানির অজুহাতকে কাজে লাগিয়ে সিনজি ও রিক্সা ভাড়াও বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। তাছাড়া কিছু ভ্যান ও রিক্সা রাস্তা পারাপারে করে যাচ্ছে জনপ্রতি ৫ থেকে ১০ টাকা করে। তাদের একজন রিক্সার ড্রাইভার কাদের মিয়া। রাস্তা পারাপারের কাজ করছেন শান্তিনগর মোড়ে। বৃষ্টিতে রাস্তায় পানি বেড়ে গেলে তিনি ভাড়া না নিয়ে পারাপার এর কাজই করে থাকেন। এখানে আয় বেশি হয় বলে জানালেন কাদের।শুধু রাস্তা কেন, সোহরাওয়ার্দী, রমনা, ওসমানী উদ্যানসহ শহরের বিভিন্ন পার্কগুলোও আজ পানির নিচে। ফেরিওয়ালা ও ছোট–খাটো ব্যবসায়ীদের মালপত্র সব ভিজে একাকার।
এরই মাঝে বৃষ্টি ভেজার আনন্দে মেতে উঠেছে পথশিশুরা।রাজধানীর অনেক এলাকার মত প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়েও অল্প বৃষ্টিতেই পা ডুবছে পানিতে।রোববার সকাল ৬টা থেকে বেলা ১২টা পর্যন্ত ঢাকায় থেমে থেমে ১৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। এই বৃষ্টিতেই সচিবালয়ের ভেতরে চার জায়গায় পানি জমে থাকতে দেখা গেছে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত কিছুদিন ধরে জলাবদ্ধতার এই চিত্র সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। সামান্য বৃষ্টিতেই পানি জমছে এবং তা আটকে থাকছে দীর্ঘ সময়। এতে চলাচলে ব্যাঘাত সৃষ্টি হচ্ছে।এদিকে,দুপুরে সচিবালয়ের ৬ নম্বর ভবনের মূল প্রবেশ পথে সবচেয়ে বেশি পানি জমে থাকতে দেখা যায়।এছাড়া ৩ নম্বর ভবনের পূর্ব পাশ ও মাঝের বাগানে; ৫ নম্বর ভবনের পশ্চিম দিকে ফটকের সামনে এবং সচিবালয়ের ক্লিনিক ভবনের পেছনেও পানি দেখা যায়।গাড়িতে চড়ে যারা ৬ নম্বর ভবনে এসেছেন, তাদের একেবারে ভবন ঘেঁষে গাড়ি দাঁড় করিয়ে নামতে দেখা যায়।
অনেককেই দেখা যায় এক ভবন থেকে আরেক ভবনে যাচ্ছেন জুতা-সেন্ডেল হাতে নিয়ে।সচিবালয়ের এমন চিত্র দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেন ব্যক্তিগত কাজে আসা শরিফুল ইসলাম নামের এক দর্শনার্থী।তিনি বলেন, এখানেই যদি এ অবস্থা হয়, ঢাকার যে কি হবে আল্লাহই জানে!বসের’জন্য দুপুরের খাবারের প্যাকেট হাতে পানি ভেঙে অফিসে ঢোকার সময় এক কর্মচারী আরেকজনকে বলছিলেন, কারও তো কোনো মাথা ব্যথা দেখি না। গাড়িওয়ালাদের তো সমস্যা হয় না, সব ভোগান্তি আমাদেরজমে থাকা এই পানির মধ্যে একটু জোরে গাড়ি চললেই পানি ছিটকে পড়ে আশপাশের অনেক দূর।জলাবদ্ধতার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে গতপূর্ত বিভাগের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মোহাম্মদ মোয়াজ্জেম হোসেন খান বলেন, সচিবালয়ের পয়ঃনিষ্কাশন লাইনগুলো সব সচল রয়েছে, সমস্যা বাইরে।সচিবালয়ের বাইরে ড্রেনের পানির লেভেল সচিবালয়ের লেভেলের চেয়ে বেশি হয়ে গেছে। তাই পানি সরতে সময় লাগছে।
খুব ব্যস্ত কাদের। কথা বলারও সময় নেই। রাস্তার এপার থেকে ওপারে পৌঁছালেই ১০ টাকা। যাত্রী ওঠাতে-নামাতেই যা সময় লাগছে, এমনিতে পার করতে গড়ে দুই মিনিটের বেশি লাগে না। রিকশার ভাড়া বেড়েছে কিছুটা। তবে এতটা বেশি যে রাস্তা পেড়োলেই ১০ টাকা! আবার শুধু পানিতে ডুবে থাকা অংশ পেড়োতে লাগছে ৫ টাকা। হ্যা, যাত্রীরাও দিচ্ছেন। অন্যদিনের মত বাগবিতণ্ডা না করেই দিচ্ছেন। কারণ এই নোংড়া পানি মাড়িয়ে আর কাপড় চোপড় ভিজিয়ে রাস্তা পার হওয়ার চেয়ে ১০ টাকা দেয়াই শ্রেয়। রোববার দুপুরের দিকে মুষলধারে বৃষ্টির পর রাজধানীর শান্তিনগর মোড়ে এমনই চিত্র দেখা গেছে। পথঘাট পানিতে তলিয়ে দেখা দিয়েছে জলাবদ্ধতা। আর জলাবদ্ধতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে যানজট ও জনদুর্ভোগ।
সিগনালের এক ফুরসতে কথা হল তার সাথে। বৃষ্টির দিনে নিয়মিতই এ কাজ করেন তিনি। এখানে আয় বেশি হয় বলে জানালেন কাদের।এক প্রশ্নের জবাবে কাদের মিয়া বলেন, রাস্তায় যেদিন পানি বেড়ে যায় সেদিন আমি পারাপারের কাজই করি। পানি কমে গেলে আবার ভাড়ায় যাই। পানি পারাপার জনপ্রতি ৫ টাকা। আবার শুধু একজন যেতে চাইলে ১০ টাকা দিতে হয়।তিনি আরো বলেন, ভাড়া না নিয়ে এভাবে পারাপার করলেই আয় বেশি হয়। কোনদিন পারাপারে হাজার টাকা কিংবা তারও বেশি আয় হয়। অনেক যাত্রী বিশেষ করে নারীরাই বেশি পারাপার হয়ে থাকেন বলে জানান কাদের।কেউ কেউ প্যান্টটাকে কিছুটা গুটিয়ে নিয়ে পায়ের জুতা হাতে উঠিয়ে হেঁটে চলছেন। কিন্তু ভাঙাচোরা রাস্তা কিংবা খোলা ম্যানহোলের ভয়ে পা ফেলতে হচ্ছে খুব সাবধানে। এরই মাঝে বিপত্তি সাধছে দ্রুত গতির গাড়ী কিংবা তিন চাকার রিক্সাগুলো। তাদের গতির বেগে পথচারিদের পোশাকের বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে ময়লা পানি। ত্যক্ত, বিরক্ত পথচারিরা আপন মনে বকে যাচ্ছেন গাড়ীর ড্রাইভার আর প্রশাসনের কর্তাদের। কিন্তু কে শোনে কার কথা!