দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ৩১ আগস্ট: গত কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিতে নীলফামারী, ভোলা, রংপুর, কুড়িগ্রাম ও মুন্সিগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের নদ-নদীতে জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিভিন্ন এলাকায় বাঁধ ভেঙে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন লাখো মানুষ। পানিবন্দি এসব দুর্গত মানুষের দুর্ভোগ বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। প্রয়োজনীয় খাবার, বিশুদ্ধ পানি, ওষুধের অভাবে মানবেতর জীবনযাপন করলেও তাদের দেখার যেন সত্যিই কেউ নেই। এসব বানভাসি মানুষের দিন কাটছে অর্ধাহারে-অনাহারে। এর সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ছে পানিবাহিত রোগ। এদিকে, দেশের নদ-নদীর ৫৩টি স্থানে পানি বৃদ্ধি, ৩০টি স্থানে পানি হ্রাস পেয়েছে এবং ২০টি স্থানে বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সোমবার বলা হয়, ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং যমুনা নদীর পানি স্থিতিশীল রয়েছে। আগামী ৭২ ঘন্টায় ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি পেতে পারে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, গঙ্গা-পদ্মা নদীর পানি হ্রাস পাচ্ছে। এ ধারা আগামী ৪৮ ঘন্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। ঢাকা শহরের আশপাশের নদ-নদী এবং উত্তর পূর্বাঞ্চলের নদীগুলোর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে । আগামী ৭২ ঘন্টা এ ধারা অব্যাহত থাকতে পারে। এছাড়া আগামী ৪৮ ঘন্টায় দেশের উত্তর, মধ্য ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলাসমূহের কতিপয় স্থানের বন্যা পরিস্থ’তির অবনতি হতে পারে। বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ডালিয়ায় তিস্তার পানি বিপদসীমার ৩২ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। চকরহিমপুরে করতোয়ার পানি বিপদসীমার ২৬ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সারিয়াকান্দিতে যমুনার পানি বিপদসীমার ১১ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সিরাজগঞ্জে যমুনার পানি বিপদসীমার ১৬ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সিংড়ায় গুর নদীর পানি বিপদসীমার ৯ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
বাঘাবাড়িতে আত্রাই নদীর পানি বিপদসীমার ১৩২ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এলাসিন স্টেশনে ধলেশ্বরী নদীর পানি বিপদসীমার ৫৬ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। লাখপুর স্টেশনে লাক্ষা নদীর পানি বিপদসীমার ৩৮ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে, গোয়ালন্দে পদ্মার পানি বিপদসীমার ২৬ সেন্টিমিটার উপরে, ভাগ্যকূলে ৯ সেন্টিমিটার এবং সুরেশ্বরে ২০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ঝিকরগাছায় কপোতাক্ষ নদের পানি বিপদসীমার ২০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সুরমা নদীর পানি কানাইঘাট স্টেশনে বিপদসীমার ২৬ সেন্টিমিটার ও সুনামগঞ্জে ৩৮ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কুশিয়ারার পানি অমলশীদ স্টেশনে বিপদসীমার ৭৭ সেন্টিমিটার ও শেওলা স্টেশনে বিপদসীমার ৬০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পুরাতন সুরমা নদীর পানি দেরাই স্টেশনে বিপদসীমার ১২ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। যদুকাটা নদীর পানি লরেরগড় স্টেশনে বিপদসীমার ৮০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কংস নদীর পানি জারিয়াজঞ্জাইল স্টেশনে বিপদসীমার ৪৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তিতাস নদীর পানি ব্রাহ্মণবাড়িয়া স্টেশনে বিপদসীমার ১২ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৮৫টি পানি মনিটরিং স্টেশনের মধ্যে ৫৩টি স্থানে পানি বৃদ্ধি ও ৩০টি স্থানে পানি হ্রাস পেয়েছে। ২টি স্থানে পানির অবস্থান অপরিবর্তিত রয়েছে এবং ২০টি স্থানে পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
নীলফামারী : উজানের ঢলে তিস্তায় পানি বৃদ্ধির ফলে বন্যা কবলিত হয়ে পড়েছে তিস্তা অববাহিকার ২৫টি গ্রাম ও চর। নীলফামারীর ডিমলা ও জলঢাকা উপজেলার ১০ ইউনিয়ন ও লালমনিরহাট জেলার হাতিবান্ধা,কালিগঞ্জ উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নের সহ¤্রাধীক পরিবার বন্যা কবলিত হয়ে পড়েছে। ঘরবাড়িগুলো হাঁটু পানিতে তলিয়ে রয়েছে। ডালিয়া পাউবো বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও পুর্বাভাস সুত্র জানায়, উজানের ঢলে আজ সোমবার সকাল ৬টা থেকে নীলফামারীর ডালিয়ায় তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে তিস্তার পানি বিপদসীমার (৫২ দশমিক ৪০) ৩২ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হতে থাকে। এর আগে রবিবার সন্ধ্যা বিপদসীমার ১৩ সেন্টিমিটার ও রাত ৯টায় ২১ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তিস্তা ব্যারেজের সব কয়টি(৪৪টি) জলকপাট খুলে রাখা হয়েছে বলে জানান ডালিয়া পাউবো উপ সহকারী প্রকৌশলী সুরত উজ জামান। এদিকে তিস্তা পরিবেষ্টিত খালিশা চাঁপানী, ঝুনাগাছ চাঁপানী, খগাখড়িবাড়ি, পুর্ব ছাতনাই, নাউতারা, গয়াবাড়ি, জলঢাকা উপজেলার গোলমুন্ডা, শৌলমারীসহ লালমনিরহাট জেলার কয়েকটি ইউনিয়নের হাজারো পরিবার পানি বন্দি হয়ে পড়েছে। খালিশা চাপানী ইউনিয়নের বাইঁশ পুকুর ইউনিয়নের পশ্চিম বাইঁশপুকুর চরের সহিদুল ইসলাম জানান, চরের প্রতিটি বাড়ির ঘরের ভেতর পানি প্রবেশ করেছে। পুর্ব ছাতনাই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান প্রভাষক আব্দুল লতিফ খান বলেন তিস্তা বন্যা ভয়াবহ আকার ধারন করেছে।
ডিমলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রেজাউল করিম বলেন বন্যা কবলিত এলাকা গুলো মনিটরিং করা হচ্ছে এবং সরকারি ভাবে শুকনা খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বন্যা কইলত মানুষজন কে নিরাপদে রাখা ও তাদের সার্বক্ষনিক খোঁজখবর রাখতে জনপ্রতিনিধিদের বলা হয়েছে।
সাতক্ষীরা: আশাশুনি উপজেলার রুয়েরবিল এলাকায় কপোতাক্ষ নদের প্রায় ১০০ ফুট বেড়িবাঁধ প্রবল জোয়ারে ভেঙ্গে ৫০০ বিঘা মৎস্য ঘের ও একটি গ্রামের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। সোমবার ভোর রাতে উপজেলার প্রতাপনগর ইউনিয়নের রুয়েরবিল গ্রামে এ বেড়িবাধ ভেঙ্গে যায়। স্থানীয় চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে শতাধিক এলাকাবাসীর স্বেচ্ছাশ্রমে বেড়ি বাধটি সংস্কারের চেষ্টা চলছে। বাধ ভেঙ্গে যাওয়ার ফলে রুয়েরবিল গ্রামের নিম্নাঞ্চলের বেশ কিছু বাড়িঘর ও ৫০০ বিঘা মৎস্যঘের পানিতে প্লাবিত হয়েছে। বাধটি দ্রুত স্থায়ী ভাবে সংস্কার করা না হলে প্রতাপনগর ও শ্যামনগর উপজেলার পদ্মপুকুর ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হবে বলে আশংকা করছেন স্থানীয়রা।
স্থানীয় প্রতাপনগর ইউপি চেয়ারম্যান জাকির হোসেন জানান, কপোতাক্ষ নদের রুয়েরবিল এলাকার বেড়িবাঁধ দীর্ঘদিন ধরে জরাজীর্ণ অবস্থায় ছিল। পানি উন্নয়ন বোর্ডকে বার বার বলা সত্বেও তারা সংস্কারের উদ্যোগ না নেয়ায় রাতে প্রায় ১০০ ফুট এলাকা জুড়ে ভেঙ্গে নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। সেখানে শতাধিক এলাকাবাসীদের নিয়ে বাধটি সংস্কারের চেষ্টা চলছে। তিনি আরো জানান, রিং বাধটি সংস্কার করা না গেলে পরবর্তী জোয়ারে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হবে। এদিকে, আশাশুনি উপজেলার জেলেখালী, দয়ারঘাট ও মনিপুর এলাকার বেড়িবাধেও ভয়াবহ ভাঙন দেখা দিয়েছে। যে কোন মুহুর্তে সেখানে বেড়িবাধ ভেঙ্গে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হওয়ার আশংকায় স্থানীয় লোকজন আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন।
ফরিদপুর :টানা বর্ষণ ও নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে মরিচ ক্ষেতে পানি ঢুকে জমে থাকায় অনেক ক্ষেতে মরিচ গাছ মারা গেছে। ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলায় প্রচুর মরিচ চাষ হয়। এ উপজেলা থেকে প্রতিবছরই দেশের বিভিন্ন স্থানে মরিচ যায়। ফরিদপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক জি এম আবদুর রউফ জানান, চলতি মৌসুমে জেলায় ৩ হাজার ৮৪০ হেক্টর জমিতে মরিচ আবাদ হয়েছে। আবাদের লক্ষমাত্রা ছিল ৩ হাজার ৯৫৫ হেক্টর।
তিনি বলেন, জেলার মধ্যে মধুখালী, সদরপুর ও ভাঙ্গা উপজেলায় মরিচের আবাদ বেশি হয়। কিন্তু এবার অতিবৃষ্টি আর নদ-নদীর পানি বৃদ্ধির ফলে মরিচ চাষিদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। জেলার মধুখালী উপজেলাতে সবচেয়ে মরিচের আবাদ বেশি হয়। মধুখালীর কাটাখালী, মেগচামী, খালকুলা, বাগাট, কোরকদি, চানপুর গ্রামের বেশিরভাগ কৃষি জমিতেই মরিচ আবাদ করা হয়।এই উপজেলার চাষিদের বেঁচে থাকার প্রধান অবলম্বনই মরিচ চাষ। এ বছর ভাল ফলন হলেও বৃষ্টিপাত ও নদ-নদীর পানি প্রবেশ করার কারনে মরিচ গাছ মারা যাওয়ায় কৃষকদের লোকসান গুনতে হচ্ছে।
মধুখালীর কোরকদি এলাকার মরিচ চাষি হাফিজার মুন্সি, মোতালেব শেখ, হরিপদ রায়সহ আরো অনেকেই জানান, তাদের এলাকাতে এই মৌসুমের প্রধান ফসল মরিচ। এই মরিচ চাষের উপরই তাদের সংসার চলে। কিন্তু বৃষ্টির পানি ক্ষেতে প্রবেশ করায় এখন গাছগুলো মরে গেছে।কোরকদি ইউনিয়নের নব-নির্বাচিত ইউপি চেয়াম্যান মুকুল হোসেন বলেন, আমার ইউনিয়নের চাষিরা মরিচের উপর বেশি নির্ভরশীল। কিন্তু পানির কারণে এই ইউনিয়নের ৭০ ভাগ মরিচ গাছ মারা গেছে। এতে কৃষকের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।এদিকে বন্যার পানিতে জেলার সদরপুর ও চরভন্দ্রাসন উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের ৮০ ভাগ তলিয়ে যাওয়ায় সেখানকার চাষিদেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এই দুই উপজেলার প্রায় ৭শ’ হেক্টর ক্ষেতের মরিচ গাছ মরে গেছে বলে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।
রংপুর: চলতি মাসের শুরুতে বৃষ্টির অভাবে উত্তরাঞ্চলে ধানের জমিতে সেচ দিতে দেখা গেছে। এমনকী বৃষ্টি প্রার্থনায় ব্যাঙের বিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে। কিন্তু বিধিবাম! মাসের শেষ দিকে উত্তরাঞ্চলের রংপুরে শুধু বৃষ্টিই নামলো না, অতিবৃষ্টিতে তৈরি হলো জলাবদ্ধতাও। বেড়ে ওঠা লক্ষাধিক হেক্টরের ধান প্লাবিত হলো। ফলন ঘরে তুলে খোরাক নিশ্চিতের পর অবশিষ্ট ধান বিক্রির টাকা দিয়ে আলু চাষের স্বপ্ন দেখা চাষিরা এখন সংকটের মধ্যে দিন পার করছেন। সব মিলিয়ে গত দুইদিনের অতিবৃষ্টিতে রংপুর অঞ্চলের কৃষির চিত্রটিই পাল্টে গেছে। মাঠে থাকার কথা ধানগাছের সবুজের সমারোহ। কিন্তু আছে হলুদ ও মরা ধানগাছ। স্বপ্ন ছিল সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার, তা পরিণত হলো দুঃস্বপ্নে।গত বছরও রংপুর অঞ্চলে খাদ্যশস্যের উদ্বৃত্তের পরিমাণ ছিল ১৫ লাখ ২৬ হাজার ৬৬৭ মেট্রিক টন। এর মধ্যে ৬০ থেকে ৭০ ভাগই ছিল ধান। কিন্তু বর্তমানে দেশের খাদ্য নিরাপত্তার অগ্রণী সৈনিক ধানচাষিরা এখন নিজেদের খোরাক মেটানো নিয়ে শঙ্কায় পড়েছেন।
সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকা, অপরিকল্পিতভাবে বাঁধ দিয়ে মাছচাষ ও রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট নির্মাণের কারণেই গত কয়েকদিন বিশেষ করে ২১ ও ২২ আগস্ট এ দুদিনের অতিবৃষ্টিতে তৈরি হয়েছে ব্যাপক জলাবদ্ধতা। রবি ও সোমবার রংপুর কৃষি অঞ্চলে সরেজমিন ও কৃষি অফিস সূত্রে এ চিত্রই উঠে আসে।সরেজমিন পীরগাছা, কাউনিয়া, সদরসহ বিভিন্ন উপজেলায় দেখা গেছে, রোপা আমন ধানচাষিরা একেবারেই হতাশ হয়ে পড়েছেন। কেউ কেউ মনের ক্ষোভে আর জমিতেই যাচ্ছেন না। অনেকেই যে সব জমি থেকে পানি নেমে গেছে, সে সব জমির পরিচর্যা করে ক্ষতির হাত থেকে কিছুটা রেহাই পাওয়ার সংগ্রাম করে যাচ্ছেন।চাষিরা জানান, অধিকাংশই চাষিই জমি বর্গা করে ধান চাষ করেছেন। কিন্তু তারা এ বছর নিঃস্ব হয়ে যাবেন। সে কারণে সরকার তাদের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়ালে হয়ত এবারের মতো ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন তারা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর (ডিইএ), রংপুর আঞ্চলিক অফিস সূত্র জানায়, এ অঞ্চলের রংপুর সদর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, নীলফামারী ও লালমনিরহাট জেলায় গড়ে গত ২১ আগস্ট ১৩৭ ও ২২ আগস্ট ১৩৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। অথচ স্বাভাবিকভাবে আগস্ট মাসে এ অঞ্চলে সাধারণত ৫০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে।ডিইএ, রংপুর আঞ্চলিক অফিসের অতিরিক্ত পরিচালক মো. মহসিন বলেন, পানি নিষ্কাশনের সঠিক ব্যবস্থাপনা থাকলে গত দুই/তিনদের অতিবৃষ্টিতে এত বড় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হতো না। পানি নেমে যেতো। এতে ক্ষতির পরিমাণ অনেকটাই কম হতো।এ বিষয়ে পীরগাছা উপজেলার শুল্লিপাড়া গ্রামের ৭৩ বছর বয়সী ক্ষতিগ্রস্ত ধানচাষি ইমাম হোসেন বলেন, ৮৭ ও ৮৮ সালে এ রকম সমস্যায় পড়েছিলেন তারা। এছাড়া ২০০১ সালের দিকেও অনেক বৃষ্টিপাত হয়। কিন্তু তাদের এমন ক্ষতি হয়নি। এখন তো পানি বের হয়ে যাওয়ার কোনো রাস্তাই নেই।
তিনি জানান, অনেকদিন পরে এতবড় ধাক্কায় তাদের মতো তৃণমূল চাষিরা একেবারেই নিঃস্ব হয়ে পড়বেন। অধিকাংশই চাষিই ঋণ নিয়ে ধান চাষ করেছেন। তারা সহজে এ ধকল কাটিয়ে উঠতে পারবেন না। জমি বর্গা করে ধান চাষ শুরু করেছিলেন কাউনিয়া উপজেলার ধানচাষি খয়েরুজ্জামান। তিনি জানান, তার প্রায় সব ধানের চারাই নষ্ট হয়ে গেছে। ৬০ শতাংশ জমিতে ইতোমধ্যে ছয় হাজার টাকাও খরচ হয়েছে। ফলন ঘরে তুলে সারাবছরের খোরাকটা অন্তত নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তা আর হলো না।
মুকসুদ খাঁ, মিয়াপাড়া, কুইকুড়ি, মংলাকুটি, আটশট্রিপাড়া, ওমর খাঁ, চরাবাড়ি, পাটোয়াগাড়িসহ আশপাশের সব এলাকাতেও ধান চারার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে বলে জানালেন চাষিরা।বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, আঞ্চলিক কার্যালয় রংপুর প্রধান কর্মকর্তা ড. মো. শহিদুল ইসলাম জানান, অতিবৃষ্টিতে প্লাবিত এলাকায় ২০ থেকে ২৫ দিনের বয়সের চারার ধানের বেশি ক্ষতি হয়েছে। আর ৩০ থেকে ৩৫ বয়সী চারার ক্ষতি অনেকাংশ কম।এ অঞ্চলে মোট আবাদি জমির পরিমাণ সাত লাখ ৪৫ হাজার ২৭৮ হেক্টর। চলতি মৌসুমে রোপা আমন ধান লাগানো হয়েছে পাঁচ লাখ ৮২ হাজার ৯৬৫ হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে এক লাখ ২৭ হাজার ৯৪৫ হেক্টর জমির ধান প্লাবিত হয়। আর তিন হাজার ১৯৯ হেক্টর সবজি, ৯০ হেক্টর কলা ও ২০৫ হেক্টর বীজতলা পানিতে প্লাবিত হয়েছে। সরেজমিন অন্তত ৩৫ জন কৃষকের সঙ্গে কথা হয়। সব চাষিদের একটাই দাবি, ক্ষতিগ্রস্ত চাষিদের জন্য কী করা উচিত, সে বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে সরকারকে।
মুন্সীগঞ্জ: মুন্সীগঞ্জের পদ্মা নদীতে পানি কমতে শুরু করেছে। এতে বিপদসীমার ৯ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে পানি। সোমবার দুপুরে শ্রীনগরের ভাগ্যকূল পয়েন্টে পানি ১১ সেন্টিমিটার কমে বিপদসীমার ৯ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, শনিবার ভাগ্যকূল পয়েন্টে পানি বিপদসীমা ৬ দশমিক ৩০ সেন্টিমিটার অতিক্রম করে ৬ দশমিক ৫০ সেন্টিমিটার উচ্চতায় প্রবাহিত হয়। রোববার থেকে পদ্মার পানি কমতে শুরু করে। দুই দিনের ব্যবধানে ১১ সেন্টিমিটার পানি কমে বর্তমানে বিপদসীমার ৬ দশমিক ৩৯ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ভোলা: উজান থেকে আসা ঢল ও পূর্ণিমায় সৃষ্ট জোয়ারের প্রভাবে ভোলায় মেঘনা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৫৩ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
এতে তলিয়ে গেছে জেলার অন্তত ৩০টি গ্রাম। বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, স্কুল, পুকুর ও ফসলের ক্ষেতসহ বিভিন্ন স্থাপনা তলিয়ে যাওয়ায় পানিবন্দি জীবন কাটাচ্ছেন লাখো মানুষ। সোমবার দুপুরের পর মেঘনার পানি বিপদসীমার ৫৩ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এটি গত ১৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ বলে জানা গেছে। ভোলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুল হেকিম এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।এদিকে, নদীতে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় তলিয়ে গিয়েছে নদীর আশপাশ ও নিম্নাঞ্চলের অন্তত ৩০টি গ্রাম।
প্লাবিত গ্রামগুলোর মধ্যে রয়েছে সদর উপজেলার ধনিয়া ইউনিয়নের কালাতীর্তি, কালাসুরা, হেতমারহাট, রামদাসপুর, পূর্ব ইলিশা, মাঝের চর, দৌলতখান উপজেলার হাজিপুর, সৈয়দপুর, মেদুয়া, মদনপুর, নেয়ামতপুর, বোরহানউদ্দিন উপজেলার বড় মানিকা, তজুমদ্দিন উপজেলার চর জহির উদ্দিন, মলংচড়া, মনপুরা উপজেলার উত্তর সাকুচিয়া, দক্ষিণ সাকুচিয়া, হাজিহাট, মনপুরা, লালমোহন উপজেলার চর কচুয়াখালী, লর্ডহাডিঞ্জ এবং চরফ্যাশন উপজেলার চর কুকরী-মুকরী, ঢালচর, জাহানপুর, মাদ্রাজ, নজরুল নগর, চর পাতিলা।এসব এলাকার অধিকাংশ মানুষ পানির হাত থেকে বাঁচতে উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছেন।
চর কুকরী-মুকরী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবুল হাসেম মহাজন জানান, এখন মেঘনায় সর্বোচ্চ জোয়ার বইছে। এতে পুরো এলাকার এক-তৃতীয়াংশ ডুবে আছে।ধনিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এমদাদ হোসেন কবির জানান, ভোরে বাঁধ ভেঙে তার এলাকার ৩ শতাধিক ঘরবাড়ি প্লাবিত হয়েছে।ইলিশার বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন জানান, জোয়ারের পানিতে রাজাপুর গুচ্ছগ্রাম, পূর্ব ইলিশা, কালুপুর, মুরাদ শফিউল্ল্যাহ, তালতলি, আদর্শ গ্রাম ডুবে গেছে। এতে ১২ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। এদিকে, পানিতে ঘের, পুকুরের মাছ ও গৃহপালিত পশু-পাখি ভেসে গেছে, নষ্ট হয়েছে ফসলের জমি।
খুলনা: কয়েকদিন ধরেই খুলনা অঞ্চলের নদ-নদীতে জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিভিন্ন এলাকায় বাঁধ ভেঙে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন লাখো মানুষ। পানিবন্দি এসব দুর্গত মানুষের দুর্ভোগ বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। প্রয়োজনীয় খাবার, বিশুদ্ধ পানি, ওষুধের অভাবে মানবেতর জীবনযাপন করলেও তাদের দেখার যেন সত্যিই কেউ নেই।এসব বানভাসি মানুষের দিন কাটছে অর্ধাহারে-অনাহারে। এরসঙ্গে ছড়িয়ে পড়ছে পানিবাহিত রোগ। বেড়িবাঁধ ভেঙে জেলার তিনটি উপজেলার প্রায় লাখো মানুষ পানিবন্দি জীবন কাটাচ্ছেন। নিম্নআয়ের বেশিরভাগ মানুষ রয়েছেন অর্ধাহারে-অনাহারে। জোয়ার ও বন্যার পানিতে হাজারো নলকূপ ডুবে থাকায় বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট চলছে।বানভাসিদের অভিযোগ, পানিতে ডুবে যাচ্ছি, অথচ একবারের জন্যও কেউ খোঁজ নিচ্ছে না। দিচ্ছে না একটু ত্রাণ। অর্ধাহারে-অনাহারে পানিতে নিমজ্জিত ঘরের মধ্যে পরিবারসহ বন্দি।তবে স্থানীয় প্রশাসন বলছে, সাধ্যানুযায়ী দুর্গতদের সহযোগিতা ও বাঁধ মেরামতের কাজ করা হচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জেলার কয়রায় পানি উন্নয়ন বোর্ড’র (পাউবো) বাঁধ ভেঙে তিন শতাধিক পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।স্থানীয়রা জানান, উত্তর বেদকাশি ইউনিয়নে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) ১৪/১ নম্বর পোল্ডারের প্রায় ৫শ’ ফুট বাঁধ ভেঙে গেছে। এতে জোয়ারের পানি প্রবেশ করায় ৩০টি মুণ্ডা পরিবারসহ তিন শতাধিক পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। শনি ও রোববার ভাটার সময় বাঁধে আকস্মিক ভাঙন দেখা দেয়। পরে রাতে জোয়ারে বাঁধের ভাঙা অংশ দিয়ে পানি ঢুকে নোনা পানিতে তলিয়ে গেছে বেশ কয়েকটি চিংড়ি ঘের, আমন ফসল ও ঘরবাড়ি।
ইউনিয়নের হরিহরপুর গ্রামের বাসিন্দা বাসুদেব বলেন, গত কয়েকদিনের প্রবল জোয়ারের পানিতে বাঁধ ভেঙে গেছে। বাঁধ রক্ষায় গ্রামবাসী প্রাণপন চেষ্টা করেছি। কিন্তু কাজ হয়নি।তিনি জানান, আকস্মিক বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় ইউনিয়নের হরিহরপুর গ্রামের ৩০টি মুণ্ডা-মাহাতো পরিবারসহ তিন শতাধিক পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। তারা উঁচু রাস্তা ও স্থানীয় সাইক্লোন শেল্টারে আশ্রয় নিয়েছে।
৭ নং দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়ন পরিষদের ৩ নং ওয়ার্ড ইউপি সদস্য গাজী বেলাল হোসেন সোমবার (৩১ আগস্ট) জানান, জোয়ারের তোড়ে কয়রা উপজেলার বিভিন্ন স্থানে বাঁধ ভেঙে প্রায় ২০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। এসব মানুষের মধ্যে বিপর্যয়ে পড়েছেন নিম্নআয়ের মানুষরা।
তিনি অভিযোগ করেন, কয়রার বানভাসি দুর্গত মানুষরা কোনো ত্রাণ পাননি। তবে ৮ নং দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়ন পরিষদের পানি উন্নয়ন বোর্ডের ওয়াবদার ২৭ কি. মি. বাঁধের ১৭টি জায়গা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। যেকোনো সময় বাধঁ ভেঙে মহাবিপর্যয় ঘটতে পারে।এয়াড়া জেলার ডুমুরিয়ার চাঁদগড় এলাকায় ফের ভাঙন শুরু হয়েছে। স্থানীয়রা জানান, ডুমুরিয়ার চাঁদগড় বেড়িবাঁধ মেরামতের একমাস পর ফের ভাঙন দেখা দিয়েছে। প্রবল জোয়ারের চাপে রোববার (৩০ আগস্ট) সকালে বাঁধ ভেঙে জোয়ারের পানি গ্রামে প্রবেশ করেছে। এতে স্কুল, মাদ্রাসাসহ ৩টি গ্রাম ফের প্লাবিত হয়েছে। এলাকাবাসীর অনেকে আশ্রয় নিয়েছেন বেড়িবাঁধের ওপর। চাঁদগড়া এলাকার বাসিন্দা রবিউল জানান, পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ায় উপজেলার চাঁদগড়া, আখড়া ও বাহির আখড়া প্লাবিত হয়েছে। এদিকে জেলার রূপসায় উপজেলায় পূর্ণিমার জোয়ারে পানির প্রবল চাপে ‘আঠারো বেঁকী’ নদী সংলগ্ন ওয়াপদা বেড়িবাঁধ ভেঙে যাওয়ায় নৈহাটী ইউনিয়নের শ্রীরামপুরসহ আইচগাতী ইউনিয়নের ৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ফলে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন প্রায় ৩০ হাজার মানুষ।