দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ২৭ আগস্ট: জাতীয় পার্টির একাংশের চেয়ারম্যান কাজী জাফর আহমদ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন, যিনি এইচ এম এরশাদের সময়ে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।কাজী জাফরের একান্ত সহকারী গোলাম মোস্তফা বলেন, হঠাৎ করে স্যার বৃহস্পতিবার সকাল ৭টার দিকে গুলশানের বাসায় হৃদরোগে আক্রান্ত হন। তাকে দ্রুত ইউনাইটেড হাসপাতালে নেওয়া হয়। সাড়ে ৭টার দিকে চিকিৎসক জানান, স্যার আর নেই।মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী মমতাজ বেগম, তিন মেয়ে কাজী জয়া আহমেদ, কাজী সোনিয়া আহমেদ ও কাজী রুনা আহমেদসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী, কর্মী রেখে গেছেন।বহুবার দল ও মত বদলের কারণে আলোচিত প্রবীণ এই রাজনীতিবিদ হৃদযন্ত্র ও কিডনির সমস্যা ছাড়াও ডায়াবেটিসে ভুগছিলেন।
তার বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর।২০ দলীয় জোটের এই শরিক নেতার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। জাতীয় পার্টির একাংশের সদ্য প্রয়াত চেয়ারম্যান, প্রবীণ রাজনীতিক ও শ্রমিক নেতা এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফর আহমেদের প্রথম নামাজে জানাজা হবে টঙ্গীর মিলগেট এলাকায় শুক্রবার সকাল ৮টায়। দ্বিতীয় জানাজা হবে বেলা ১২টায় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায়। আর বাদ জুমা বায়তুল মোকাররমে হবে তৃতীয় জানাজা। পরে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে গ্রামের বাড়িতে বাবা-মায়ের কবরের পাশে তাকে দাফন করা হতে পারে বলে জানা গেছে।
বৃহস্পতিবার দুপুরে কাজী জাফরের দলের মহাসচিব মোস্তফা জামাল হায়দার এ তথ্য নিশ্চিত করেন।এর আগে কাজী জাফরের ব্যক্তিগত সহকারী গোলাম মোস্তফা জানিয়েছিলেন সংসদ ভবন ও বায়তুল মোকাররমে জানাজা হবে। দাফনের বিষয়টি স্ত্রী ও মেয়েদের সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করছে বলেও জানিয়েছিলেন তিনি।বৃহস্পতিবার সকাল ৭টায় গুলশানের নিজ বাসভবনে ( রোড-৬৮, বাসা-২) হৃদরোগে আক্রান্ত হন কাজী জাফর।এরপর দ্রুত রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে আনা হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক সোয়া ৭টায় তাকে মৃত ঘোষণা করেন।তার মৃত্যুর খবর শুনে ইউনাইটেড হাসপাতালে ছুটে আসেন জাতীয় পার্টির (জাফর) মহাসচিব মোস্তফা জামাল হায়দার, বাংলাদেশ ন্যাপের চেয়ারম্যান জেবেল রহমান গানিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা।
এদিকে এক বার্তায় কাজী জাফর আহমেদের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বীরবিক্রম।কাজী জাফর ১৯৩৯ সালের ১ জুলাই কুমিল্লার প্রখ্যাত চিওড়া কাজী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। মেধাবী ছাত্র হিসেবে তিনি খুলনা জেলা স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরবর্তীতে রাজশাহী সরকারি কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করার পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ অনার্স ও এম এ (ইতিহাস) পাস করেএক সময়ের সহকর্মী বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি বেসামরিক বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, ড. মুহাম্মদ ইউনূস, ২০ দলের শরিক জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির (জাগপা) সভাপতি শফিউল আলম প্রধান ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান ও ন্যাপের জেবেল রহমান গনি শেষবারের মত কাজী জাফরকে দেখতে হাসপাতালে যান।
গত শতকের ষাটের দশকের ছাত্রনেতা এবং পরে চীনপন্থী বাম নেতা হিসেবে রাজনৈতিক অঙ্গনে পরিচিতি পাওয়া কাজী জাফর শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন জিয়াউর রহমানের আমলে। পরে সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদের হাত ধরে তার সরকারের প্রধানমন্ত্রী হন।
দীর্ঘ তিন দশক এরশাদের বিশ্বস্তজন হিসেবে জাতীয় পার্টির সঙ্গে থাকার পর ২০১৩ সালের ২৮ নভেম্বর মতবিরোধের কারণে কাজী জাফরকে দল থেকে বহিষ্কার করেন এরশাদ।এরপর দলের একাংশকে নিয়ে জাতীয় পার্টি নামেই নতুন দল গঠন করে গতবছর ২৫ জানুয়ারি বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটে যোগ দেন কাজী জাফর।তার এপিএস কামরুজ্জামান রনি জানান, কাজী জাফরের মরদেহ গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালে রাখা হয়েছে। তার স্ত্রী মমতাজ বেগম এবং দলীয় নেতাকর্মীরাও সেখানে আছেন।তাদের তিন মেয়ে কাজী জয়া আহমদ, কাজী সোনিয়া আহমদ ও কাজী রুনা আহমদের মধ্যে দুজন দেশের বাইরে থাকেন।
তাদের মধ্যে সোনিয়া ইতোমধ্যে দেশে এসেছেন। আর রুনাও দেশের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছেন বলে কামরুজ্জামান রনি জানান।১৯৩৯ সালে চৌদ্দগ্রামেই কাজী জাফরের জন্ম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তিনি ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন এবং ১৯৬২-১৯৬৩ সালে অবিভক্ত পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।১৯৬৬ সালে তিনি চীনপন্থী কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত হন এবং পরে টঙ্গীর শিল্পাঞ্চলে শ্রমিক রাজনীতিতে জড়িয়ে শ্রমিকনেতা হিসেবে পরিচয় গড়ে ওঠে তার।স্বাধীনতার পর তিনি মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে যোগ দেন এবং পরে পার্টির সাধারণ সম্পাদক হন।
১৯৭৪ সালে ক্যাপ্টেন আব্দুল হালিম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন চীনপন্থী কমিউনিস্টদের সংগঠন ইউনাইটেড পিপলস পার্টিতে (ইউপিপি) যোগ দেন কাজী জাফর।১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর জেনারেল জিয়াউর রহমানের সরকারে শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে যোগ দেন ইউপিপির সাধারণ সম্পাদক কাজী জাফর। জেনারেল জিয়া নিহত হলে আরেক সামরিক অভ্যুত্থানে বিচারপতি আব্দুস সাত্তারের সরকারকে হটিয়ে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ সামরিক ফরমান জারি করে ক্ষমতা নেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল এরশাদ।আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটে কাজী জাফরের ইউপিপিও ছিল। এরশাদকে ক্ষমতা থেকে নামানোর হুমকিও তিনি সে সময় দিয়েছিলেন। কিন্তু পরে সেই কাজী জাফরই নিজের দল বিলুপ্ত করে এরশাদের জাতীয় পার্টিতে যোগ দেন।
বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়ার পর ১৯৮৯ সালে কাজী জাফরকে প্রধানমন্ত্রী বানান সামরিক বাহিনী থেকে ক্ষমতায় আসা এরশাদ। এর আগে ১৯৮৮ সালের বন্যার পর ত্রাণ হিসেবে আসা চিনি বাজারে বিক্রি করে দেওয়ার অভিযোগওঠে কাজী জাফরের বিরুদ্ধে। সে সময় তাকে রসিকতা কওে চিনি জাফর বলেও ডাকা হত। কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির অর্থ আত্মসাতের দায়ে ১৯৯৯ সালে তাকে ১৫ বছরের কারাদণ্ড দেয় আদালত।১৯৮৬ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত তিন বার কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম আসন থেকে জাতীয় পার্টির সাংসদ নির্বাচিত হন কাজী জাফর। আর ২০১৩ সালে বহিষ্কৃত হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি এরশাদের জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলেন।জাতীয় পার্টির নেতারা জানান, ২০০৭ সালে এরশাদের জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটে যোগ দেওয়ার পর বিভিন্ন সময়ে বিএনপি-জামায়াত জোটের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার দায়িত্ব কাজী জাফরকে দেওয়া হয়।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে জাতীয় পার্টি শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন নির্বাচনকালীন সরকারে অংশ নেওয়ায় এক বিবৃতিতে এরশাদকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ বলেন কাজী জাফর। এরপর তাকে দল থেকে বহিষ্কার করেন চেয়ারম্যান এরশাদ।কাজী জাফরের মৃত্যুর খবর পেয়ে তার সাবেক রাজনৈতিক সহকর্মীদের অনেকেই হাসপাতালে এলেও বর্তমানে এরশাদের সঙ্গে থাকা কাউকে সেখানে দেখা যায়নি।এরশাদের আমলে জাফর যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, সে সময় উপ প্রধানমন্ত্রী ছিলেন আজকের বিএনপি নেতা শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন।হাসপাতালে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, কাজী জাফর বয়সে আমার ছোট। তার চলে যাওয়াটা আমরা জন্য বেদনার। বিভিন্ন সময়ে রাজনীতিতে মতভিন্নতা হয়েছে আমাদের মধ্যে। আবার একসঙ্গে আমরা মন্ত্রিসভায়ও ছিলাম।
কিন্তু গণমানুষের রাজনীতির থেকে কখনো সে বিচ্যুত হননি- কাজী জাফর কাজী জাফরই ছিলেন।রাশেদ খান মেনন বলেন, কাজী জাফর ভাই ও তার পরিবারের সঙ্গে আমার দীর্ঘ দিনের সম্পর্ক। একসঙ্গে অনেকদিনের রাজনীতির সম্পর্ক। আমি তার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি।দুপুরে হাসপাতালে এসে সাবেক রাষ্ট্রপতি বিকল্পধারার সভাপতি একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী বলেন, কাজী জাফর আহমদ আমার ভালো বন্ধু ছিলেন।
তার মতো রাজনীতিবিদের কাছ থেকে অনেক কিছু শেখার আছে।বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন মহাসচিব বদরুদ্দোজা জানান, তার স্ত্রী হাসিনা ওয়ার্দা চৌধুরীর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সহপাঠী ছিলেন কাজী জাফর।গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক এমডি মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, আমরা একই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছি। উনি রাজনীতি করতেন, আমি করতাম না। কিন্তু আমাদের মধ্যে যোগাযোগ ছিল।বিএনপি নেতা নজরুল ইসলাম খান বলেন, তিনি ছিলেন একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ। তার মৃত্যু আমাদের ২০ দলীয় জোটের জন্য বেদনার। আমরা এরকম বড়মাপের একজন রাজনীতিবিদের মৃত্যুতে শোকহত।
অন্যদের মধ্যে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যন আবদুল্লাহ আল নোমান,স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান, যুগ্ম মহাসচিব মোহাম্মদ শাহজাহান, এনডিপির খন্দকার গোলাম মুর্তজা, মুসলিম লীগের এএইচএম কামারুজ্জামান, ইসলামিক পার্টির ব্যারিস্টার সাইয়েদুল হাসান ইকবাল, এলডিপির সাহাদাত হোসেন সেলিম, ব্যবসায়ী নেতা মাহবুবুর রহমান, বিজেএমইএর সাবেক সভাপতি গোলাম কুদ্দুস, সাংবাদিক কাজী সিরাজ, জাপা (জাফর) নেতা টিআইএম ফজলে রাব্বী ও কণ্ঠশিল্পী ফকির আলমগীর হাসপাতালে আসেন।যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসারত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকাও শোক জানিয়ে বার্তা পাঠিয়েছেন।