দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ২৯ আগস্ট, ২০১৫: বাংলাদেশের ইতিহাসের সব থেকে ‘শক্তিশালী’ তথা ক্ষমতাধর সরকার এখন দেশ শাসন করছে। বলা চলে কঠোরহস্তে দেশ শাসন করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার দৃঢ়তা ও কঠোরতার ব্যখ্যা করতে গিয়েই হয়তো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াসেফ ওসমান বলেছেন, মন্ত্রিসভায় একমাত্র পুরুষ শেখ হাসিনা। তিনি না বললেও অচিরেই হয়তো এক সময় কোন মন্ত্রী অথবা সরকারি দলের কোন নেতা ঠিকই শেখ হাসিনাকে ‘আয়রণ লেডি’ বলে অভিহিত করবেন। দেশি-বিদেশি সকল চাপ উপেক্ষা করে প্রকৃতপক্ষে তিনি বেশ শক্ত হাতেই দেশ শাসন করায় বাস্তবে তিনি ‘আয়রন লেডি’ই।
দেশের বিরাজমান অবস্থাই প্রধানমন্ত্রীকে শক্ত হাতে দেশ শাসনের সুযোগেএনে দিয়েছে। এখন সংসদে যারা বিরোধী দল তারাই আবার সরকারের অংশ। সরকার এখন প্রকৃত বিরোধী দলমুক্ত বাংলাদেশে একের পর এক ফাঁকা মাঠে গোল দিয়ে চলেছেন। সরকারের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি দীর্ঘ প্রায় ৯ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকায় এবং খুব শিগগিরই ক্ষমতায় যাবার সম্ভাবনা না দেখে দিশেহারা। সাংগঠনিকভাবে বিএনপির সক্রিয়তা বা অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। টেলিভিশন ও সংবাদপত্রে দলটির আন্তর্জাতিক সম্পাদক ড. আসাদুজ্জামান রিপনের ‘প্রেস ব্রিফিং’ দেখে ধরে নেয়া যায় যে, দলটি এখনও পুরোপুরি নি:শেষ হয়ে যায়নি। দলটি এখন জাতীয়তাবাদী ‘প্রেস ব্রিফিং’ পার্টিতে পরিনত হয়েছে। এরকম একটি অনুকূল অবস্থায় প্রতিপক্ষের অনুপস্থিতিতে সরকারি দলের সন্ত্রাসী ও মাস্তান বাহিনী নিজেদের মধ্যে চাঁদাবাজি আর টেন্ডারবাজির ভাগাভাগি নিয়ে রক্তক্ষয়ী হানাহানিতে লিপ্ত হয়েছে। মাগুরায় মাতৃগর্ভে অনাগত সন্তোনের গুলিবিদ্ধ হওয়া এবং বিভিন্ন স্থানে নিজেদের মধ্যে গোলাগুলিতে একের পর এক নিজ দলের কর্মী নিধনে সরকারের ভাবমূর্তি চরমভাবে বিনষ্ট হয়েছে। এ নিয়ে দলের মধ্যে নানা কথা বলা বলি শুরু হয়েছে।
দেশে বর্তমানে কার্যকর কোন বিরোধী দল না থাকায় সরকারের সঙ্গে সংসদের বিরোধীদলের দ্বন্দ্ব না থাকায় সরকারি দলের সন্ত্রাসীরা নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়েছে। সরকারের ভেতরে চাওয়া-পাওয়া থেকে সৃষ্ট অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে সরকারি দলের লোকজন পরস্পর দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়েছেন। আর অস্থিরতার জন্ম সেখান থেকেই। এখন যেটা দেশের নানাস্থানে নানাভাবে বিস্ফোরিত হচ্ছে। বাধ্য হয়েই সরকার বেপরোয়া দলীয় সন্ত্রাসীদের দমনে ‘ক্রস ফায়ার’ শুরু করেছে। কয়েকটি ক্রস ফায়ার বা কথিত বন্দুকযুদ্ধ দলের সন্ত্রাসী-মাস্তানদের কাছে চূড়ান্ত বারতা পৌঁছে দিয়েছে। এতে দলের সন্ত্রাসী ও এদের পৃষ্ঠপোষক ও বেনিফিশিয়ারী কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে আতংক সৃষ্টি হয়েছে। এরাই এর বিরুদ্ধে বিভিন্ন পর্যায়ে বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। এর ফলেই সরকারি দলের মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
এদিকে কথিত ‘ক্রসফায়ার’ নিয়ে একেক মন্ত্রী অথবা নেতা পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিচ্ছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও ফজলে নূর তাপস। ওদিকে সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের বিরুদ্ধাচরণ করছে ছাত্রলীগ। তথ্যমন্ত্রী ও আইনমন্ত্রী তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা বাতিল নিয়ে একে অন্যের বিপরীতে অবস্থান নিয়েছেন। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর ফুফাতো ভাই শেখ সেলিম তো বলেই দিয়েছেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল জাসদ। শেখ সেলিম হঠাৎ করে গালমন্দ করছেন জেনারেল শফিউল্লাহকেও। বিশেষ করে দীর্ঘদিন জোট রাজনীতি, মন্ত্রীত্ব প্রদানের পর হাসানুল হক ইনু এই সরকারেরই এক গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। শেখ সেলিমের এই বক্তব্যের পর থেকে চলছে জাসদ বিরোধী ‘পরিকল্পিত’ প্রচারণা।
অনেকেই মনে করছেন, প্রধানমন্ত্রীর বেয়াই স্থানীয় সরকারমন্ত্র্রী (যিনি শেখ সেলিমেরও বেয়াই) ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেনের হিন্দু বাড়ি দখল নিয়ে সাংবাদিক প্রবীর সিকদারের প্রচারণা ও তার গ্রেফতারের ইস্যুকে ধামাচাপা দিতেই ‘পুরানো পাপী’ জাসদ ইস্যু তৈরি করা হয়েছে। ইনুর আগেও ১৯৯৬ সালে জাসদের আরও বড় নেতা আ,স,ম, আব্দুর রব সরকার গঠনে সহায়তা করে শেখ হাসিনার মন্ত্রী হয়েছিলেন। ফলে জাসদ প্রসঙ্গ যে ‘কৃত্রিম’ ইস্যু তা অনেকেই আন্দাজ করছেন। জিএসপি ইস্যুতে বাণিজ্যমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টার অবস্থান দুই মেরুতে। কোনো কোনো আওয়ামী লীগ নেতা সরকারের নীতির বিরুদ্ধেও কথা বলছেন। সমন্বয়হীনতা আরও প্রকট হয়ে ওঠে যখন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, এখনই দল ও অঙ্গসংগঠনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। এ লক্ষ্যে দলে টাস্কফোর্স গঠনেরও আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
আওয়ামী লীগের বি-টিম হিসেবে পরিচিত হিন্দু-খ্রিস্টান-বৌদ্ধ ঐক্য পরিষদ হঠাৎ করেই জোরেশোরে আওয়ামী লীগের নেতাদের বিরুদ্ধে হিন্দু সম্পত্তি গ্রাসের সুনিদিষ্ট অভিযোগ করেছেন। এই সংগঠনের নেতা রানা দাশগুপ্ত মনবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সরকারি কৌসুলি হলেও তিনি সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী ও এমপিদের বিরুদ্ধে হিন্দু সম্পত্তি গ্রাসের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ এনেছেন।প্রকৃত বিরোধী দল বিএনপি বেশ দুর্বল হলেও সরকারের সামনে ঝুলে আছে অনেক চ্যালেঞ্জ। এমনিতেই সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন হয়নি বলে গঠিত সংসদ ও সরকার নিয়ে দেশে ও দেশের বাইরে প্রশ্ন রয়েছে। সরকারের বৈধতার সমস্যা রয়েছে। ক্রমবর্ধমান সন্ত্রাস ও নৈরাজ্য দমনও সরকারের সামনে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। দুর্নীতি এখন সর্বগ্রাসী হয়ে উঠেছে। এসব চ্যালেঞ্জের সঙ্গে যদি নিজের দলের ভেতরের কোন্দল-কলহ সামলানোর চ্যালেঞ্জ যদি দেখা দেয় তাহলে তার সমাধান বড়ই কঠিন হবে।
মেধাহীন রাজনীতি আর যুৎসই কৌশল প্রণেতার অভাবে বিএনপি কোণঠাসা হওয়ায় দেশের রাজনীতি ও ক্ষমতার বলয় এককেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। এমনিতেই আমাদের সংবিধান প্রধানমন্ত্রীকে দিয়েছে অসীম ক্ষমতা। উপরন্তু রাজনীতি এক মেরুকেন্দ্রিক হওয়ায় এবং রাজনৈতিক দলগুলোতে অভ্যন্তরীন গণতন্ত্র না থাকায় প্রধানমন্ত্রীর কর্তৃত্ব ক্রমাগত বেড়েই চলছে। আশংকার বিষয়, সরকারের সিনিয়র মন্ত্রীদের ও কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের দলের ওপর কোন নিয়ন্ত্রণ বা কর্তৃত্বই নেই। এই নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মানসিকভাবে অস্থির করে তুলেছে। এর বহিঃপ্রকাশ হিসেবে বিভিন্ন ইস্যুতে সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে অস্থিরতা ও দ্বন্দ্ব-সংঘাত সৃষ্টি হয়েছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে খাই খাই মনোভাব।
সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে ’৭২-৭৫ সালের রাজনীতিতেও এক ধরনের অস্থিরতা ছিল। তখন সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে পাকিস্তানপন্থী দলগুলো নিষিদ্ধ ছিল। সরকারি দলের লোকজন নানা ধরনের লুটপাট ও দখলে জড়িত হয়ে পড়ে। ছিল খাই খাই মনোভাব। শক্তিশালী বিরোধীদলের বিকাশে বাঁধা দেয়া হয়। ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টি কার্যকর বিরোধী দলের ভূমিকা না দিয়ে দালালিতে লিপ্ত হয়। সরকারের ‘বি টিম’ হিসেবে কাজ করে। আওয়ামী লীগের একাংশ নিয়ে জাসদের জন্ম হয়। পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টিসহ বিভিন্ন আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টির অসাংবিধানিক ও সশস্ত্র তৎপরতা দেশে চরম অস্থিরতার সৃষ্টি হয়। নানা কারণে তখন রাজনীতি হয়ে পড়েছিল এককেন্দ্রিক। এই এককেন্দ্রিকতার কারণে সমাজ হয়ে পড়েছিল অস্থির। এই অস্থিরতা আবার অবনতি ঘটিয়েছিল আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির। সামাজিক ও রাজনৈতিক বিশৃংখলা এমন এক রূপ পরিগ্রহ করেছিল যে, শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে গণতন্ত্রের কবর রচনা করে প্রবর্তন করতে হয়েছিল একদলীয় বাকশালী শাসন।
দেশটা যে এখন কতটা অস্থির তার প্রমাণ, সময়ে সময়ে ক্রসফায়ারের সংখ্যা বৃদ্ধি। ইদানিং তা শুরু হচ্ছে সরকারি দলের ওপর। তথ্যপ্রযুক্তি আইনে মামলা করে ঠেকানো যাচ্ছে না কম্পিউটারভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ। আসলে তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে এভাবে তা ঠেকানো যায়ও না। যে লোকটি দেশে বসে স্ট্যাটাস দিচ্ছে, তাকে না হয় ধরা গেল, যে বিদেশে বসে দিচ্ছে, তাকে ঠেকানো যাবে কীভাবে? ক্রসফায়ার যেমন অপরাধ দমনে স্থায়ী সমাধান আনতে পারে না, তেমনি তথ্যপ্রযুক্তি আইন দিয়ে ঠেকানো যাবে না সামাজিক যোগাযোগ। জটিল সমস্যার সহজ সমাধান হয় না। আসলে পুরো বিষয়টি এখন এক জটিল সামাজিক-মনোবৈজ্ঞানিক সংকটে পরিণত হয়েছে। এ থেকে উদ্ধার পেতে হলে প্রধানমন্ত্রীকে নতুন করে উদ্যোগ নিতে হবে। রাজনৈতিকভাবেই বর্তমান সংকটের সমাধান করতে হবে।
যুগান্তরের সম্পাদক সাইফল আলম সম্প্রতি লিখেছেন : গত বছরের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়ামের কয়টি সভা হয়েছে, ওয়ার্কিং কমিটি কতবার বসেছে? প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দ্বিতীয়-তৃতীয় ধাপের নেতারা যদি খোলাখুলিভাবে কথা বলতে না পারেন, তাহলে তো এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হবেই। একটি সরকার যতটা সমন্বিত থাকবে, সেই সরকার তত শক্তিশালী হবে। সমন্বয়হীনতা এখন এক বড় সমস্যা আওয়ামী লীগে। প্রধানমন্ত্রী যত দ্রুত রোগটি ধরতে পারবেন, ততই তার ও তার সরকারের মঙ্গল।
১৯৭৩-৭৪’ সালে প্রচন্ড ক্ষমতাধর ছিলেন শেখ ফজলুল হক মনি। এখন শেখ মনির জায়গা এখন দখল করতে না পারলেও তার ভাই শেখ সেলিম মাঝে মাঝেই বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে মাঠ গরম করছেন। মনিরই ছেলে ফজলে নূর তাপসের কণ্ঠে তার বাবার কণ্ঠের প্রতিধ্বনি শোনা যায়। তিনি নিজের নির্বাচনী এলাকা হাজারীবাগের ছাত্রলীগ নেতা আরজু হত্যা নিয়ে র্যাবের বিরুদ্ধে অনেককিছু বলেছেন। ইতিহাস কী আশ্চর্যজনকভাবে তার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। মনে হচ্ছে শাসক দলে গভীর কোন অসুখ চলছে।রাজনীতি হচ্ছে ‘আর্ট অব কপ্রোমাইজ’। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী যেভাবে ‘আন-কম্প্রোমাইজিং’ হয়ে উঠেছেন তাতে নিজ দলে, সরকারে ও দেশে অস্থিরতা বাড়বে। এখন যা চলছে তা কী তাহলে তারই আলামত!