দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ০৯ আগস্ট ২০১৫: সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্যরা নিজেদের স্বার্থ রক্ষার হাতিয়ার হিসেবে কমিটিকে ব্যবহার করেন বলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ’র (টিআইবি) এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।রোববার রাজধানীর ধানমণ্ডির মাইডাস সেন্টারে ‘সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কার্যকারিতা : চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক এ গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে টিআইবি।এ প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, সংসদীয় স্থায়ী কমিটি গঠন ও এর কার্যক্রমে দলীয় প্রভাব রয়েছে। কমিটিতে সদস্যদের ব্যবসায়িক স্বার্থ সংশ্লিষ্টতা বিদ্যমান ও সদস্য নির্বাচনের সময় বা পরবর্তী সময়ে এ বিষয়ে যথাযথভাবে যাচাই করা হয় না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কমিটির সদস্যরা নিজেদের স্বার্থ রক্ষার হাতিয়ার হিসেবে কমিটিকে ব্যবহার করেন। প্রতিবেদন পাঠ করেন টিআইবি’র রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি বিভাগের প্রোগ্রাম ম্যানেজার জুলিয়েট রোজেটি ও ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ফাতেমা আফরোজ।
সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য এম হাফিজ উদ্দিন খান, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপ-নির্বাহী পরিচালক ড. সুমাইয়া খায়ের, রিসার্চ এ্যান্ড পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।বিভিন্ন বিষয়ে জাতীয় সংসদের সংসদীয় স্থায়ী কমিটি সিদ্ধান্ত নিলেও তার অনেক সিদ্ধান্তই বাস্তবায়িত হয়নি। এছাড়া বাস্তবায়নাধীন সিদ্ধান্ত অনেক ক্ষেত্রে ফলোআপ না করায় অগ্রগতিও জানা যায় না।প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নবম সংসদে ১১টি স্থায়ী কমিটি মোট সিদ্ধান্ত নিয়েছে ১ হাজার ৮৯১টি। এর মধ্যে ৩৯ শতাংশই বাস্তবায়িত হয়নি। বাস্তবায়নের অপেক্ষায় আছে ২০ শতাংশ। ৪১ শতাংশ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হয়েছে।সংসদীয় কমিটিতে দলীয় প্রভাবের কথা উল্লেখ করে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, হলফনামার তথ্য অনুযায়ী নবম সংসদের ৫১টি কমিটির মধ্যে ছয়টিতে এবং দশম সংসদের ৫০টি কমিটির মধ্যে পাঁচটিতে এক বা একাধিক সদস্যের কমিটি সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়িক স্বার্থ রয়েছে। কেস হিসেব অন্তর্ভুক্ত ১১টি কমিটির ৩৮ জন সদস্য সম্পর্কে (স্থানীয় পর্যায় থেকে) প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী নয়টিতে ১৯ জন সদস্যের সংশ্লিষ্ট ব্যবসা রয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, কমিটিতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী পদাধিকার বলে সদস্য হওয়ার কারণে এবং কোনো কোনো কমিটিতে পূবর্তন মন্ত্রী সংশ্লিষ্ট স্থায়ী কমিটির সভাপতি হওয়ায় জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ রয়েছে।টআইবি’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে কমিটির সদস্যরা নিজেদের স্বার্থ রক্ষার হাতিয়ার হিসেবে কমিটিকে ব্যবহার করেন। কমিটির সিদ্ধান্তের একটি বড় অংশ বাস্তবায়িত হয় না। আরও দেখা যায় কমিটিতে দুর্নীতি সম্পর্কিত বিষয়ে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত তুলনামূলকভাবে কম। কমিটির কার্যক্রমে সাচিবিক ও টেকনিক্যাল সহায়তায় ঘাটতি রয়েছে বলে দেখা যায়।প্রতিবেদন প্রকাশের পর টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, কমিটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিলেও তা বাস্তবায়িত হয় না। এতে সংসদীয় গণতন্ত্র ব্যাহত হচ্ছে। এছাড়া কমিটির কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ঘাটতি রয়েছে। কমিটির কার্যক্রম সাধারণ জনগণের জন্য উন্মুক্ত নয় এবং কমিটি সম্পর্কিত তথ্যও জনগণ পাচ্ছে না। এছাড়া কমিটির কার্যক্রমে জনগণের অংশগ্রহণ খুবই সীমিত পর্যায়ের।
তিনি বলেন, কমিটির কার্যক্রমের কোনো মূল্যায়ন কাঠামো নেই। বিভিন্ন কমিটি এবং দু’টি সংসদের মধ্যবর্তী সময়ের কার্য্যক্রমের সমন্বয়েরও ঘাটতি রয়েছে। কমিটিগুলো প্রত্যাশিত পর্যায়ে কার্যকর না হওয়ার ফলে সরকারের জবাবদিহিতা প্রত্যাশিত পর্যায়ে নিশ্চিত হয় না, জনগণের সঙ্গে সংসদীয় কমিটির দূরত্ব তৈরি হয় এবং সার্বিকভাবে সংসদীয় কমিটির কার্যকরিতা ব্যাহত হয়।সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের উত্তরে টিআইবি’র ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য এম হাফিজ উদ্দিন্ খান বলেন, আমরা সংসদীয় গণতন্ত্র থেকে পিছিয়ে আছি। আমাদের নির্বাচনী যে গণতন্ত্র ছিল তাও গেছে। গণতন্ত্রের অনেক কিছ্রুই বাস্তবায়ন আমাদের এখানে নেই।নবম সংসদের পুরো মেয়াদ এবং দশম সংসদের ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৫ সালের এপ্রিল পর্যন্ত কমিটিগুলোর কার্যক্রম পর্যালোচনা করে টিআইবি বলেছে, রাজনৈতিক বা দলীয় প্রভাব, স্বার্থের দ্বন্দ্ব, সদস্য বা মন্ত্রণালয়ের কমিটিকে গুরুত্বপূর্ণ মনে না করা, কমিটির সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে বাধ্যবাধকতা না থাকা এবং হাজিরা স্বাক্ষ্য প্রদান ও দলিলপত্র প্রদানে বাধ্য করার ক্ষেত্রে ক্ষমতা না থাকা ইত্যাদি কারণে বাস্তবে এই কমিটিগুলো প্রত্যাশিত পর্যায়ে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না।প্রতিবেদন অনুযায়ী, কমিটির সদস্য নির্বাচনের সময় তাদের দক্ষতা, যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, ব্যবসায়িক সংশ্লিষ্টতা ইত্যাদি কিছুই দেখা হয় না এবং কমিটির সভাপতি ও সদস্য নির্বাচন এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় সরকারি দল এবং দলীয় প্রধানের প্রভাব লক্ষ্যণীয়।
সভাপতি নিয়োগে সংসদে দল অনুযায়ী আনুপাতিক হারের তুলনায় বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, সদস্য হিসেবে নবম সংসদে ১১ শতাংশ ও দশম সংসদে ১০ শতাংশ বিরোধী দলের প্রতিনিধিত্ব ছিল এবং সভাপতি হিসেবে যথাক্রমে তা ছিল ৪ ও ৩ শতাংশ।নবম সংসদের ১১টি কমিটি মোট ৩১ বার এবং দশম সংসদে তিনটি কমিটি মোট তিনবার পুনর্গঠিত হলেও কমিটি পুনর্গঠনের কোনো কারণ প্রকাশিত হয়নি। এছাড়া মাসে অন্তত একবার বৈঠক করার কথা থাকলেও বেশীরভাগ কমিটিই তা করেনি এবং সদস্য বা সভাপতির বৈঠকে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রেও অনিয়ম দেখা গেছে।আইনসভার কার্যক্রমে জনগণকে সম্পৃক্ত করার ক্ষেত্রে কমিটিগুলোর ভূমিকা উল্লেখযোগ্য নয়। গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফলে দেখা যায়, স্থায়ী কমিটির দায়িত্ব থাকলেও নবম ও দশম সংসদে কোনো বিলের জনমত যাচাই-বাছাই করা হয়নি। উল্লিখিত ১১টি কমিটির সুপারিশক্রমে ৭৩টি বিল পাস হয়েছে। যার মধ্যে ৬৯টি বিলে সংসদ সদস্যরা জনমত যাচাই-বাছাইয়ের প্রস্তাব দিলেও ৩৭টি বিলের ক্ষেত্রে প্রস্তাব অধিবেশনেই কণ্ঠভোটে নাকচ হয় এবং ৩২টি বিলের ক্ষেত্রে সদস্য অনুপস্থিত থাকায় প্রস্তাব সংসদের অধিবেশনে উত্থাপিত হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে বিধিতে নিষেধাজ্ঞা থাকায় কমিটিগুলো কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারছে না।