দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৫: বাংলাদেশকে উন্নত-সম্মৃদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত করতে গ্রামীণ অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করার ওপর জোর দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।তিনি বলেছেন, গ্রামের অর্থনীতিকে যদি আমরা শক্তিশালী করতে না পারি, গ্রামের মানুষের ক্রয় ক্ষমতা যদি বৃদ্ধি করতে না পারি, গ্রামের মানুষকে যদি আমরা দারিদ্রমুক্ত করতে না পারি, তাদের মৌলিক চাহিদা যদি বাস্তবায়ন করতে না পারি তাহলে আমাদের রাজনীতি করার কোনো অর্থই থাকে না।রোববার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন তিনি।অনুষ্ঠানে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সঙ্গে ৪৮টি মন্ত্রণালয়/বিভাগের সচিবরা দ্বিতীয়বারের মতো বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও মন্ত্রিপরিষদ সদস্য ও সংশ্লিষ্ট সচিবরা উপস্থিত ছিলেন।একটি মন্ত্রণালয় সারা বছর যেসব কাজ করবে সেটিই হলো এই বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমরা সুশাসন নিশ্চিতের মাধ্যমে উন্নয়নের গতিধারাকে ত্বরান্বিত করবো।এর মাধ্যমে ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে আমরা রূপকল্প-২০২১ প্রণয়ন করি। জনগণ আমাদের ভোট দিয়ে বিপুলভাবে বিজয়ী করেন। আমরা জনগণের কাছে দেওয়া প্রতিশ্র“তি পালন করে যাচ্ছি। দেশবাসীর কাছে আমাদের অঙ্গীকার, আমরা সুশাসন নিশ্চিত করবো।সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নে সরকারি কর্মকর্তাদের আরো আন্তরিক হওয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের হাতে আর তিন বছর সময় আছে। এ তিন বছরের মধ্যেই আমরা বাংলাদেশকে এমন একটা জায়গায় নিয়ে যেতে চাই, যাতে এ দেশের মানুষের ভাগ্য নিয়ে আর কখনো কেউ খেলতে না পারে। বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ যেন আর কখনও শোষিত-বঞ্চিত না হয়।তিনি বলেন, আমরা শাসক হিসেবে নয়, জনগণের সেবক হিসেবে কাজ করছি।সরকার সর্বস্তরের সাধারণ মানুষের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের সব পরিকল্পনা সাধারণ মানুষকে ঘিরে। মানুষের কল্যাণ করতে না পারলে আমাদের রাজনীতি করার অর্থ নেই।
তিনি বলেন, আমরা সুষম উন্নয়নে বিশ্বাস করি। সেই সঙ্গে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান ও আয়- বৈষম্য হ্রাস করা। এদেশের মানুষকে কি দিতে পারলাম,দেশে মানুষ কি পেলো সেটাই বড় কথা।উন্নয়নের গতিধারা অব্যহত রাখতে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশ দ্রুতগতিতে উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। একটা দেশ কখনোই থেমে থাকতে পারে না। উন্নয়নের গতিধারা ধরে রাখার দায়িত্ব প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের। তাহলেই দেশের মানুষের কল্যাণ হবে। কোন কাজে যে পরিমাণ বাজেট দেওয়া হয় সে পরিমাণ ফলাফলও যেন আসে সেদিকে নজর দিতে বলেন প্রধানমন্ত্রী।অগ্রাধিকার প্রকল্প চিহ্নিত করে তা দ্রুত শেষ করে নতুন প্রকল্প নেওয়ার পরামর্শ দেন প্রধানমন্ত্রী। একই সঙ্গে মন্ত্রণালয়গুলোকে নিজেদের মধ্যে সমন্বয় করে কাজ করতে বলেন তিনি।বাংলাদেশ নিম্নমধ্য আয়ের দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সুষ্ঠু পরিকল্পনাভিত্তিক কাজ করার কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে আমরা নিম্নমধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছি। মাত্র সাত বছরে আমাদের মাথাপিছু জাতীয় আয় প্রায় আড়াই গুণ বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছি। মাথাপিছু আয় ২০০৫-০৬ সালের ৫৪৩ ডলার থেকে বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে ১ হাজার ৩১৪ মার্কিন ডলার হয়েছে। এর আগে মাথাপিছু আয় দ্বিগুণ করতে সময় লেগেছিল ২০ বছর।
তিনি বলেন, মোট জাতীয় উৎপাদন (জিডিপি)১০০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাতে বাংলাদেশের সময় লেগেছিল ৩৮ বছর। এ অর্থবছরে জিডিপি ২০০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে। এ ধরনের সাফল্যের কারণে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে।এমন অভাবনীয় সাফল্য সত্ত্বেও আমাদের নিশ্চিন্ত হয়ে বসে থাকার সুযোগ নেই। রূপকল্প-২০২১ বাস্তবায়ন এবং ২০৪১ সালে বাংলাদেশকে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করতে হলে আমাদের যেতে হবে আরও অনেক দূর। উন্নয়নের গতিকে আরও ত্বরান্বিত করার আহবান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের আরও কঠিন চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে হবে।তিনি বলেন, আমরা এটাই সব সময় চিন্তা করি যে, আমাদের উন্নয়ন তখনই সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে পারব, যদি উন্নয়নের ছেঁয়া গ্রাম পর্যায়ে পৌঁছায়। আর সেদিকে লক্ষ্য রেখেই আমাদের দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ অর্থনৈতিক নীতিমালা গ্রহণ করেছে।
শেখ হাসিনার দাবি, তার দলের রাজনীতির লক্ষ্যই হচ্ছে সমাজের নিম্ন স্ত রে পড়ে থাকা দরিদ্র, খেটে খাওয়া, শ্রমজীবী মানুষের সার্বিক উন্নয়ন। সেই সাথে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান ও আয়- বৈষম্য হ্রাস করা। কাজেই আমাদের অর্থনৈতিক নীতিমালা, মিশন-ভিশন কার্যক্রম ও বাস্তবায়ন এবং বাস্তবায়নের যে ফলাফল সেটা যেন একেবারে তৃণমূল মানুষের কাছে পৌঁছায়- আমরা সেটাই নিশ্চিত করতে চাই।২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর মধ্যমেয়াদী বাজেট কাঠামো ঘোষণায় বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির উল্লেখ ছিল। এবার দ্বিতীয়বারের মত এ চুক্তি হল।একটি মন্ত্রণালয় বছরব্যাপী কী কী কাজ করবে- তারই লিখিত চুক্তি এটি। পরিকল্পনা কতটা বাস্তবায়ন হয়েছে বছর শেষে তার মূল্যায়নও করা হবে।এ চুক্তি বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্টরা আরও আন্তরিক হবেন এবং অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছনো সম্ভব হবে বলে আশা প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী।তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধ করে আমরা বিজয় অর্জন করেছি। বিশ্বসভায় আমরা মাথা উঁচু করে চলতে চাই। কারও কাছে ভিক্ষা করে, হাত পেতে নয়।
২০০৮ এর নির্বাচনের আগে রূপকল্প-২০২১ ঘোষণা করে আওয়ামী লীগ; যাতে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার প্রতিশ্র“তি রয়েছে। সে প্রসঙ্গ টেনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, লক্ষ্য স্থির রেখে আমরা উন্নয়নের যে গতিধারা সূচনা করেছিলাম; তারপরে বাংলাদেশ কিন্তু অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে।আমাদের মূল লক্ষ্য জনগণের সেবা করা। আমরা সরকার গঠন করেই ঘোষণা দিয়েছিলাম, শুধু শাসক হিসেবে নয়, সেবক হিসেবে আমরা কাজ করব। জনগণের সেবক।উন্নয়নের জন্য পাঁচ বছর খুব অল্প সময় মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাজের গতি ধরে রাখার নির্দেশ দেন।এখানে আপনারা যারা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী, আপনাদেরই কিন্তু দ্বায়িত্ব রয়েছে এই গতিটাকে ধরে রাখা। হয়তো সরকার আসবে সরকার বদলাবে। কিন্তু তারপরেও যদি এই গতিধারা ধরে রেখে এগিয়ে নিতে পারেন, তাহলে দেশের মানুষ লাভবান হবে।কর্মকর্তাদের প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ যেহেতু পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল, সেহেতু তাদের মধ্যে কাজের সমন্বয় প্রয়োজন।বাজেটে যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়, সে অনুপাতে ফল যাতে পাওয়া যায়- সে বিষয়ে কর্মকর্তাদের তাগিদ দেন প্রধানমন্ত্রী।বিশ্বব্যাপী মন্দার মধ্যেও বাংলাদেশ সবক্ষেত্রে দৃষ্টান্তমূলক’ অগ্রগতি অর্জন করেছে মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, সেই মর্যাদা ধরে রাখতে হলে আরও কাজ করা দরকার।আমাদের হাতে আর তিন বছর আছে। তারপর নির্বাচন। তখন জনগণ যাকে ভোট দেয় তারা ক্ষমতায় আসবে।কিন্তু এই তিন বছরের মধ্যেই আমরা বাংলাদেশকে এমন একটা জায়গায় নিয়ে যেতে চাই, যাতে এই বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য নিয়ে আর কখনো কেউ খেলতে না পারে। বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ যেন আর কখনও শোষিত-বঞ্চিত না হয়।
অগ্রাধিকার প্রকল্প চিহ্নিত করে তা দ্রুত শেষ করে নতুন প্রকল্প নিতে কর্মকর্তাদের তাগিদ দেন প্রধানমন্ত্রী।জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে জনগণের সঙ্গে মন্ত্রীর অঙ্গীকারের দলিল হচ্ছে বার্ষিক কর্মসম্পাদনা চুক্তি’ (এপিএ) এবং মন্ত্রণালয়/বিভাগের সচিবগণ প্রাতিষ্ঠানিক স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, সম্পদের যথাযথ ব্যবহার এবং সর্বোপরি প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতার উন্নয়ন নিশ্চিত করে গৃহীত উদ্যোগসমূহকে প্রক্রিয়া-ভিত্তিক থেকে ফলাফল ভিত্তিক করে তুলবেন।সরকারের সকল ক্ষেত্রে সুশাসন নিশ্চিত করার মাধ্যমে বর্তমান সরকারের রূপকল্প-২০২১ বাস্তবায়নে প্রণীত পরিকল্পনায় পরপর দ্বিতীয় বছর এ চুক্তি সম্পাদিত হয়।বার্ষিক কৌশলগত লক্ষ্যসমূহ এবং মন্ত্রণালয়ের কর্মপরিকল্পনা কর্মদক্ষতা মূল্যায়নের সূচক হচ্ছে বার্ষিক সম্পাদন চুক্তি। এটি মন্ত্রণালয়ের প্রকৃত কার্যক্রমের গুণগত ও মাত্রাগত মূল্যায়ন এবং কর্মকর্তাদের দায়িত্বশীলতা নিরূপণে সহায়ক।অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, মন্ত্রিপরিষদ সচিব এম মোশাররফ হোসেন ভূইয়া, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদ অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন এবং মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব (সংস্কার ও সমন্বয়) নজরুল ইসলাম এপিএ’র সুবিধা ও অসুবিধার দিক তুলে ধরেন।