দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৫: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সবার জন্য শিক্ষা এবং সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে আমরা অত্যন্ত সফল।দেশের ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে মানবসম্পদে রূপান্তরিত করে মানবপুঁজিতে উন্নীত করতে পারলে উন্নয়নের গতি আরও ত্বরান্বিত হবে। রাজধানীর ওসমানী মিলনায়তনে মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবসের উদ্বোধনকালে এসব কথা বলেন তিনি।দিবসটি পালনের ৫০তম বর্ষপূর্তিতে এবারের প্রতিপাদ্য হচ্ছে, সাক্ষরতা আর দক্ষতা, টেকসই সমাজের মূলকথা’।অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য দেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার, উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর মহাপরিচালক রুহুল আমিন সরকার, ঢাকায় ইউনেস্কোর আবাসিক প্রতিনিধি বিয়াট্রিস কালডুন প্রমুখ।স্বাগত বক্তব্য দেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব মেছবাহ উল আলম। খবর
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথির বক্তব্যে দেশকে নিরক্ষরতামুক্ত ও ১৬ কোটি মানুষকে মানবসম্পদে রূপান্তরের মাধ্যমে মানবপুঁজি হিসেবে গড়ে তোলার আহবান জানান প্রধানমন্ত্রী। সংশ্লিষ্টদের তিনি বলেন, উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা আইন-২০১৪ এর আলোকে যথাযথ কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করুন, ব্যাপক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করুন। আপনাদের সকল কাজে সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের সর্বোচ্চ সমর্থন ও সহযোগিতার দ্বার অবারিত থাকবে। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ হবে একটি উন্নত, সুখী-সমৃদ্ধ দেশ, বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশ মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা হিসাবে বিশ্বসভায় মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন শেখ হাসিনা।
যখনই একটি শিশুর ভর্তির বয়স হয়ে যাবে, সঙ্গে সঙ্গে তাকে স্কুলে ভর্তি করাতে হবে। এটা তার অধিকার। যে শিশুটি ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হবে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে তাকে ভর্তি হতে হবে কেন? ক্লাস ওয়ানে ভর্তি পরীক্ষার কড়া সমালোচনা করে কথাগুলো বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, শিশু যদি ছাপানো প্রশ্নপত্র পড়ে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার মতো জ্ঞানই অর্জন করে ফেলে, শিশুকে যদি লিখতে পড়তে শিখেই স্কুলে ভর্তি হতে হয়, তাহলে আর স্কুলে পড়াবে কি?শিশুদের ওপর বই এবং পড়াশোনাকে বোঝা হিসেবে চাপিয়ে না দিতে সবার প্রতি আহ্বান জানান শেখ হাসিনা।তিনি বলেন, বইয়ের বোঝা, তেমন পড়ার বোঝা এবং হোমওর্য়াক। এতো বেশি হোমওয়ার্ক দেওয়া হয় যে, যেদিন স্কুলে ঢুকলো তার পর দিনই স্কুল সর্ম্পকে শিশুদের ভীতি সৃষ্টি হয়ে যায়। এ বিষয়টাও একটু দেখা দরকার।একটা বাচ্চা ৫ বছর বয়সে স্কুলে গেলো, তখনই তাকে সব বিদ্যা শিক্ষা দিতে হবে তা নয়।
শিশুদের যেন পড়াশোনার প্রতি অনিহা সৃষ্টি না হয় বিষয়টি খেয়াল রাখার কথা বলে বলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাচ্চারা তাড়াতাড়ি শেখে। কিন্তু আগেই যদি বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে ধীরে ধীরে পড়াশোনার প্রতি একটা অনিহা সৃষ্টি হয়ে যেতে পারে। খেলাধুলার মধ্য দিয়ে শিক্ষার প্রতি শিশুদের আগ্রহ সৃষ্টি করতে হবে। শিক্ষক ও স্কুলের প্রতি তার যেন আগ্রহ সৃষ্টি হয় সেটা আগে তার মধ্যে সৃষ্টি করতে হবে।প্রধানমন্ত্রী সরকারি স্কুলগুলোকে অবকাঠামোগত ও শিক্ষার মানগত দিক থেকে আরো উন্নত করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন।এলাকাভিত্তিক সরকারি স্কুল করার প্রয়োজনীয়তার কথাও বলেন প্রধানমন্ত্রী।সরকারি স্কুল করতে জায়গার অভাব জানিয়ে তিনি বলেন, অনেকে বেসরকারি স্কুল করেছে, কিন্তু চালাতে পারছে না। কিন্তু ওই এলাকায় স্কুল নাই, এভাবে দেখে দেখে আমি মনে করি, প্রত্যেক এলাকাভিত্তিক স্কুল হওয়া দরকার।
দেশকে নিরক্ষরতামুক্ত ও ১৬ কোটি মানুষকে মানবসম্পদে রূপান্তরের মাধ্যমে মানবপুঁজি হিসেবে গড়ে তোলার আহবান জানান প্রধানমন্ত্রী। সংশ্লিষ্টদের তিনি বলেন, উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা আইন-২০১৪ এর আলোকে যথাযথ কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করুন, ব্যাপক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করুন। আপনাদের সকল কাজে সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের সর্বোচ্চ সমর্থন ও সহযোগিতার দ্বার অবারিত থাকবে। শেখ হাসিনা বলেন, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন ছিল সোনার বাংলা গড়ে তোলা। জাতির পিতা বিশ্বাস করতেন, একটি শিক্ষিত প্রজন্ম ছাড়া সোনার বাংলা গড়া সম্ভব নয়। তাই তিনি স্বাধীনতার পরপরই যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষাকে যুগোপযোগী করার জন্য ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। স্বাধীনতার মাত্র ৩ বছরের মাথায় ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা পাকিস্তানের শেষ বছরের তুলনায় ৫০ শতাংশ বেড়ে যায়।জাতির পিতা ১৯৭২ সালে কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী তিনি ৩৬ হাজার ১শ’ ৬৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ এবং ১ লাখ ৫৭ হাজার ৭শ’ ২৪ জন শিক্ষকের পদ সরকারিকরণ করেন। তিনি বলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার পর শিক্ষা কমিশনের অন্যান্য সুপারিশমালা আর বাস্তবায়িত হয়নি। শিক্ষাঙ্গনে নেমে আসে চরম নৈরাজ্য। দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালের সরকার পরিচালনার সময়ে আমাদের গৃহীত পদক্ষেপের ফলে সাক্ষরতার হার বেড়ে দাঁড়ায় ৬৫ শতাংশে। ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত সাক্ষরতা কর্মসূচির মাধ্যমে প্রায় ১ কোটি নিরক্ষরকে সাক্ষরতা প্রদান করা হয়। ৭টি জেলাকে নিরক্ষরমুক্ত ঘোষণা করা হয়। দেশে সাক্ষরতা বিস্তারে এ বিশাল অর্জনের সম্মানজনক স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ ‘ইউনেস্কো সাক্ষরতা পুরস্কার ১৯৯৮’ লাভ করে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় আসার পর বিশ্বব্যাংক উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রকল্পে সাড়ে ১২শ’ কোটি টাকা দেয়। এ প্রকল্পে ব্যাপক দুর্নীতির কারণে শেষ পর্যন্ত উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। ২০০৯ সালে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়ার পর আমরা এ কার্যক্রম আবার চালু করি।স্বাধীনতার পর জাতির পিতা ১৯৭৩ সালের ১ জুলাই দেশের প্রাথমিক শিক্ষাকে (প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত) সকলের জন্য অবৈতনিক এবং বাধ্যতামূলক করে যান। বঙ্গবন্ধু সরকারের ৩৬ হাজার ১শ’ ৬৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারিকরণ করে যাওয়ার ৪০ বছর পর আমাদের সরকারই ২০১৩ সালে দেশের ২৬ হাজার ১৯৩টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করেছে। একই সঙ্গে এসব বিদ্যালয়ের ১ লাখ ৩ হাজার ৮৪৫ জন শিক্ষকের চাকরি সরকারিকরণ করেছি।প্রধানমন্ত্রী বলেন,সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা এবং সবার জন্য শিক্ষার লক্ষ্য অর্জনে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী ২০১৫ সালের মধ্যে সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করার ঘোষণা থাকলেও ২০১১ সালের মধ্যে বিদ্যালয়ে গমনোপযোগী শতভাগ শিশুর বিদ্যালয়ে ভর্তি আমরা নিশ্চিত করেছি। প্রতি বছরের মতো এবারও বছরের শুরুতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিনামূল্যে ৩২ কোটি ৬৩ লাখ ৪৭ হাজার ৯২৩টি নতুন পাঠ্যবই বিতরণ করেছি। পাশাপাশি প্রাথমিক পর্যায়ে ছাত্র-ছাত্রীদের ঝরেপড়া রোধে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় উপবৃত্তি প্রদান করা হচ্ছে। মিড- ডে মিল চালু করা হয়েছে। আশির দশকে ঝরেপড়ার হার ৮০ শতাংশ থেকে কমিয়ে আমরা ২০.৯ শতাংশে নামিয়ে এনেছি বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী।তিনি বলেন, উপবৃত্তির সুবিধাভোগীর সংখ্যা বাড়িয়ে আমরা ৭৮ লাখ ১৭ হাজার ৯শ’ ৭৭ জনে উন্নীত করেছি। ৯৬টি দারিদ্র্যপীড়িত উপজেলার ২৯ লাখ শিক্ষার্থীদের মধ্যে পুষ্টিমান সম্পন্ন খাদ্য বিতরণ করা হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে প্রত্যেকটি স্কুলে মিড- ডে মিল চালুর ঘোষণাও দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।তিনি বলেন, অনুন্নত জনপদ এবং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী অধ্যুষিত ৫২টি জেলার ১শ’ ৪৮টি উপজেলায় আমরা ১ হাজার ১শ’ ৪০ কোটি ২৬ লখ টাকা ব্যয়ে ২১ হাজার ৬শ’ ২৩টি ‘আনন্দ স্কুল’ প্রতিষ্ঠা করেছি। ফলে, হতদরিদ্র ও ঝরেপড়ার শঙ্কাগ্রস্ত শিশুর প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
ক্ষুদ্র নৃ- গোষ্ঠির নিজস্ব বর্ণমালায় পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন এবং সংশ্লিষ্ট ভাষা জ্ঞানসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আমরা দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য ১ হাজার কোটি টাকার শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করেছি। নিরক্ষর জনগোষ্ঠীকে সাক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন, দক্ষ মানব সম্পদ হিসেবে গড়ে তুলতে ৪শ’ ৫২ কোটি টাকা ব্যয়ে বাংলাদেশ সাক্ষরতা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধীদের জন্য আলাদা শিক্ষা ব্যবস্থার উদ্যোগ নিয়েছি। প্রতিবন্ধীদের সক্ষমতা বিকাশে প্রতিবন্ধী স্কুল করেছি। পরীক্ষার ক্ষেত্রে তাদের আধা ঘন্টা সময় বাড়িয়ে দিয়েছি।সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ হবে একটি উন্নত, সুখী-সমৃদ্ধ দেশ, বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশ মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা হিসাবে বিশ্বসভায় মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের ছেলে-মেয়েরা যেন পড়তে পারে সেজন্য শহরের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো উন্নত করা দরকার
এ সময় অনুষ্ঠানমঞ্চে উপস্থিত প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার ও সচিব মেছবাহ উল আলমের দিকে তাকিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, আমি অনুরোধ করব, জরাজীর্ণ স্কুলগুলো মেরামত ও উন্নত করা দরকার। ছেলে-মেয়েরা তাদের প্রথম শিক্ষা পাড়ার স্কুল থেকেই নেবে, পাড়ার স্কুলেই ভর্তি হবে।শিশুরা যাতে স্কুলে আসতে আগ্রহী হয় সেজন্য আরও পদক্ষেপ নেওয়ার তাগিদ দেন শেখ হাসিনা।তিনি বলেন, এমন ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে অভিভাবকরা মনে করেন- এটা তাদের কর্তব্য; সন্তানকে শিক্ষা দিতে হবে।প্রাথমিক শিক্ষাকে মূল ভিত্তি হিসেবে ধরেই শিক্ষা কাঠামোকে এগিয়ে নেওয়ার উপরও প্রধানমন্ত্রী গুরুত্ব আরোপ করেন।