দৈনিকবার্তা-সাতক্ষীরা, ৩ আগস্ট: সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ইউনিয়নের চাকলায় কপোতাক্ষ নদের ৭(১) পোল্ডারে প্রায় ২৫০ ফুট বেড়িবাঁধে আবারো ভাঙন দেখা দিয়েছে। ফলে প্রবল জোয়ারের পানিতে চাকলা গ্রামের ৫০টি চিংড়ি ঘের ভেসে গেছে। শনিবার সন্ধ্যায় এ ভাঙন দেখা দেয়। এলাকাবাসীর সেচ্ছা শ্রমে বাঁধ টিকিয়ে রাখা হলেও রোববার পুনরায় ভেঙ্গে গেলে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে বাঁধ সংস্কারের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। রোববার দুপুরের মধ্যে এ বাঁধ সংস্কার করা সম্ভব না হলে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।চাকলা গ্রামের ইউপি সদস্য আব্দুর রউফ, মনিরুল ঢালী, তৌহিদ ঢালী ও হাবিব বিশ্বাস জানান, আইলা কবলিত ৭(১) পোল্ডার এলাকার কপোতাক্ষ নদের বেশ কিছু বেড়িবাঁধ দুর্বল ছিল।
গত মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে হাফেজ জাহাঙ্গীর আলম ও মাষ্টার আব্দুল জলিলের বাড়ির সামনে ফাঁকা জায়গায় পুরাতন রিং বাঁধের সামনে বেড়িবাঁধে ফাটল দেখা দেয়। বিষয়টি পানি উন্নয়ন বোর্ডকে জানিয়েও কোন লাভ হয়নি। এক পর্যায়ে গত ২২ এপ্রিল দিবাগত রাত একটার দিকে একই স্থানের বেড়িবাঁধ ভেঙে নদী গর্ভে চলে যায়। জোয়ারের প্রবল তোড়ে রিং বাঁধ উপচে পানি চাকলা গ্রামের ৫০টি চিংড়ি ঘের ভাসিয়ে নিয়ে যায়। তড়িঘড়ি করে সেখানে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে বাঁধ সংস্কার করা হলেও তা ছিল যথেষ্ট দুর্বল।
তারা আরো জানান, বৈরি আবহাওয়ার কারণে সম্প্রতি কয়েক দিনের টানা বর্ষণ ও ঝড়ো হাওয়ার ফলে নদীতে পানি বৃদ্ধি পায়। শনিবার সন্ধ্যায় জোয়ারের পানির তোড়ে জাহাঙ্গীর আলম ও আব্দুল জলিলের বাড়ির পাশে ফাঁকা জায়গায় ২৫০ ফুটেরও বেশি স্থানে বেড়িবাঁধ ভেঙে যায়। ফলে জোয়ারের পানিতে মুহুর্তের মধ্যে তলিয়ে যায় ৫০টির মত চিংড়ি ঘের। পানিবন্দি হয়ে পড়ে দু’ শতাধিক পরিবার। রোববার দুপুরে জোয়ার আসার আগে বাঁধ সংস্কার করা না গেলে চাকলা, সুভদ্রাকাটি, রুইয়ার বিল, তালতলাসহ কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ ছাড়া চাকলা গ্রামের শেষ প্রান্তে একটি ছোট রিং বাঁধ ভেঙে গেলে শ্যামনগরের পদ্মপুকুর ইউনিয়নের খুটিকাটা ও গড় প্লাবিত হবে। প্রতাপনগর ইউপি চেয়ারম্যান জাকির হোসেন জানান, কপোতাক্ষ নদের চাকলা পয়েন্টের বেড়িবাঁধ দীর্ঘদিন ধরে জরাজীর্ণ অবস্থায় ছিল। পানি উন্নয়ন বোর্ডকে বার বার বলা সত্ত্বেও তারা সংস্কারের উদ্যোগ না নেওয়ায় চলতি বছরের মার্চ ও এপ্রিল মাসে দু’ বার ভাঙন দেখা দেয়।
যেন তেন করে বাঁধ সংস্কার করায় শনিবার সন্ধ্যায় একই স্থানের ২৫০ ফুট এলাকা জুড়ে বাঁধ ভেঙ্গে নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। তিনি জানান, সেখানে দুই শতাধিক এলাকাবাসীদের নিয়ে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে রিং বাঁধ দিয়ে সংস্কারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি অভিযোগ করে বলেন, গত ২২ এপ্রিল নদীবাঁধ ভাঙনের পর পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে বাঁধ সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। সে অনুযায়ি খুলনার নলিয়ানের ঠিকাদার মন্টু হোসেন গত মে মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে কাজ শুরু করে। ৩০ জুনের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা থাকলেও অদ্যবধি কাজ শেষ করেনি।
এমনকি কত টাকার কাজ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের কাছে বারবার জানতে চেয়েও তা জানা যায়নি। জুনের মধ্যে কাজ শেষ হলে এ এলাকায় আবার ভাঙন দেখা দিত না বলে অভিযোগ করেন তিনি। এদিকে, সকাল ১০টার দিকে ইউপি চেয়ারম্যান শেখ জাকির হোসেন চাকলা ভাঙ্গন কবলিত এলাকায় গিয়ে ঠিকাদার কামরুল জামান মন্টুর কাছে বাঁধ সংস্কার বিলম্ব কেন জানতে চাইলে তিনি কার কাছে এর কৈফিয়ত দিতে পারবেনা বলে জানায় । এসময় উত্তেজিত এলাকাবাসীর হাতে গনধোলায়ের শিকার হয় ঠিকাদার কামরুল জামান মন্টু(৪৫) সহ আজিজুল ইসলাম(৩৫), আ: হামিদ(৩৩) ও মফিজুল ইসলাম(৪৫)।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সাতক্ষীরা- ২ এর আশাশুনির সেকশান অফিসার আ.ন.ম সরোয়ার হোসেন জানান, তিনি রোববার সকাল ১০টার দিকে ঘটনাস্থলের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছেন। এলাকাবাসী সেখানে রিং বাঁধ সংস্কারের চেষ্টা চালাচ্ছেন। বৈরী আবহাওয়া ও সেখানে বর্ষা মৌসুমে ভাঙন এলাকার কাছাকাছি মাটি না পাওয়ায় বরাদ্দ পাওয়া প্রায় এক কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ঠিকাদার যথাসময়ে কাজ শেষ করতে পারেনি বলে জানান তিনি। তবে পুরানো রিং বাঁধ ঠিক রেখে ভাঙন কবলিত এলাকা ঠিকাদারের মাধ্যমে অতি দ্রুত সংস্কার করার উদ্যোগ নেওয়া হবে।
অন্যদিকে, আশাশুনি উপজেলার জেলেখালী দয়ারঘাট ও মনিপুর এলাকার বেড়িবাঁধেও ভয়াবহ ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। যে কোন মুহুর্তে সেখানে বেড়িবাধ ভেঙ্গে বিস্তীর্ণ এলাকা প¬াবিত হওয়ার আশংকায় স্থানীয় জনসাধারন আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। এদিকে, অতিবৃষ্টি আর কপোতাক্ষের উপচে পড়া পানিতে তালা ও কলারোয়া উপজেলার ৯টি ইউনিয়নের প্রায় ৩০টি গ্রাম তলিয়ে গেছে। পানিতে ডুবে সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে বীজ তলাসহ শত শত বিঘা জমির ফসল। ভেসে গেছে মৎস্য ঘের। ভেঙে পড়েছে স্যানিটেশন ও সুপেয় পানির ব্যবস্থা। ত্রাণের অভাবে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে পানিবন্দি মানুষ।
এলাকার বৃদ্ধ ও শিশুরা ভূগছে সর্দি কাশিসহ পানি বাহিত নানা রোগে। তালা উপজেলার কপোতাক্ষ তীরবর্তী গ্রামের পানিবন্দি মানুষ ধানদিয়া, নগরঘাটা, কুমিরা, সদর, ও তেঁতুলিয়া ইউনিয়নের নিমতলা, গাবতলা, দক্ষিণ নগরঘাটা, রাঢ়ীপাড়া, ভবানীপুর, কুমিরা মালোপাড়া, মন্দির খোলা, জুজখোলা, কাশিপুর, ঘোনা, ইসলামকাটি,খলিলনগরের নলতা, জালালপুর ইউনিয়নের কানাইদিয়া সহ ৩০টি গ্রামের নিম্নাঞ্চলের অধিকাংশ বাড়ি তলিয়ে গেছে। এলাকার বেশ কিছু বাড়ির ভিতরে পানি উঠে গেছে। পানিতে তলিয়ে গেছে কৃষকের আমন বীজতলা। নষ্ট হয়েছে শাকসবজির ক্ষেতও।
এরই মধ্যে কপোতাক্ষ নদের নতুন বাঁধের বিভিন্ন পয়েন্টে দেখা দিয়েছে বড় আকারের ভাঙন। কপোতাক্ষ নদের পানি এখন নিয়ন্ত্রণ বাঁধ উপচে সংযোগ খাল দিয়ে ধেয়ে আসছে লোকালয়ে। পলি জমে দুই দশক ধরে স্রোতহীন হয়ে পড়েছে কপোতাক্ষ নদ। বৃষ্টির কারণে নদের দুই পারের একাধিক গ্রাম জলাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। অতি বৃষ্টিতে নদের পানি উপচে তলিয়ে যাচ্ছে গ্রাম। তালা সদর উপজেলা সহ তার আশপাশের এলাকা অতিবৃষ্টি আর কপোতাক্ষের উপচে পড়া পানিতে ডুবে গেছে।
তালা উপজেলা পরিষদ অফিস, সমাজ সেবা, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর, মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা, মৎস অফিস, কৃষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, প্রাণী সম্পদ কর্যালয়, ভূমি অফিস, সেটেলমেন্ট অফিস, আনসার ভিডিপি অফিস, শিল্পকলা একাডেমী, উপজেলা জামে মসজিদ সহ বিভিন্ন সরকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে হাঁটু পর্যন্ত পানি উঠে গেছে। এছাড়া তালা উপজেলা পরিষদের সামনের রাস্তা, তালা সদর ইউনিয়ন পরিষদে হাঁটু পানি পেরিয়ে সবাইকে যাতায়াত করতে হচ্ছে। সরকারী অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হাঁটু পানির মধ্যেই তাদের কাজ সারতে হচ্ছে। যার ফলে তালা উপজেলাবাসীকে চরম দূর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। এ ছাড়া স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা সব কিছুই পানিতে তলিয়ে গেছে।
টানা বর্ষন ও কপোতাক্ষের উপচে পড়া পানিতে এই উপজেলায় স্থায়ী জলাবদ্ধতায় রুপ নিয়েছে। প্রতি বছরই এই উপজেলাবাসীকে পানির সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকতে হয়। এদিকে, স্থায়ী জলাবদ্ধতার ফলে মানবেতর জীবন-যাপন করতে হচ্ছে ওই উপজেলার মানুষদের। এদিকে, তালা-কলারোয়া আসনের এমপি এড. মুস্তফা লুৎফুল্লাহ সহ ১৪ দল নেতৃবৃন্দ বৃহস্পতিবার তালা উপজেলার জালালপুর, মাগুরা, ইসলামকাঠি সহ বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করে। এসময় এড, মুস্তফা লুৎফুল্লাহ বিভিন্ন পানি বন্দী এলাকার মানুষদের সাথে কথা-বার্তা বলেন ও খোঁজ-খবর নেন।
পানি বন্দী এলাকার মানুষরা এসময় তাকে অভিযোগের সুরে বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের দূর্ণীতি ও গাফলতি’র কারণে তালা উপজেলাবাসীকে এই কষ্ট পোহাতে হচ্ছে। টানা বর্ষণে ও কপোতাক্ষের উপচে পড়া পানি নিষ্কাশনের ব্যাপারে তালা-কলারোয়া আসনের এমপি এড. মুস্তফা লুৎফুল্লাহ বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের দূর্ণীতি ও অপরিকল্পিত ভাবে কপোতাক্ষ খননের কারণে তালাবাসী পানি বন্দী হয়ে পড়েছে। আমি মন্ত্রী ও সচিব সহ উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলেছি। তালা উপজেলা থেকে স্থায়ী জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া হবে।
এ ব্যাপারে তালা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ঘোষ সনৎ কুমার বলেন, তালা উপজেলার চারদিক থেকে শালিখা, কপোতাক্ষ, বেতনা ও শালতা নদী অবস্থিত। এই চার নদীর মাঝখানে তালা উপজেলা অবস্থিত। এই নদী গুলো প্রায় মৃত। কোটি কোটি টাকার বিনিময়ে নদী খননের নামে পানি উন্নয়ন বোর্ড দূর্ণীতি, অপরিকল্পিতভাবে চিংড়ি ঘের ও পানি নিষ্কাশনের কোন ব্যবস্থা না থাকায় এই জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে।
অতিবৃষ্টি আর কপোতাক্ষের উপচে পড়া পানি বন্দি এলাকায় আমরা জিআরের ১০ মেট্রিক টন চাল বিতরণ করেছি। যেসব এলাকায় বাঁধ ভেঙ্গে গেছে সেসব এলাকায় আমরা নিজেদের টাকা দিয়ে তা নির্মাণ করেছি। তবে নদী খননের জন্য যদি সেনাবাহিনী দিয়ে খনন কাজ করা ও এই এলাকার প্রতিটি রাস্তা যদি এক ফুট করে উঁচু করা হয় তবে এই জলাবদ্ধতার মধ্যে আমাদের আর পড়তে হবে না। তালা উপজেলার জলাবদ্ধতার পানি নিষ্কাশনের জন্য গঙ্গারামপুর থেকে বালিয়া পর্যন্ত একটি চ্যানেল করা প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।
তালা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান বলেন, আমরা ইতি মধ্যে কিছু বাঁধ নির্মাণ করেছি। বিশুদ্ধ পানি ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে। অতি জরুরীভাবে সব কিছুর পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। জেলাপ্রশাসন সুত্রে জানানো হয়েছে, তালা উপজেলার সাড়ে ২৭ হাজার মানুষ জলাবদ্ধতার শকার হয়েছে। প্রায় ৩ শ’ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। আড়াই হাজার বাড়িঘর কমবেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সরকারি ভাবে ১০ মেট্রিক টন জিআর চাল বিতরন করা হয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মধ্যে। এছাড়া কলারোয়া উপজেলার সাড়ে ১৩ শ’ পরিবার জলাবদ্ধতার শিকার হয়েছে।