দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ১৪ আগস্ট, ২০১৫ : জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত পলাতক আসামি অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল এমএ রাশেদ চৌধুরী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয় পেয়েছে। ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্সিয়া ব্ল–ম বার্নিকাট বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলমের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এই তথ্য জানিয়েছেন। তবে ঠিক কবে রাশেদ চৌধুরী এই রাজনৈতিক আশ্রয় পেয়েছে তা এখনও স্পষ্ট নয়। স্পষ্ট করে তিনি কিছু বলেননিও। মার্কিন রাষ্ট্রদূত বিকাল তিনটার দিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যান। সেখানে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে প্রায় এক ঘণ্টা বৈঠক করেন। বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রে পলাতক বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বর্তমান অবস্থান, তাদের ফিরিয়ে আনা, যুক্তরাষ্ট্রে পলাতক যুদ্ধাপরাধীদের ফিরিয়ে আনা এবং জিএসপি ইস্যুতে আলোচনা হয়। বৈঠকের পর বার্নিকাট অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের কোনো কিছুই বলেননি।
জানতে চাইলে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় দৈনিকবার্তা কে বলেন, মার্কিন রাষ্ট্রদূত আমাকে জানিয়েছেন যে, বঙ্গবন্ধুর খুনি রাশেদ চৌধুরী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয় পেয়েছে। আমি বঙ্গবন্ধুর খুনি রাশেদ চৌধুরীকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর জন্য অনুরোধ করেছি। রাষ্ট্রদূত বলেছেন, বিষয়টি আইনি প্রক্রিয়াধীন। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আশরাফুজ্জামান খান নামের একজন যুদ্ধাপরাধী রয়েছেন। আমি তাকে ফেরত পাঠানোর জন্য মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে অনুরোধ করি। জবাবে রাষ্ট্রদূত এই যুদ্ধাপরাধীর ব্যাপারে কিছু কিছু তথ্য আমাদের কাছে চেয়েছেন। আমরা শিগগিরই এসব তথ্য যুক্তরাষ্ট্রের কাছে পাঠিয়ে দেব। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধুর আরেক খুনি নূর চৌধুরী বর্তমানে কানাডায় রয়েছে। তাকে ফিরিয়ে আনার জন্য আইনি ও কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম জোর দিয়ে বলেন, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে আমরা বদ্ধপরিকর। বঙ্গবন্ধুর একজন আদর্শের সৈনিক হিসেবে আমি দৃঢ়ভাবে আশাবাদী যে, বাংলাদেশে বর্তমান সরকারের আমলেই পলাতক খুনিদের অন্তত একজনকে দেশে ফিরিয়ে আনতে সমর্থ হব। তিনি খুনিদের ফেরত আনতে ইন্টারপোলের রেড অ্যালার্ট জারি রয়েছে বলেও জানান।
রাশেদ চৌধুরীর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পলাতক থাকার বিষয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের গত আমলে বাংলাদেশ সরকারের কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য আসে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পত্রিকায় তার অবস্থান সংক্রান্ত খবর প্রকাশের পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বিগত সরকারের আমলে তাকে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অনুরোধ জানানো হয়। তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন বাংলাদেশ সফরে এলেও এ বিষয়ে বাংলাদেশের অনুরোধের বিষয়টি তোলা হয়। হিলারি তখন দেশে ফিরে গিয়ে বিষয়টি আন্তরিকভাবে দেখবেন বলে আশ্বাস দিয়েছিলেন। তারপর আর কোনো সাড়া নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মৃত্যুদণ্ডের বিধান আছে। কিন্তু কোনো কোনো রাজ্যে মৃত্যুদণ্ড নেই। এখন তাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র দৃশ্যত রাশেদ চৌধুরীকে বাংলাদেশের কাছে ফিরিয়ে না দেয়ার ইঙ্গিতই দিয়েছে। তবে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, রাশেদ চৌধুরীকে ফিরিয়ে আনতে সব রকমের কৌশলই গ্রহণ করা হবে। এক্ষেত্রে আইনি ফার্ম নিযুক্ত করে আইনি লড়াইয়ের পাশাপাশি চলবে কূটনৈতিক প্রচেষ্টাও।
সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের দেশে ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টায় দৃশ্যত তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হওয়ায় পলাতক আসামি নূর চৌধুরীকে বাংলাদেশের কাছে ফেরত পাঠাবে না কানাডা। কারণ উত্তর আমেরিকার এই দেশটিতে মৃত্যুদণ্ডের কোনো বিধান নেই। আরেক আসামি রাশেদ চৌধুরীকে ফেরত দেয়ার জন্য বাংলাদেশের অনুরোধে যুক্তরাষ্ট্র এখনও পর্যন্ত কোনো সাড়া দেয়নি। বরং যুক্তরাষ্ট্র তাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়েছে। পলাতক অপর চার আসামি কোথায় আছে তার কোনো হদিস নেই। এই পরিস্থিতিতে পলাতক খুনিদের সহসাই ফিরিয়ে আনার কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। কানাডা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বিকার ভাব থাকার কারণে পলাতক আসামিদের খুঁজে বের করে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে সরকারের তৎপরতাও কার্যত ঝিমিয়ে পড়েছে। এ বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক করে এ সংক্রান্ত কার্যক্রমে অগ্রগতি পর্যালোচনা করা ছাড়া তেমন কোনো কিছুই করা হয় না। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে সরকার আইন, পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সমন্বয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠন করেছে অনেক আগেই। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর সচিবরাও এই টাস্কফোর্সের সদস্য। তারা বিভিন্ন সময়ে বৈঠক করে এ ব্যাপারে তেমন কোনো অগ্রগতি করতে পারেননি।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে টাস্কফোর্সের অন্যতম সদস্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের দেশে ফিরিয়ে আনতে আমরা চেষ্টা করছি। কিন্তু এক্ষেত্রে বলার মতো কোনো অগ্রগতি হয়নি। বিভিন্ন সময়ে টাস্কফোর্সের সভা করছি। পলাতক আসামিদের কারও কারও অবস্থানও চিহ্নিত করেছি। ওই সব দেশের সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত আছে। পলাতক আরেক আসামি অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবদুর রশিদ লিবিয়ায় অবস্থান করছিলেন বলে শোনা গিয়েছিল। তিনি দেশটির সাবেক শাসক গাদ্দাফির উপদেষ্টা হিসেবেও কাজ করেছিলেন বলে বাংলাদেশ সরকারের কাছে তথ্য আসে। কিন্তু গাদ্দাফির পতন ও মৃত্যুর পর রশিদের অবস্থান কোথায় তা সরকারের জানা নেই। দণ্ডিত দুই আসামি অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন আবদুল মাজেদ ও রিসালদার মুসলেহ উদ্দিন ভারতে পালিয়ে আছে বলে বাংলাদেশ সন্দেহ করে থাকে। তাদের ফিরিয়ে দেয়ার জন্য ভারতের কাছে একাধিকবার অনুরোধও করা হয়েছে। ভারতের পক্ষ থেকে খুনিরা কোথায় পালিয়ে আছেন সে বিষয়ে কোনো তথ্য থাকলে তা দিতে বলা হয়েছে। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১২ আসামির মধ্যে ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি পাঁচজন আসামির ফাঁসির রায় কার্যকর হয়। অপর সাতজন বিদেশে পলাতক আসামির মধ্যে অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল আজিজ পাশা জিম্বাবুয়েতে মৃত্যুবরণ করেন। অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল শরিফুল হক ডালিম কোন দেশে পলাতক আছেন সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই সরকারের কাছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, রাশেদ চৌধুরী ও নূর চৌধুরী ছাড়া অপরাপর পলাতক আসামিরা কোনো একটি দেশে কিংবা স্থানে স্থির না থেকে বারবার জায়গা বদল করেছেন বলে তাদের ধারণা। এসব কারণে তাদের অবস্থান শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। এসব কারণে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত বিদেশে পলাতক খুনিদের সহসাই দেশে ফিরিয়ে এনে দণ্ড কার্যকর করার সম্ভাবনা ক্ষীণ। এ ব্যাপারে কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় এখন পর্যন্ত তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় খুনিদের ফিরিয়ে এনে দণ্ড কার্যকর করাকে খুবই চ্যালেঞ্জের কাজ বলে মনে করে।
নূর চৌধুরীকে ফেরত পাঠাবে না কানাডা : জানতে চাইলে কানাডায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার কামরুল আহসান টেলিফোনে বলেন, নূর চৌধুরীকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর লক্ষ্যে আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করছি। একটাই সমস্যা, কানাডীয় আইনে কারও মৃত্যুদণ্ড হলে তাকে তারা হস্তান্তর করে না। তিনি আরও বলেন, আমরা আইনজীবী, কানাডার জনপ্রতিনিধি এবং সরকারের মাধ্যমে চেষ্টা করছি। কানাডায় অবস্থান করছেন এমন একজন বাংলাদেশী বলেছেন, কানাডায় অনেক সময় জনমতের চাপে আইন পরিবর্তন করে থাকে। এক্ষেত্রে কানাডায় অবস্থানকারী বাংলাদেশীরা চাপ সৃষ্টি করলে নূর চৌধুরীকে ফেরত পাঠাতে পারে। কানাডায় বাংলাদেশী আছেন মাত্র এক লাখ। তাদের অনেকেই আবার তৃতীয় প্রজন্মের বাংলাদেশী। তারা নূর চৌধুরীকে ফেরত পাঠানোর ইস্যুর চেয়ে এখানে টিকে থাকার সংগ্রামে সময় পার করছেন বেশি। তাছাড়া কানাডায় এখানকার রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন এমন বাংলাদেশী নেই বললেই চলে। বাংলাদেশী সম্প্রদায় আবার রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত। পলাতক আসামিদের মধ্যে অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল নূর চৌধুরী কানাডায় থাকার বিষয়টি সবার জানা আছে। কেননা তিনি নিজে তাকে যেন বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো না হয়, সেজন্য দেশটিতে আইনি লড়াই করছেন। বাংলাদেশ সরকার গত আমলে তাকে দেশে ফেরত পাঠানোর জন্য কানাডার কাছে অনুরোধ জানিয়েছে। তবে কানাডায় মৃত্যুদণ্ডের বিধান না থাকায় মানবাধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে তাকে ফেরত পাঠাতে অস্বীকার করেছে। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত এই আসামিকে তৃতীয় কোনো দেশের কাছে ফেরত পাঠানোর অনুরোধ জানালে তাতেও সাড়া দেয়নি কানাডা