দৈনিকবার্তা-সিলেট, ৩০ আগস্ট: সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত শিক্ষকদের ওপর হামলা চালিয়েছে ছাত্রলীগ। এ সময় ছাত্রলীগের হামলায় অধ্যাপক ড. জাফর ইকবালসহ ১০ জন শিক্ষক লাঞ্ছিত হয়েছেন। রোববার সকাল ৮টায় উপাচার্য ভবনের সামনে এ ঘটনা ঘটে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সকাল ৯টা থেকেই উপাচার্য ভবনের সামনে অবস্থান কর্মসূচি ছিল আন্দোলনকারী মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ শিক্ষক পরিষদের। সকাল ৬টা থেকেই উপাচার্য ভবনের সামনে অবস্থান নেয় ছাত্রলীগ। পরে সকাল ৭টায় আন্দোলনকারী শিক্ষকরা উপস্থিত হলে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে বাক-বিতণ্ডা হয়। এসময় ছাত্রলীগ কর্মীরা নিজেদের সাধারণ শিক্ষার্থী বলে দাবি করলেও ছাত্রলীগ সহ-সভাপতি আবু সাঈদ আকন্দ, সহ-সভাপতি অনজন রায় ও যুগ্ম সম্পাদক সাজিদুল ইসলাম সবুজ উপস্থিত ছিলেন।
সকাল ৮টায় উপাচার্য তার কার্যালয়ে উপস্থিত হলে উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। আন্দোলনকারী শিক্ষকরা এ সময় উপাচার্যকে তার কার্যালয়ে প্রবেশ করতে বাঁধা দিতে চাইলে ছাত্রলীগ কর্মীরা উপাচার্যকে নিয়ে তার কার্যালয়ে প্রবেশ করেন। এ সময় ছাত্রলীগ কর্মীরা শিক্ষকদের ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। পরে আন্দোলনকারী শিক্ষক ড. জাফর ইকবালের সহধর্মিনী ড. ইয়াসমীন হক, মো. ইউনুছ, দীপন দেবনাধ, সৈয়দ সামসুল আলম, মো. ফারুক উদ্দিন, মোস্তফা কামাল মাসুদ, মোহাম্মদ ওমর ফারুকসহ অন্য শিক্ষকদের লাঞ্ছিত করে ছাত্রলীগ কর্মীরা। বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর, সহকারী প্রক্টর ও পুলিশ প্রশাসনের উপস্থিতিতেই এ ঘটনা ঘটে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে জালালাবাদ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আখতার হোসেন কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। আন্দোলনরত অন্তত সাতজন শিক্ষক সরকারসমর্থক এই ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীদের মারধরের শিকার হয়েছেন বলে দাবি করেছেন ‘মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ শিক্ষক পরিষদের’ আহ্বায়ক অধ্যাপক সৈয়দ সামসুল ইসলাম।
রোববার সকাল ৯টা থেকে ৫টা পর্যন্ত প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালনের ঘোষণা ছিল গত কয়েক মাস ধরে আন্দোলনরত শিক্ষকদের এই সংগঠনের।উপাচার্য আমিনুল হক ভূইয়া একই দিনে বিকাল ৩টায় অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের বৈঠক ডাকলে বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন করে উত্তেজনা তৈরি হয়।এরইমধ্যে উপাচার্যকে সমর্থন দিয়ে আসা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ভোর সাড়ে ৫টার দিকে প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবস্থান নেয়। আন্দোলনরত শিক্ষকরা ব্যানার নিয়ে সেখানে যান সকাল সাড়ে ৭টার দিকে।
সকাল ৮টা ২৫ মিনিটে উপাচার্য প্রশাসনিক ভবনের সামনে এলে ছাত্রলীগ কর্মীরা ব্যানার কেড়ে নেয় এবং শিক্ষকদের গলা ধাক্কা দিয়ে এবং মারধর করে সরিয়ে দেয়। এ ফাঁকে উপাচার্য ভবনে ঢুকে দোতলায় নিজের কার্যালয়ে চলে যান। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি সঞ্জীবন চক্রবর্তী পার্থ ও সাধারণ সম্পাদক ইমরান খানকে এ সময় হাত বিশেক দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। সিনিয়র সহসভাপতি আবু সাঈদ, সহ সভাপতি অঞ্জন রায় ও সিনিয়র যুগ্ন সম্পাদক সাজেদুল ইসলাম সবুজ হামলায় অংশ নেন।
ছাত্রলীগ কর্মী ধনী রাম রায়, আব্দুল বাতেন তন্ময়, আরিফুর রহমান রনি, আব্দুস সালাম মঞ্জু, কামরুল ইসলাম, জুয়েল, আরিফুর রহমান কেনেডি, ফয়সাল আহমদ, তমালও জাহিদকেও প্রতক্ষভাবে হামলার অংশ নিতে দেখা যায়।উপাচার্যপন্থি হিসেবে পরিচিত প্রক্টর অধ্যাপক কামরুল হাসান ও ছাত্র কল্যাণ উপদেষ্টা অধ্যাপক রাশেদ তালুকদারও এ সময় দূরে দাঁড়িয়েছিলেন। তবে তারা কেউ ছাত্রলীগ কর্মীদের ঠেকানোর চেষ্টা করেননি। জালালাবাদ থানার ওসি আক্তার হোসেন দুই পক্ষের মাঝখানে দাঁড়িয়ে হাত জোড় করে পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করলেও ছাত্রলীগ কর্মীদের কাছে পাত্তা পাননি তিনি।শিক্ষকদের ওপর হামলাকারীরা এ সময় স্লোগান দেন- শাবিপ্রবির মাটি/ছাত্রলীগের ঘাঁটি’।উপাচার্য ভেতরে ঢুকে যাওয়ার পর ছাত্রলীগ কর্মীরা শিক্ষকদের প্রশাসনিক ভবনের সামনে থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে নতুন করে ধস্তাধস্তি শুরু হয়। তাদের ধাক্কায় অধ্যাপক ইয়াসমিন হক মাটিতে পড়ে যান। এক ছাত্রলীগ কর্মীকে এ সময় এক শিক্ষকের গায়ে লাথি মারতেও দেখা যায়। আন্দোলনরত শিক্ষকদের নেতা অধ্যাপক সৈয়দ সামসুল ইসলাম পরে বলেন, আমাদের ওপর ছাত্রলীগ হামলা করেছে। আমাদের অন্তত সাতজন আহত হয়েছেন। উপচার্য ছাত্রদেরকে আমাদের ওপর লেলিয়ে দিয়েছে।তিনি নিজে এবং অধ্যাপক ইয়াসমিন হক ছাড়াও মারধরের শিকার শিক্ষকদের মধ্যে রয়েছেন শিক্ষক সমিতির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউনূস, বর্তমান সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আবদুল গণি, অধ্যাপক এ ন ক সমাদ্দার, মোস্তফা কামাল মাসুদ, সহযোগী অধ্যাপক মো. ফারুক উদ্দিন।ইয়াসমিন হক সাংবাদিকদের বলেন, এই যে পরিবেশ নষ্ট করা হল, এর জন্য ভাইস চ্যান্সেলরই দায়ী থাকবেন।সকালে হামলা করার জন্য উপাচার্য ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের নিয়ে রাতে বৈঠক করেন বলেও অভিযোগ করেন পদার্থবিদ্যার এই শিক্ষক।অন্যদিকে উপাচার্য আমিনুল হক ভূইয়া বলেন, শিক্ষকরা তাকে কার্যালয়ে ঢুকতে বাধা দেওয়ার কারণেই এ ঘটনা ঘটেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জালালাবাদ থানার ওসি আক্তার হোসেন বলেন, আপনারা তো সবই দেখছেন। আমি এ বিষয়ে কিছু বলব না। নো কমেন্টস।শিক্ষকদের মারধরের বিষয়ে দুষ্টি আকর্ষণ করলে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি পার্থ বলেন, বাধা দেওয়ার বিষয়টি সাংগঠনিক কোনো সিদ্ধান্ত না। যারা যার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তে এতে অংশ নিয়েছে।শিক্ষকদের ওপর হামলার খবর ও ছবি সংগ্রহ করতে গিয়ে কয়েকজন সাংবাদিককেও ছাত্রলীগ কর্মীদের হাতে লাঞ্ছিত হতে হয়। যমুনা টেলিভিশনের সিলেট ব্যুরো প্রধান মাহবুবুর রহমান রিপন বলেন, সারা দেশে সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় ছাত্রলীগ নেতাদের বিচার না হওয়ায় আজ তারা এ ঘটনা ঘটাল।সাংবাদিক লাঞ্ছিত করার ঘটনায় প্রতিবাদ জানিয়ে এ সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করেছে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রেসক্লাব। দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদ ও জনপ্রিয় লেখক অধ্যাপক জাফর ইকবাল বলেছেন, যে জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, সে স্লোগানের এতো বড় অপমান আমার জীবনে দেখিনি। আমি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ, যেখানে ছাত্রলীগ হামলা করে, তারা জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে হামলা করেছে।তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, হামলাকারীরা যদি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হয়ে থাকে তাহলে এর শিক্ষক হিসেবে আমার গলায় দড়ি দিয়ে মরে যাওয়া উচিৎ।
আন্দোলনরত শিক্ষকদের উপর ছাত্রলীগের হামলার পর এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি এ কথা বলেন।
অধ্যাপক জাফর ইকবাল বলেন, আমি সরাসরি শিক্ষকদের আন্দোলনে অংশ নিচ্ছি না,কিন্তু আন্দোলনকারীদের প্রতি আমার মায়া, ভালোবাসা আছে। তারা যে কারনে আন্দোলন করছে আমি তা ১০০ ভাগ সমর্থন করি। কারণ এই উপাচার্য আসার দুমাস পর আমি কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছি, কারণ আমি দেখেছি যে উনি মিথ্যা কথা বলেন। যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা বলেন তার সাথে আমার পক্ষে কাজ করা সম্ভব নয়।আমি চেয়েছি, যা হয় আমার চোখের সামনে হোক। আজকে আমার জীবনে একটা নতুন অভিজ্ঞতা হলো। আজকে যা দেখলাম, আমার জীবনে এ ধরনের ঘটনা দেখবো তা আমি কখনও বিশ্বাস করিনি।আমি এখনই গলায় দড়ি দিয়ে মরছি না, কিন্তু আমি তীব্র মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছি, এমন মন্তব্য করে জাফর ইকবাল বলেন, আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা শিক্ষকদের লাঞ্ছিত করলো, আমাকে সেটা এখানে বসে বসে দেখতে হলো।উপাচার্যই ছাত্রলীগের কর্মীদের ব্যবহার করেছেন, এমন অভিযোগ এনে তিনি বলেন, উপাচার্য যদি মনে করেন এভাবে আন্দোলন থামানো সম্ভব, তাহলে সেটা ভুল করছেন।‘শিক্ষকরা আন্দোলন করছেন কোন পদের জন্যে নয়, শাবিকে বাঁচানোর জন্যে,’বলেন জাফর ইকবাল।তিনি বলেন, আমি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ জেনে যে, ছাত্রলীগ হামলা করে আর উপাচার্য তাদের মদদ দেন। আমার খুব কষ্ট লেগেছে, যখন ছাত্রলীগের ছেলেরা জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে হামলা করেছে। যে জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, এ স্লোগানের এতবড় অপমান আমার জীবনে দেখিনি।