দৈনিকবার্তা-গৌরনদী (বরিশাল), ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৫: রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের যত্রতত্র ব্যবহারের ফলে মাটির উর্বরতা শক্তি হ্রাস পেয়ে দিন দিন মাটি তার নিজস্ব গুনাগুন হারিয়ে ফেলছে৷ মাটির উত্পাদনশীলতা কমে যাওয়ায় শস্যের বাড়তি ফলন না পেয়ে দিন দিন কৃষকের মুখের হাসি ম্লান হয়ে যাচ্ছে৷ ঠিক এমনই সময় সরকারের কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তরের আইএপিপি, ডিএই প্রকল্পের মাধ্যমে মাটির নিরাপদ স্বাস্থ্য ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে দেশব্যাপী শুরু হয়েছে ভার্মিকম্পোস্ট সার উত্পাদন কর্মসূচী৷
সূত্রমতে, গরু ও বিশেষ প্রজাতির কেঁচোর মল দিয়ে তৈরি জৈব সার ভার্মিকম্পোস্ট বেশ স্বল্পসময়ে বাজারজাত করণের পর এ সার জমিতে প্রয়োগ করে বেশ সফলতা অর্জন করেছেন কৃষকেরা৷ ফলে দিন দিন এ সারের চাহিদা কয়েকগুন বৃদ্ধি পেয়েছে৷ ভার্মিকম্পোস্ট নামের জৈবসার উত্পাদন ও বিশেষ প্রজাতির কেঁচো বরিশালসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলের মধ্যে সর্বপ্রথম বাজারজাত করে ব্যাপক সফলতা অর্জন করেছেন গৌরনদী উপজেলার মাহিলাড়া ইউনিয়নের কৃষক ক্লাবের অর্ধশতাধিক সদস্যরা৷ গত ১৫ সেপ্টেম্বর সকালে ভার্মিকম্পোস্ট (কেঁচো সার) উত্পাদনের কয়েকটি স্থান পরিদর্শন করেন কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তরের বরিশাল অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক কৃষিবিদ মো. আব্দুল আজিজ ফরাজি৷ ওইদিন দুপুরে দক্ষিণ মাহিলাড়া গ্রামের সফল কৃষক বিপুল হালদারের বাড়িতে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন কৃষি বান্ধব জেলার দু’বারের শ্রেষ্ঠ মাহিলাড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সৈকত গুহ পিকলু৷ ওই সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে কৃষিবিদ মো. আব্দুল আজিজ ফরাজি বলেন, ভার্মিকম্পোস্ট ব্যবহার করলে মাটির ভৌত, রাসায়নিক ও জৈবিক গুনাগুন বৃদ্ধি করে৷ মাটির পিএইচের মাত্রা নিয়ন্ত্রণসহ মাটির বিষক্রিয়া দূর করে মাটিতে পানির ধারণক্ষমতা বাড়ায়৷ জমিতে ভার্মিকম্পোস্ট ব্যবহারের ফলে মাটির গঠন উন্নত করে অধিক ফসল উত্পাদনের পাশাপাশি ফসলের গুণগতমান ভালো হয়৷ এ সারের গুণাগুণ মাটিতে দীর্ঘদিন অবশিষ্ট থাকায় পরবর্তী ফসলে সারের পরিমান অনেক কম লাগে বলেও তিনি উল্লেখ করেন৷
একই সভার বিশেষ অতিথি কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তরের বরিশাল অঞ্চলের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ রমেন্দ্র নাথ বাড়ৈ বলেন, ভার্মিকম্পোস্ট জৈব পদার্থের একটি উত্স যা মাটির উর্বরতা বৃদ্ধির সঙ্গে শস্য উত্পাদনের অত্যাবশ্যকীয় খাদ্য উত্পাদন সরবরাহ করে৷ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কৃষি সহায়ক প্রকল্পের মনিটরিং অফিসার কৃষিবিদ হরিদাস শিকারী বলেন, একক মাত্রার ভার্মিকম্পোস্টে নাইট্রোজেন-২.৯%, ফসফরাস-২.২%, পটাসিয়াম-২.৩%, সালফার-২.৬%, ক্যালসিয়াম-৭.৪%, ম্যাগনেসিয়াম-১.৫%, দস্তা-০.৫% এবং বোরন-০.৯% বিদ্যমান থাকে৷ গৌরনদী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. নজরুল ইসলাম বলেন, ফসল ভেদে যেকোন ফসলের জন্য প্রতি শতক জমিতে ৩ থেকে ৫ কেজি হারে ভার্মিকম্পোস্ট সার ব্যবহার করলে ওই জমিতে আগের চেয়ে অর্ধেক রাসায়নিক সার ব্যবহার করলেই চলে৷ এ নিয়মে ৩ থেকে ৪ বছর পর্যন্ত ভার্মিকম্পোস্ট ব্যবহার করলে পরবর্তীতে জমিতে আর রাসায়নিক সার ব্যবহার না করলেও চলবে৷
উপজেলা উপ-সহকারি কৃষি অফিসার কৃষক বন্ধু মো. সিরাজুল ইসলাম জানান, ইতোমধ্যে ওই ইউনিয়নের কৃষকেরা তাদের ফসলি জমি ও পানের বরজে রাসায়নিক সারের পরিবর্তে ভার্মিকম্পোস্ট ব্যবহার করে বাম্পার ফলন পেয়েছেন৷ যে কারণে কৃষকদের মধ্যে দিন দিন এ সারের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে৷ ফলশ্রুতিতে স্থানীয় কৃষক বান্ধব ইউপি চেয়ারম্যান সৈকত গুহ পিকলুর আর্থিক সহযোগীতায় মাহিলাড়া ইউনিয়নের প্রায় অর্ধশতাধিক কৃষকেরা এখন ভার্মিকম্পোস্ট সার উত্পাদন করে বাজারজাত করছেন৷ কৃষি জমিতে রাসায়নিক সারের মাত্রা কমিয়ে আনার লক্ষ্যে ভার্মিকম্পোস্টের কোন বিকল্প নেই বলেও তিনি উল্লেখ করেন৷
ভর্মিকম্পোস্ট সার উত্পাদনকারী কৃষক বনজিত বেপারী জানান, কৃষি অফিস ও ইউপি চেয়ারম্যানের আর্থিক সহযোগীতায় তিনি প্রথমে তার বাড়িতে তিনটি চাকায় ভার্মিকম্পোস্ট উত্পাদন শুরু করেন৷ প্রতিটি চাকায় ৪৫ কেজি আধা কাঁচা গোবরের মধ্যে থাইল্যান্ডের এক’শ কেঁচো (প্রতি পিচ তিন টাকা) ছেড়ে দেয়া হয়৷ মাত্র দু’মাসের মধ্যে প্রতিটি চাকায় ওই এক’শ কেঁচোর ডিম থেকে কয়েক হাজার বাঁচ্চা কেঁচো জন্ম নেয়৷ বর্তমানে তার প্রতিটি চাকায় প্রায় আট থেকে দশ হাজার কেঁচো রয়েছে৷ ওই কোঁচোদের মল থেকেই ভার্মিকম্পোস্ট সার উত্পাদন করা হয়৷ মাহিলাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সৈকত গুহ পিকলু জানান, ভার্মিকম্পোস্ট জৈব সারগুলোর গুনগত মান অত্যন্ত ভাল হওয়ায় তিনি তার নিজ বাড়িতেও এ সার উত্পাদন শুরু করেছেন৷ তিনি আরও জানান, স্থানীয় পর্যায়ে কৃষকদের মাঝে সারগুলো বিক্রয়ের জন্য প্যাকেটজাত করে প্রতি কেজি মাত্র পনের টাকা মূল্যে নির্ধারন করে বাজারজাত করা হচ্ছে৷ মাহিলাড়া বাজারের সার ব্যবসায়ী তোতা মিয়া জানান, কৃষকদের মধ্যে ভার্মিকম্পোস্ট সারের চাহিদা দিন দিন বেড়েই চলেছে৷ সূত্রমতে, বর্তমানে জেলার অন্যান্য উপজেলাগুলোতেও ব্যাপক হারে ভার্মিকম্পোস্ট সার উত্পাদিত হচ্ছে৷ তবে মাহিলাড়া ইউনিয়ন থেকেই ওইসব উপজেলার উদ্যোক্তারা বিশেষ প্রজাতির কেঁচো ক্রয় করে নিচ্ছেন৷