দৈনিকবার্তা-রাজশাহী, ৫ আগস্ট, ২০১৫: রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলা ভূমি অফিস। অফিসের সামনে গিজগিজ করছেন সেবা প্রার্থীরা। গোমড়া মুখ নিয়ে অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে ক্ষেদ ঝাড়ছিলেন উপজেলার হরিশংকরপুর থেকে যাওয়া মাইনুল ইসলাম (৪০)। বলছিলেন, ৩ বিঘা জমির খারিজ বাতিলের জন্য অফিসের পিয়নকে পাঁচ দিন আগে দিয়েছেন ৫’শ টাকা। আজ (রোববার) আবার চায় ৩’শ টাকা। পিয়ন মোর্শেদ আলী নাকি বলেছেন, টাকা দিলে কাজ হবে না দিলে নয়। মাঝপথেই আটকে যাবে তার কাজ।
মাইনুলের কথায় ‘ঠিক ঠিক’ আওয়াজ তুলে সায় দিচ্ছিলেন নামজারি (নাম খারিজ) ও খাজনা দিতে আসা অন্যান্য সেবা প্রত্যাশীরাও। নামজারি, ডিসিআর ও দাখিলার নামে এখানে অবাধে চলা ঘুষ-বাণিজ্যের রমরমা অবস্থার চিত্র তুলে ধরতে তারাও হয়ে ওঠেন সরব। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, রাখঢাক না করেই ভূমি অফিসের পিয়ন, নায়েব ও কানুনগো থেকে শুরু করে সব কর্মকর্তা-কর্মচারী ঘুষ-দুর্নীতির ‘রসের হাঁড়িতে’ মজে অনিয়মকে রুপ দিয়েছেন নিয়মে। এতে প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। আর এসব ঘটছে খোদ সহকারী কমিশনার (ভূমি) মনির হোসেনের সামনেই। অভিযোগ উঠেছে, উৎকোচ বাণিজ্যে আদায় করা অর্থের ভাগ পাচ্ছেন তিনিও।
এ ব্যাপারে ভুক্তভোগীরা সংশ্লিষ্ট উর্দ্ধতন কতৃপক্ষ কিংবা উপজেলা প্রশাসনে অভিযোগ করেও কোনো সুফল পাননা বলে জানা গেছে। খোদ উপজেলা প্রশাসনও দুর্নীতির দুষ্টচক্রের পক্ষেই সাফাই গান, এমন নেতিবাচক নজিরও তাদের ফেলে দিয়েছে প্রশ্নের মুখে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, গোদাগাড়ী উপজেলা ভূমি অফিসের কানুনগো ওবায়দুল ইসলাম ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) মনির হোসেন টাকা ছাড়া কোনো কাজ করেন না।
নামজারি, ডিসিআর ও দাখিলার জন্য তাদের আলাদা আলাদা টাকা দিতে হয় সেবা প্রার্থীদের। তাদের এই টাকা আদায় করেন ভূমি অফিসের পিয়ন মোর্শেদ আলী। কখনো কখনো টাকা দিলেও জোটেনা নামজারি। নামজারির জন্য নির্ধারিত ফি’র চেয়েও অতিরিক্ত টাকা আদায় করলেও রশিদ দেয়া হয় সরকারী হিসাবেই। এসবের মাধ্যমে প্রতিমাসে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন গোদাগাড়ী ভূমি অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। বর্তমানে সেখানে দৌরাত্ব বেড়েছে দালাল সিন্ডিকেটেরও।
ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেন, ভূমি অফিসের ঘুষ বাণিজ্যে, অনিয়ম-দুর্নীতি আর দালাল-কর্মচারী সিন্ডিকেটের উৎপাতে সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন। গোটা ভূমি অফিস হয়ে উঠেছে অনিয়ম-দুর্নীতির আখড়া। আর এসবের মূলহোতা অফিসের পিয়ন মোর্শেদ আলী। তার মাধ্যমেই সব টাকা আদায় হয়ে ভাগ-বাটোয়ারা হয় সহকারী কমিশনার থেকে শুরু করে সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে। জানা গেছে, গোদাগাড়ীর পাশের উপজেলা পবার গহমাবোনা এলাকার বাসিন্দা মোর্শেদ আলী
গত প্রায় ২৫ বছর ধরে এই অফিসে কর্মরত আছেন। এ কারণে অনিয়ম-দুর্নীতি আর টাকা আদায় করার সব পন্থায় তার জানা। ভূমি অফিসের বারান্দায় ঝুলন্ত ব্যানারে স্পষ্ট করে লেখা আছে নামজারি করতে সরকার নির্ধারিত ফি সর্বসাকুল্যে এক হাজার ১’শ ৭০ টাকা। তাই মোর্শেদ আলীর কাছে এই প্রতিবেদক জানতে চাইলেন নামজারি করাতে কতো টাকা লাগবে? মোর্শেদ বললেন, ‘চার হাজার।’ এতো টাকা কোন কোন খাতে লাগবে জানতে চাইলে কিছুটা রুক্ষ মেজাজেই মোর্শেদ আলী বললেন, ‘অতো খাত বলতে পারবো না। ইচ্ছে হলে করেন, না হলে যান। আর বেশি জানার দরকার হলে যান কানুনগো’র কাছে।’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কানুনগো ওবায়দুল ইসলাম বলেন, নামজারি প্রক্রিয়ার শেষ ধাপের আগের ধাপে তার কাছে কাগজপত্র আসে। তাই অনেক সময় আবেদনকারীর সঙ্গেই তার দেখা হয়না। অতিরিক্ত টাকা নেওয়ার বিষয়েও তিনি কিছু জানেন না। তবে অতিরিক্ত টাকা নেওয়া হলেও এই অফিসে সেবা প্রার্থীরা শতভাগ সেবা পেয়ে থাকেন বলেও মন্তব্য করেন তিনি। এ ব্যাপারে কথা বলতে ওই সময় গোদাগাড়ীর সহকারী কমিশনার (ভূমি) মনির হোসেনকে তার অফিসে পাওয়া যায়নি। মুঠোফোনে যোগাযোগ করে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এসব কথা মোবাইলে আলাপ করা সম্ভব নয়। আপনার অফিসে ঘুষ-বাণিজ্য চলছে কিনা জানতে চাইলে তিনি কৌশলে প্রসঙ্গটি এড়িয়ে যান।