cox. avi.27.08.2015 (7)_4090

দৈনিকবার্তা-কক্সবাজার, ২৭ আগস্ট ২০১৫: মিয়ানমারের জলসীমা থেকে উদ্ধার হওয়া অভিবাসি প্রত্যাশীদের মধ্যে পঞ্চম দফায় ফেরত আনা ১২৫ বাংলাদেশীকে স্বজনদের কাছে পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। এদের জিজ্ঞাসাবাদ করে ৬০ দালালের পরিচয় শনাক্ত করা হয়েছে। এসব দালালদের বিরুদ্ধে দেশের ১৪ জেলায় সংশ্লিষ্ট থানায় পৃথক মামলা দায়ের করা হবে।বৃহস্পতিবার বেলা ১১ টা থেকে পুলিশ, রেডক্রিসেন্ট, আইওএম এর অধিনে এদের স্বজনদের কাছে পৌঁছে দেয়ার কাজ শুরু হয়। সাগর পথে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যেতে চেয়ে সাগরে ভেসে ছিল এরা। এরপর মিয়ানমারের নৌ-বাহিনী এদের উদ্ধার করেছিল। দীর্ঘ ৪/৫ মাসের ভোগান্তির পর ৫ম দফায় মঙ্গলবার ফেরত আনা হয় এ ১২৫ বাংলাদেশীকে। তারপর এদের রাখা হয় কক্সবাজার সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে। ওখানে আইনী প্রক্রিয়া শেষে ২৫ শিশুকে আদালতে নেয়া হয়। আদালতের নির্দেশ মতে এদের রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির মাধ্যমে অভিভাবকদের এবং অপর ১০০ জনকে আইওএম এবং পুলিশের মাধ্যমে স্বজনের কাছে পৌঁছানো হচ্ছে। কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট আবদুস সুবাহান জানিয়েছেন, মিয়ানমার থেকে ফেরত আনা ১২৫ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে ৬০ জন দালালের নাম পাওয়া গেছে। মানবপাচারকারী এসব দালালদের বিরুদ্ধে দেশের ১৪ জেলার সংশ্লিষ্ট থানায় পৃথক মামলা দায়ের করা হবে।

তিনি জানান, ১২৫ জনকে সংশ্লিষ্ট থানায় নিয়ে দালালদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের পর তাদের অভিভাবক বা স্বজনদের কাছে পৌঁছে দেয়া হবে। এর মধ্যে অপ্রাপ্ত বয়স্ক ২৫ জনকে আদালতের নির্দেশনা মতে রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির মাধ্যমে আভিভাবকদের কাছে এবং অপর ১০০ জনকে আইওএম ও পুলিশের মাধ্যমে পৌছে দেয়া হচ্ছে।কক্সবাজারের সহকারি পুলিশ সুপার ছাত্রধর ত্রিপুরা জানিয়েছেন, বিভিন্ন ভোগান্তি শেষে ফেরত আসা এ ১২৫ জন তাদের নির্যাতনের বর্ণণা দেয়ার পাশাপাশি ঘরে ফেরার আনন্দ প্রকাশ করেছে। এদের জিজ্ঞাসাবাদ করে ১৪ জেলার ৬০ জন দালালের পরিচয় শনাক্ত করা হয়েছে। পাচারের শিকার মৃত্যুর কাছাকাছি থেকে ফেরত আসা এসব লোকদের বাদী করে সংশ্লিষ্ট থানায় দালালদের বিরুদ্ধে পৃথকভাবে মামলা দায়ের করার ব্যবস্থা করা হয়েছে।দালালদের শাস্তির দাবি জানিয়েছেন পাচারের শিকার হয়ে মৃত্যুর কাছাকাছি থেকে ফেরত আসা এসব লোকজন। তারা জানান দালালদের মিথ্যে প্ররোচনায় কেউ যাতে পাচারের শিকার না হয়। দালাল কর্তৃক তাদের উপর নানা নির্যাতনের বর্ণনার পাশাপাশি ফেরত আসতে পারার আনন্দও প্রকাশ করেন।কক্সবাজার সদর উপজেলার ঈদগাঁও ভাদীতলা এলাকার আনোয়ার আলীর ছেলে নুরুল আবছার মা নুর বেগমকে কাছে পেয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। মৃত্যুর কাছ থেকে ফেরা এ যুবক সমুদ্রে ভাসমান অবস্থায় ট্রলারে ভেল্ট ও রশি দিয়ে তৈরী চাবুক দিয়ে নানা নির্যাতন চালানোর কথা বলে তিনি জানান, কেউ যেন এ ভুল পথে পা না বাড়ান।

চকরিয়া ফাসিয়াখালীর নতুনপাড়ার রাজারবিল গ্রামের শামসুল আলমের ছেলে জসিম উদ্দিন জানান, ৪ মাসের অধিক পূর্বে এক দালালের মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় যাবার জন্য সমুদ্র পথে রওনা দেন। দালালরা রাতের বেলায় অন্যান্যদের সাথে তাকেও একটি ট্রলারে তোলে। এক সপ্তাহ পর তাদের একটি বড় ট্রলারে তুলে দেয়া হয়। মিয়ানমার সমুদ্রে ওই ট্রলারে খেয়ে নাখেয়ে নানা নির্যাতনের শিকার হয়ে ভাসমান অবস্থায় মিয়ানমার নৌবাহিনী তাদের উদ্ধার করে। নির্যাতনের নানা ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি দালালের ফাসিঁর দাবী জানান। পাশাপাশি ফেরত আসার আনন্দও প্রকাশ করেন।রামু উপজেলার বাইশারী ইউনিয়নের চিতা পাড়ার মনির আহমদের ছেলে মোহাম্মদ ইসলাম জানান, দালালের প্ররোচনায় ৫ মাস পূর্বে মালয়েশিয়া যাবার উদ্ধেশ্যে সমুদ্র পথে যাত্রা দিই। মাঝ সমুদ্রে অপেক্ষমান ট্রলারে যাবার পর থেকে শুরু হয় নানা নির্যাতন। দালালদের নির্যাতনের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে শরীরের দাগ দেখিয়ে তিনি শিউরে উঠে তিনি জানান, কেউ যেন দালালদের প্ররোচনায় প্রতারনার শিকার না হয়। তিনি দালালের কঠোর শাস্থি দাবীর পাশাপাশি মানবপাচারের বিরুদ্ধে সোচ্ছার হওয়ারও কথাও জানান।

ফেরত আনা এসব লোকজনের অনেকের পিতা, মাতা, ভাই, স্ত্রী, সন্তান সহ স্বজনরা ভিড় জমান কক্সবাজার সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে। তারা সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন স্বজনকে পেয়ে। ফেরত আসা এসব লোকজনও কেউ সন্তান কুলে নিয়ে, কেউ মা-বাবাকে জড়িয়ে ধরে আবেগাপ্লত হয়ে পড়েন।ফেরত আসা মোহাম্মদ ইসলামের মা ফরমুজা বেগম প্রায় ৫ মাস পর তার বুকের ধনকে পেয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। তিনি জানান, ‘আমার ছেলেকে ফিরে পেয়েছি, আমি আর কিছুই চাইনা’।ফেরত আসা জসিম উদ্দিনের পিতা শামসুল আলম নিজ সন্তানকে পেয়ে খুশি তিনি সহ স্বজনরাও। তিনি ৪ মাস পর ছেলেকে ফেরত পেয়ে সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করেন।

সাগরে ভাসমান অবস্থায় মিয়ানমারের জলসীমা থেকে উদ্ধার হওয়া অভিবাসি প্রত্যাশীদের মধ্যে পঞ্চম দফায় মঙ্গলবার ১২৫ বাংলাদেশীকে ফিরিয়ে আনা হয়। বিজিবি, জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসনের সমন্বয়ে গঠিত বাংলাদেশের ২০ সদস্যের প্রতিনিধি দল মঙ্গলবার সকাল ১০ টা ৪০ মিনিটে বান্দরবানের ঘুমধুম সীমান্ত দিয়ে মিয়ানমারের ঢেঁকিবনিয়ায় যান। বাংলাদেশ প্রতিনিধি দল ও মিয়ানমার ইমিগ্রেশন বিভাগের মধ্যে সীমান্তের ঘুমধুম জিরো পয়েন্টের বিপরীতে মিয়ানমারের তমব্রু টাউন এ্যাডমিনিস্ট্রিশন অফিসে পতাকা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠক শেষে বাংলাদেশি হিসেবে শনাক্ত হওয়া ১২৫ জনকে ফেরত দেয়া হয়। মঙ্গলবার দুপুর দেড়টায় ঘুমধুম সীমান্ত দিয়ে ১২৫ জনকে নিয়ে ফেরত আসেন প্রতিনিধিদল। ফেরত আনা ১২৫ জনকে সীমান্তের বাংলাদেশ অভ্যন্তরে এনে কক্সবাজার জেলা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এর পর তাদেরকে ৪ টি বাসে করে নিয়ে আসা হয় কক্সবাজার সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে। সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে রেখে আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে ৬০ দালালের পরিচয় শনাক্ত করা হয়।

এর আগে ৮ ও ১৯ জুন, ২২ জুলাই ও ১০ আগষ্ট ৪ দফায় শনাক্ত হওয়া ৫০১ জন বাংলাদেশীকে ফেরত আনা হয়েছে। গত ২১ মে ২০৮ জন ও ২৯ মে ৭২৭ জন অভিবাসি প্রত্যাশীকে মিয়ানমারের জলসীমা থেকে উদ্ধার করেছিল সে দেশের নৌ বাহিনী। এরপর বাংলাদেশী হিসেবে দাবী করা তালিকা নিয়ে উভয় দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কাজ করছে। ওই তালিকায় শনাক্ত হওয়া বাংলাদেশীদের পর্যায়ক্রমে ফেরত আনা হচ্ছে। মিয়ানমারের জলসীমা থেকে সাগরে ভাসমান অবস্থায় উদ্ধার হওয়াদের মধ্যে বাংলাদেশি হিসেবে শনাক্ত হওয়া পঞ্চম বারের মতো ১২৫ জন সহ ৬২৬ জনকে ঘুমধুম সীমান্ত দিয়ে ফেরত আনা হয়।