দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ২৩ আগস্ট ২০১৫: নানা বিতর্ক, আলোচনা-সমালোচনার পর খুব শিগগিরই স্বেচ্ছায় সংসদ সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করছেন সাবেক টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। এর আগে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) শুনানিতে হাজির হন তিনি।রোববার ইসির শুনানি থেকে বেড়িয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় তিনি নিজে একথা জানান। এসসময় তিনি সিইসি কাজী রকিব উদ্দিনের সঙ্গেও দেখা করেন।তিনি বলেন, আমি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করব। এই সিদ্ধান্ত জানিয়ে গেলাম। এ নিয়ে আর শুনানি করার দরকার নেই। নেত্রী চান না আমি এ নিয়ে বাড়াবাড়ি করি বলেও যোগ করেন তিনি।লতিফ সিদ্দিকী বলেন, আমি আমার নেতার ( শেখ হাসিনা) অনুগত, এ বিষয়ে আর আইনি লড়াই করতে চাই না। আজই স্পিকারের কাছে আমার সংসদ সদস্যপদ বাতিলের বিষয়ে চিঠি দিবো।এতদিন কেন এ সিদ্ধান্ত নেননি এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি দেখলাম এভাবে লড়াই করে সংসদ সদস্য টিকিয়ে রাখা যাবে না। যেহেতু নেত্রী চান না তাই নিজেই সরে দাঁড়াব।
এর আগে লতিফ সিদ্দিকীর সংসদ সদস্যপদ বাতিলের বিষয়ে দু’সপ্তাহ চাওয়ায় রোবাবর শুনানি হয়নি। এবং তা মঞ্জুর করে পরবর্তী শুনানির তারিখ আগামী ৬ সেপ্টেম্বর নির্ধারণ করা হয়। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার শাহনেওয়াজ বলেন, তিনি আমাদের কাছে দু’সপ্তাহ সময় চেয়েছিলেন, আমরা দু’ সপ্তাহ সময় দিয়েছি। আগামী ৬ সেপ্টেম্বর পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করা হয়েছে এবং সেদিনই এর রায় হবে। তবে এর আগে তিনি পদত্যাগ করলে শুনানির বিষয়ে আমাদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করবো। পরে সংসদের স্পিকারই বিষয়টি নিষ্পত্তি করবেন।এর আগে সংসদ সদস্য পদ বাতিলের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের শুনানির এখতিয়ার চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা রিট খারিজের পর, আপিল বিভাগও একই আদেশ দেয়। তাই বহিষ্কৃত মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকীকে সংসদ সদস্য পদ নিয়ে নির্বাচন কমিশনের শুনানিতে আসতেই হয়। এই শুনানি বন্ধের জন্য উচ্চ আদালতে গিয়েছিলেন লতিফ। কিন্তু হাই কোর্ট তার ওই আবেদন নাকচ করে দেয় এবং রোববার আপিলেও তা বহাল থাকে।আপিল বিভাগের আদেশ পাওয়ার পর নির্বাচন কমিশনে যান লতিফ সিদ্দিকী ও তার আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া।দল থেকে বাদ পড়ায় লতিফের সংসদ সদস্য পদ থাকবে কি না সে বিষয়ে এই শুনানিতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের পক্ষে ছিলেন দলের দপ্তর সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ, সহ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রিয়াজুল কবির কাউছার ও ও সাইফুদ্দিন খালেদ।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ, চার নির্বাচন কমিশনার, ইসি সচিব ও আইন শাখার যুগ্ম সচিবের উপস্থিতিতে নির্বাচন কমিশনের সম্মলন কক্ষে বেলা ১১টায় শুনানি শুরু হয়।লতিফ পদত্যাগ করবেন জানিয়ে দিলে ১৪ মিনিটেই শুনানি শেষ হয়ে যায়। বেরিয়ে যাওয়ার আগে লতিফ সিদ্দিকী সাংবাদিকদের বলেন, আমার ঈমানে এতটুকু দুর্বলতা নাই। যা প্রচার হয়েছে, তা মিথ্যা প্রচার হয়েছে।উচ্চ আদালতে মামলা লড়লেও হঠাৎ পদত্যাগের সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার ইচ্ছার কথা বলেন লতিফ।তিনি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে, একটু বিলম্ব হয়েছে.. আমি অবগত হয়েছি… আমার নেতা চান না আমি এ নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করি। আমি কমিশনকে বলেছি, আমি আর এ মামলা লড়তে চাই না।আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত হলেও নেতার প্রতি এখনও অনুগত বলে মন্তব্য করেন লতিফ।তিনি বলেন, আমি যেহেতু অনুগত, আমি কমিশনকে বলেছি, আজকের এই শুনানি মুলতবি করা হোক। আমি মাননীয় স্পিকারের বরাবরে আমার পদত্যাগপত্র পৌঁছে দেব।
এর আগে সিইসি কাজী রকিব শুনানিতে বলেন, উনি এখানে পদত্যাগের ইচ্ছা জানিয়েছেন। বাকি বিষয়গুলো নিয়ম অনুযায়ীই হবে।প্রায় এক বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রে এক অনুষ্ঠানে হজ ও তাবলিগ জামাত নিয়ে মন্তব্য করে সমালোচনায় পড়েন টাঙ্গাইলের রাজনীতিতে প্রভাবশালী সিদ্দিকীদের বড় ভাই লতিফ।গতবছর ২৮ সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্কে টাঙ্গাইল সমিতির ওই অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, আমি কিন্তু হজ আর তাবলিগ জামাত দুটোর ঘোরতর বিরোধী। আমি জামায়াতে ইসলামীর যতটা বিরোধী, তার চেয়ে বেশি হজ আর তাবলিগের বিরোধী।এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, হজে কত ম্যানপাওয়ার নষ্ট হয়। এরা কোনো প্রডাকশন দিচ্ছে না… শুধু খাচ্ছে, দেশের টাকা ওদের দিয়ে আসছে।সেই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীপুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, জয় বাংলাদেশ সরকারের কেউ নন। সিদ্ধান্ত নেওয়ারও তিনি কেউ নন।এরপর বিভিন্ন মহলের দাবির মুখে লতিফ সিদ্দিকীকে মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
টাঙ্গাইল-৪ আসনের চার বারের সংসদ সদস্য লতিফ সিদ্দিকী ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার সরকারে বস্ত্র ও পাটমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে পাঁচ বছর তা পালন করেন। আর চলতি সরকারে তাকে দেওয়া হয়েছিল ডাক ও টেলিযোগাযোগ এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। কিন্তু ওই মন্তব্যের কারণে তাকে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর পদ থেকে সরানোর পাশাপাশি দলের প্রাথমিক সদস্যপদও বাতিল করা হয়। দেশে ফেরার পর ওই মন্তব্যকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন মামলায় নয় মাস কারাগারে কাটাতে হয় টাঙ্গাইলের এই সাংসদকে। সম্প্রতি জামিনে মুক্তি পান তিনি।এদিকে লতিফকে বহিষ্কারের আট মাস পর বিষয়টি জানিয়ে আওয়ামী লীগের পাঠানো চিঠি গত ৫ জুলাই স্পিকার শিরীন শারমিনের হাতে পৌঁছায়। এরপর সংবিধান, মেম্বার অফ পার্লামেন্ট (ডিটারমিনেশন অব ডিসপিউট) অ্যাক্ট, সংসদীয় কার্যপ্রণালী বিধি ও গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ মেনে বিতর্ক নিষ্পত্তির কার্যক্রম নেওয়া হয়।এ অবস্থায় লতিফের সংসদ সদস্য পদ থাকবে কি না, তা মীমাংসার জন্য গত ১৩ জুলাই প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে চিঠি দেন স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী।এ পরিপ্রেক্ষিতে মেম্বার অব পার্লামেন্ট (ডিটারমিনেশন অব ডিসপিউট) অ্যাক্ট অনুযায়ী ১৬ জুলাই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ও লতিফ সিদ্দিকীকে লিখিত বক্তব্য দিতে বলে ইসি।ইসিতে পাঠানো আশরাফের জবাবে বলা বলা হয়, দল থেকে বহিষ্কৃত হওয়ায় লতিফ সিদ্দিকীর সংসদ সদস্যপদ না থাকাই সঙ্গত।
অন্যদিকে লতিফ সিদ্দিকী তার সংসদ সদস্য পদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার সংসদের উপর ছেড়ে দেওয়ার আহ্বান জানান।এরপরই শুনানির সিদ্ধান্ত নেয় ইসি। লতিফ ও সৈয়দ আশরাফকে আগামী ২৩ অগাস্ট শুনানিতে হাজির হওয়ার অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দেওয়া হয়।কমিশনের দেওয়া ওই চিঠির কার্যকারিতা স্থগিত চেয়ে হাই কোর্টে রিট আবেদন করেন লতিফ। ওই চিঠি কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না- তা জানতে রুলও চান তিনি।এ বিষয়ে শুনানি করে বিচারপতি মো. এমদাদুল হক ও বিচারপতি মুহাম্মদ খুরশীদ আলম সরকারের হাই কোর্ট বেঞ্চ গত ২০ অগাস্ট আবেদনটি খারিজ করে দেয়।এরপর হাই কোর্টের ওই আদেশের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের চেম্বার আদালতে গিয়ে নির্বাচন কমিশনের নোটিস স্থগিতের আবেদন করেন লতিফ। চেম্বার বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী আবেদনটি আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চে পাঠিয়ে দিলে রোববার তা শুনানির জন্য ওঠে। শুনানি শেষে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন আপিল বেঞ্চ নো অর্ডার দিলে হাই কোর্টের আদেশই বহাল থাকে।