1438669270

দৈনিকবার্তা-খুলনা, ০৪ আগস্ট ২০১৫: খুলনায় মোটর গ্যারেজে নির্মম নির্যাতন চালিয়ে শিশু মো. রাকিবকে হত্যার ঘটনায় জনতার হাতে আটক তিনজনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছেন ছেলেটির বাবা। খুলনা সদর থানার ওসি সুকুমার বিশ্বাস জানান, নিহত রাকিবের বাবা নুরুল আলম মঙ্গলবার সকালে এই হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলার তিন আসামি হলেন- গ্যারেজ মালিক মিন্টু মিয়া (৪০), কর্মচারী শরীফ (৩৫) এবং শরীফের মা বিউটি বেগম (৫৫)।সিলেটে রাজন হত্যাকাণ্ড নিয়ে দেশজুড়ে তোলপাড়ের মধ্যেই সোমবার রাতে খুলনার টুটপাড়া এলাকার ওই গ্যারেজে মলদ্বারে পাইপের মাধ্যমে হাওয়া ঢুকিয়ে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয় ১২ বছরের রাকিবকে। হত্যাকাণ্ডের পরপরই ওই তিনজনকে পিটিয়ে পুলিশে সোপর্দ করেন স্থানীয় বাসিন্দারা। ওসি বলেন, খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রাকিবের লাশের ময়নতদন্ত শেষে মৃতদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে।দিনমজুর আলমের ছেলে রাকিব টুটপাড়া সেন্ট্রাল রোডের কবরস্থানের কাছে মিন্টু মিয়ার মোটর সাইকেল গ্যারেজ ‘রোজ ব্যাটারিতে’ কাজ করত। কিছু দিন আগে সে ওই গ্যারেজ ছেড়ে পিটিআই মোড়ে আরেকটি গ্যারেজে কাজ নিলে মিন্টু মিয়া ক্ষুব্ধ হয়।ওসি সুকুমার বিশ্বাস বলেন, রাতে মিন্টুর গ্যারেজের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় রাকিবকে ডেকে নেয় সে। এক পর্যায়ে শিশুটিকে বিবস্ত্র করে তার মলদ্বারে টায়ারে হাওয়া দেওয়ার পাইপ ঢুকিয়ে দেয়। এতে রাকিবের পেটসহ শরীরের বিভিন্ন অংশ ফুলে ফেঁপে ওঠে।এতে রাকিব অসুস্থ হয়ে পড়লে মিন্টু ও শরীফ পেটে চাপ দিয়ে বাতাস বের করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। এরপর তারা শিশুটিকে একটি প্রাইভেট ক্লিনিকে ভর্তি করে। সেখানে অবস্থার অবনতি হলে রাকিবকে নেওয়া হয় খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখান থেকে ঢাকায় নেওয়ার জন্য অ্যাম্বুলেন্সে তোলার পরপরই রাকিব মারা যায়।

চিকিৎসকদের বরাত দিয়ে ওসি সুকুমার বলেন, রাকিবের শরীরের অস্বাভাবিক পরিমাণ হাওয়া প্রবেশ করানোর কারণে তার পেটের নাড়িভুড়ি ছিঁড়ে যায়, ফুসফুস ফেটে যায়। শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ অকেজো হয়ে যাওয়ায় সে মারা যায়।খুলনায় শিশু রাকিবকে পায়ুপথে কমপ্রেসার মেশিন বসিয়ে বাতাস দিয়ে নির্যাতন করার সময় উল্লাস করে নির্যাতনকারীরা। এ সময় তার চিৎকারে মন গলেনি কারোই। কেউ আসেনি তাকে উদ্ধার করতে। তবে শিশু রাকিবের বন্ধু প্রত্যক্ষদর্শী নাবিল (১০) তার বাড়িতে নির্যাতনের খবর পৌঁছে দিয়ে রেখেছে বন্ধুত্বের মর্যাদা।ঘটনার খানিকটা বর্ণনা দিয়ে নাবিল বলে, রাকিবকে নির্যাতনের সময় সে চিৎকার দিয়ে কাঁদছিল। কান্না শুনে মনে হয়েছে রাকিবকে নির্যাতন করা হচ্ছে। পরে দেখি কমপ্রেসার মেশিন দিয়ে তার পেটের ভেতরে বাতাস ঢুকানো হচ্ছে। সে আরো চিৎকার করছে। বাচাঁর জন্য আকুতি করে বলছে, মামা আর দিয়েন না, আমি মরে যাবো। এক পর্যায়ে রাকিব বমি করতে থাকে। এরপর কিছু সময় মেশিন দিয়ে বাতাস দেয়া বন্ধ করে তারা। এরপর আবারো উল্লাস করতে করতে রাকিবকে চেপে ধরে তারা বাতাস ঢুকাতে থাকে। এ দেখে আমি ভয় পেয়ে যাই। আর সামনে না গিয়ে রাকিবের বাড়িতে গিয়ে ঘটনা জানাই।

সোমবার বিকেলে নগরীর টুটপাড়া কবরখানা সংলগ্ন শরীফের গ্যারেজের সামনে দিয়ে রঙ কিনতে যাওয়ার সময় রাকিবকে ডেকে নেয় গ্যারেজ মালিক শরীফ। এরপরে সহযোগী মিন্টু মিয়াসহ ৪/৫ জন মিলে তাকে টেনে-হিঁচড়ে গ্যারেজের ভেতরে নিয়ে যায় তারা। এক পর্যায়ে রাকিবের পায়ুপথে কমপ্রেসার মেশিন বসিয়ে পেটে বাতাস ঢুকিয়ে উল্লাস করতে থাকে। এসময় মৃত্যু রযন্ত্রণায় চিৎকার করতে থাকে সে।শিশু রাকিবের আর্তচিৎকার শুনতে পেয়ে গ্যারেজের সামনে খানজাহান আলী সড়ক দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় থমকে দাঁড়ায় একই এলাকার খেলার সাথী চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র প্রতিবেশী নাবিল।দারিদ্রতার কারণে দেড় বছর আগে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় একমাত্র ছেলে শিশু রাকিবকে টুটপাড়া কবরস্থানের পাশে শরীফ মটরস গ্যারেজে কাজে দেন হতদরিদ্র নূর আলম হাওলাদার। গ্যারেজে কাজ করা অবস্থায় প্রায়ই মারধর করত গ্যারেজে মালিক ও তার লোকজন। কিছুদিন আগে শিশু রাকিব গ্যারেজ মালিকের গালমন্দ ও কথায় কথায় মারপিটের কারণে ওই গ্যারেজ ছেড়ে খুলনার পিটিআই মোড়ে নাসিরের গ্যারেজে কাজ নেয়। এতে ক্ষুব্ধ হয় আগের গ্যারেজের মালিক শরীফ।রাকিবের মা লাকি বেগম আহাজারি করে বলেন, নাবিলের কাছ থেকে খবর পেয়ে আমরা গ্যারেজে যাই রাকিবকে খুঁজতে। ওখানে গিয়ে শুনি তাকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। এরপরে হাসপাতালে যাই। হাসপাতালে গিয়ে দেখি রাকিবের কিছু জ্ঞান আছে। আমাকে বললো, মা আমাকে বাঁচাও। মামা আমাকে অনেক নির্যাতন করেছে। আমি বাঁচবো না মা।

রাকিবদের প্রতিবেশী সুমি বেগম জানান, হাসপাতালে গেলে ডাক্তাররা বলেন রাকিবের শরীরে অস্বাভাবিক পরিমাণ বাতাস প্রবেশ করানোর কারণে তার পেটের নাড়িভুঁড়ি ছিঁড়ে গেছে। ফুসফুসও ফেটে গেছে। এছাড়া তার শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ অকেজো হয়ে যাওয়ায় অবস্থার অবনতি দেখে তারা রাকিবকে সেখান থেকে ঢাকায় নিতে বলে। কিন্তু ঢাকা নেয়ার পথে রাকিব মারা যায়।সুমী আরো জানান, রাকিবের মৃত্যুর পরও তার নাক-মুখ দিয়ে প্রচণ্ড রক্তক্ষরণ হয়েছে। শিশু শরীর হলেও ফুলে ফেপে প্রাপ্তবয়স্কদের মতো মোটা হয়ে যায় সে। তিনি এ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের ফাঁসির দাবি জানান।এদিকে, এ ঘটনায় খুলনায় ব্যাপক চাঞ্চলের সৃষ্টি হয়েছে। দফায় দফায় হয়েছে বিক্ষোভ মিছিল, সড়ক অবরোধ।সিলেটের শিশু রাজন হত্যার রেশ না কাটতেই খুলনায় ১২ বছরের রাকিবকে নির্মম নির্যাতন চালিয়ে হত্যার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছেন বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন অ্যাডভোকেট এলিনা খান, খুলনা মহানগর শাখার সভাপতি মো. খবিরুজ্জামান, জেলা শাখার সভাপতি অ্যাডভোকেট স ম বাবর আলী, মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট ফরিদ আহমেদ, জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক সাংবাদিক মিজানুর রহমান মিলটন প্রমুখ। প্রদত্ত বিবৃতিতে নেতারা দ্রুত সময়ের মধ্যে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান।