দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ১৭ আগস্ট: তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আইনে দায়ের করা মামলায় গ্রেফতারকৃত সাংবাদিক প্রবীর সিকদারকে নি:শর্ত মুক্তি না দেওয়া হলে কঠোর কর্মসূচি দেওয়ার হুশিয়ারি দিয়েছেন সাংবাদিকরা।মঙ্গলবারের মধ্যে তাকে নি:শর্ত মুক্তি দেওয়ার ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটামও দিয়েছেন তারা। তা না হলে মঙ্গলবার বেলা বারটায় জাতীয় প্রেসক্লাবে সমাবেশ করে কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হবে বলে জানান সাংবাদিক নেতারা। সোমবার দুপুরে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এক মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ থেকে এ হুশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়।
ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে)একাংশ আয়োজিত এ সমাবেশে যোগ দেন অপর অংশও। পরে বিক্ষুব্ধ সাংবাদিক সমাজ ব্যানারে মানববন্ধন ও সমাবেশটি অনুষ্ঠিত হয়। রোববার রাতে প্রবীর সিকদারকে ঢাকা থেকে গ্রেফতার করে ফরিদপুরে নিয়ে যাওয়া হয়। ফরিদপুর কোতোয়ালি থানা থেকে সোমবার দুপুরে তাকে স্থানীয় আদালতে হাজির করা হচ্ছে।প্রতিবাদ সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন সাংবাদিক প্রবীর সিকদারের স্ত্রী অনিতা সিকদার এবং দুই ছেলে সুপ্রিয় সিকদার ও পুলক সিকদার। এছাড়া সংহতি জানিয়ে বক্তব্য রাখেন গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠক ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট কামাল পাশা চৌধুরী, বাপ্পাদিত্য বসু, মাহমুদুল হক মুন্সি বাধন প্রমুখ।
ডিইউজের একাংশের সাধারণ সম্পাদক কুদ্দুস আফ্রাদের নেতৃত্বে সমাবেশ শুরুর পর পরই অপর অংশের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম প্রধানের নেতৃত্বে নেতাকর্মীরা যোগ দেন। সমাবেশে আরও বক্তব্য রাখেন সাংবাদিক অঞ্জন কুমার রায়, আশিস কুমার দে, সাগর লোহানী, অমিয় ঘটক পুলক প্রমুখ। মানববন্ধন ও সমাবেশে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক কুদ্দুস আফ্রাদ বলেন, প্রবীর সিকদার কোনো অন্যায় করেননি। তিনি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বা কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে অন্যায় করেননি। তিনি একজন মুক্তিযুদ্ধবিরোধীর বিরুদ্ধে কথা বলেছেন।
প্রবীর সিকদার একা নন। তার সঙ্গে আমরা আছি।প্রবীর সিকদারের মুক্তির দাবিতে সাংবাদিক সমাজের পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা দিয়ে তিনি বলেন, আগামীকালের (মঙ্গলবার) মধ্যে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে। তা না হলে মঙ্গলবার ১২টায় আমরা প্রেসক্লাবের সামনে সমাবেশ করে কঠোর কর্মসূচির ঘোষণা দেবো।এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিও জানান তিনি।
ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের আরেক অংশের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম প্রধান বলেন, প্রবীর সিকদারের মতো একজন মুক্তমনের মানুষকে গ্রেফতার করা হয়েছে, এটা ভাবতে কষ্ট হচ্ছে। আজ মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি ক্ষমতায়। আজকে মুক্তভাবে কথা বলা যাবে। অথচ তার সঙ্গে একি আচরণ করা হচ্ছে!তার মুক্তি দাবি করে জাহাঙ্গীর প্রধান বলেন, অনতিবিলম্বে মুক্তি না দিলে যে ক্ষোভের সঞ্চয় হচ্ছে তা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়বে।প্রবীর সিকদারের স্ত্রী অনিতা সিকদার তার স্বামীকে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানিয়ে বলেন, জানি না তাকে কি অবস্থায় রাখা হয়েছে। তাকে দ্রুত ফিরিয়ে দিতে হবে।
প্রবীর সিকদারের বড় ছেলে সুপ্রিয় সিকদার বলেন, পুলিশ এখনো আমাদের জানায়নি, বাবাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আমি দেখেছি, ডিবি পুলিশ তুলে নিয়ে গেছে। তাকে অন্যায়ভাবে পুলিশ তুলে নিয়ে গেছে। বাবাকে দ্রুত মুক্তি দিতে হবে।প্রবীর সিকদার নিউজপোর্টাল উত্তরাধিকার ৭১ নিউজ এবং বাংলা দৈনিক বাংলা ৭১ পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক। রাজধানীর ইন্দিরা রোডে পত্রিকা দু’টির কার্যালয় থেকে তাকে রোববার রাতে গ্রেফতার করা হয়।এর আগে বিকেলে তার বিরুদ্ধে কোতোয়ালি থানায় আইসিটি আইনের ৫৭ ধারায় ওই মামলাটি দায়ের করেন ফরিদপুরের আওয়ামী লীগ নেতা এপিপি অ্যাডভোকেট স্বপন কুমার পাল।
সাংবাদিক প্রবীর সিকদারকে রোববার রাতে বিনা নোটিশে তার পত্রিকার কার্যালয় থেকে পুলিশ উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার পর পুলিশের পক্ষ থেকে কোনও ব্যাখ্যা না পেয়ে রাতেই ক্ষোভ প্রকাশ করে ডিইউজে। সঙ্গে সঙ্গে সোমবারের প্রতিবাদ সমাবেশের ডাক দেয় সংগঠনটি।রোববার রাতে ফেসবুকে এক স্ট্যাটাসের মাধ্যমে এ কর্মসূচিতে যোগ দেওয়ার আহবান জানান সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক কুদ্দুস আফ্রাদ।তিনি ওই পোস্টে লেখেন, রোববার দিবাগত রাতের মধ্যে প্রবীর সিকদারকে সসম্মানে তার বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া না হলে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে) বাধ্য হবে তার মুক্তির দাবিতে বৃহত্তর ও কঠোর কর্মসূচি দিতে। এদিকে, ফেইসবুকে লিখে মন্ত্রীর সুনাম ক্ষুণেœর অভিযোগে সাংবাদিক প্রবীর সিকদারের বিরুদ্ধে তথ্য-প্রযুক্তি আইনে মামলা হওয়ায় নিন্দার ঝড় উঠেছে সেই ফেইসবুকেই। পুলিশ ও সরকারের এ ধরনের ভূমিকায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বহু ফেইসবুক ব্যবহারকারী।
সমালোচনায় বিদ্ধ হয়েছেন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন,যিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেয়াই।যাদের বুদ্ধি-পরামর্শে’ পুলিশ প্রবীর সিকদারকে হয়রানি করছে, তাদের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী ও তার সরকাকে সতর্ক হওয়ারও পরামর্শ দিয়েছেন কয়েকজন।প্রবীরের পক্ষে যারা ফেইসবুকে সরব হয়েছেন, তাদের প্রায় সবাই একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতেও সোচ্চার।ব্লগার ও অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট অমি রহমান পিয়াল সোমবার ফেইসবুকে লিখেছেন মুক্তিযুদ্ধে এতগুলো স্বজন হারিয়েছেন, স্বাধীন দেশে চলাচলের পা হারিয়েছেন। নীতি এবং বিবেক হারাননি প্রবীর সিকদার।
হারাননি সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বলার অদম্য মনোবল। হারাননি লড়ে যাওয়ার স্পৃহা। এমন যোদ্ধাকে হারাতে হলে মিত্রের বেশেই তো পিঠে ছুরি মারতে হবে । ফেইসবুকে লেখালেখির কারণে গত কিছু দিন ধরে হুমকি পাওয়ার কথা জানিয়ে থানায় সাধারণ ডায়েরি করতে গিয়েছিলেন প্রবীর সিকদার। কিন্তু পুলিশ তা নেয়নি বলে ফেইসবুকে এক লেখায় তিনি জানিয়েছিলেন।এরপর গত ১০ অগাস্ট ‘আমার জীবন শঙ্কা তথা মৃত্যুর জন্য যারা দায়ী থাকবেন শিরোনামের একটি স্ট্যাটাসে তিনি লেখেন- আমি খুব স্পষ্ট করেই বলছি, নিচের ব্যক্তিবর্গ আমার জীবন শংকা তথা মৃত্যুর জন্য দায়ী থাকবেন : ১. এলজিআরডি মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন এমপি, ২. রাজাকার নুলা মুসা ওরফে ড. মুসা বিন শমসের, ৩. ফাঁসির দণ্ডাদেশ প্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী বাচ্চু রাজাকার ওরফে মাওলানা আবুল কালাম আজাদ এবং এই তিন জনের অনুসারী-সহযোগীরা।
ওই লেখার কারণে রোববার সন্ধ্যায় গোয়েন্দা পুলিশ সাংবাদিক প্রবীরকে তাদের কার্যালয়ে ধরে নেয়। তখন তাকে আটক না করার কথা বলা হলেও রাতে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ফরিদপুরে। তখনই জানা যায়, ফেইসবুকে লেখার মাধ্যমে মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফের সুনাম ক্ষুণ্ণের অভিযোগ তুলে ফরিদপুর কোতোয়ালি থানায় মামলা করেছেন জেলার এপিপি স্বপন পাল।সোমবার সকালে ফরিদপুর কোতোয়ালি থানায় নেওয়ার পর প্রবীর সিকদারকে ওই মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। দুপুরের পর তাকে আদালতে তোলা হবে বলে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. কামরুজ্জামান জানিয়েছেন।শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান প্রবীর সিকদার বর্তমানে উত্তরাধিকার ৭১ নিউজ এবং দৈনিক বাংলা ৭১ নামের পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক। তিনি এর আগে সমকাল ও কালের কণ্ঠে কাজ করেছিলেন।