03-08-15-PM_Cabinet-1

দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ৩ আগস্ট: অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা দখল করা কোনো রাষ্ট্রপতি অবসরভাতাসহ অন্যান্য সুবিধা পাবেন না। এমন বিধান রেখে নতুন আইন করতে যাচ্ছে সরকার, যা সোমবার মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে চূড়ান্ত অনুমোদন পেয়েছে।সচিবালয়ের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে রাষ্ট্রপতির অবসরভাতা, আনুতোষিক ও অন্যান্য সুবিধা আইন, ২০১৫-এর খসড়াটি উত্থাপন করা হয়।

বৈঠক শেষে অনুষ্ঠিত সংবাদ ব্রিফিংয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা বলেন, আগের অধ্যাদেশে অনুযায়ী আদালত একজন রাষ্ট্রপতিকে নৈতিক স্খলন বা অন্য কোনো অপরাধে দণ্ড দিলে তিনি অবসরভাতা পাওয়ার যোগ্য হবেন না। কিন্তু মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত নতুন আইন অনুযায়ী, অসাংবিধানিক পন্থায় বা অবৈধ উপায়ে রাষ্ট্রপতি হওয়ার বিষয়টি আদালত ঘোষণা করলে তিনিও অবসরভাতা ও অন্যান্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে অবসরে যাওয়ার পর অবসরভাতা বা অন্যান্য সুবিধার বিষয়টি নির্ধারিত হয় ১৯৭৯ সালের প্রেসিডেন্টস পেনশন অর্ডিনেন্স’ অনুযায়ী। ১৯৮৮ সালে অধ্যাদেশটি সংশোধন করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবার কখনো অবসরভাতা পায়নি, কারণ ওই আইনটি হয়েছিল ১৯৭৯ সালে। তবে জাতীয় সংসদে নতুন এই আইন পাস হলে বঙ্গবন্ধুর উত্তরাধিকারীরা তা পেতে পারেন।

03-08-15-PM_Cabinet-2সংবিধানের সপ্তম সংশোধনী বাতিল করে ২০১০ সালে হাইকোর্টের রায়ে খন্দকার মোশতাক আহমেদ, আবু সা’দাত মোহাম্মদ সায়েম ও জিয়াউর রহমানের মতো এইচ এম এরশাদকেও অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী হিসেবে উল্লেখ করা হয়।অবসরভাতার আইনটি এরশাদ, জিয়া অথবা তাঁদের উত্তরাধিকারীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে কি না, জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, তাঁরা সামরিক কর্মকর্তা হিসেবে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ভাতা নিচ্ছেন। রাষ্ট্রপতি হিসেবে অবসরভাতা তাঁরা নেন না।সভায় বাংলাদেশ কয়েনেজ (অ্যামেন্ডমেন্ট) অ্যাক্ট-২০১৫ এবং বাংলাদেশ রেশম উন্নয়ন বোর্ড (সংশোধন) আইন-২০১৫ চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়। গত ১৮ থেকে ২৬ মে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় অনুষ্ঠিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সম্মেলনে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের অংশগ্রহণ ও কার্যক্রম সম্পর্কে মন্ত্রিসভাকে অবহিত করা হয়।

সামরিক শাসনামলের জারি করা প্রয়োজনীয় অধ্যাদেশগুলো আইনে পরিণত করতে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা থাকায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ২০১৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর ‘রাষ্ট্রপতির অবসরভাতা, আনুতোষিক ও অন্যান্য সুবিধা আইন’ এর খসড়া মন্ত্রিসভায় উপস্থাপন করে। সে সময় মন্ত্রিসভার দেওয়া অনুশাসন’ অনুযায়ী নতুন করে খসড়া প্রস্তুত করে সোমবার বৈঠকে উপস্থাপন করা হয় বলে জানান সচিব।তিনি বলেন, অধ্যাদেশে শুধু ছিল, যদি কোনো রাষ্ট্রপতি নৈতিক স্খলন বা অন্য কোনো অপরাধে আদালতে দণ্ডিত হন তাহলে অবসর ভাতা পাবেন না। নতুন আইনে এর সঙ্গে যুক্ত করা হচ্ছে- অসাংবিধানিক পন্থায় অবৈধ উপায়ে রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন বা হয়েছিলেন মর্মে আদালত কর্তৃক ঘোষণা হলে তিনি অবসরভাতা, আনুতোষিক ও অন্যান্য সুবিধা পাবেন না।

২০১০ সালে সংবিধানের সপ্তম সংশোধনী বাতিল করে হাই কোর্টের এক রায়ে বলা হয়, খন্দকার মোশতাক আহমেদ, আবু সা’দাত মোহাম্মদ সায়েম এবং জিয়াউর রহমানের মতো এইচএম এরশাদও অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী। পরের বছর আপিল বিভাগেও ওই রায় বহাল থাকে; আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী সংবিধান সংশোধন করা হয়।১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পর খন্দকার মোশতাক নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন। ১৫ আগস্ট থেকে ৬ নভেম্বর পর্যন্ত অসাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

নিজেকে সেনাপ্রধান ঘোষণাকারী মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ নিহত হওয়ার পর মোশতাকই মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধান নিয়োগ করে যান।ওই বছরই ৩ ও ৬ নভেম্বর সামরিক অভ্যুত্থানের পর বিচাপতি সায়েমকে দেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।১৯৭৬ সালের ২৯ নভেম্বর তিনি জেনারেল জিয়াউর রহমানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন; জিয়া হন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক। ১৯৭৭ এর ২১ এপ্রিল স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে সায়েম রাষ্ট্রপতির পদ থেকে সরে দাঁড়ালে জিয়া ওই দায়িত্বও নেন।

তার আগে ৩০ মে জিয়ার সামরিক শাসনকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টায় একটি গণভোটের আয়োজন করা হয়, যাতে ৯৮.৯ শতাংশ ‘হ্যাঁ’ ভোট পড়ে।পরে ১৯৭৮ সালের ৩ জুন নির্বাচন দিয়ে রাষ্ট্রপতি হন জিয়াউর রহমান। ১৯৮১ সালের ৩০ মে এক সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি ক্ষমতায় ছিলেন।জিয়ার মৃত্যুর পর ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করেন জেনারেল এইচ এম এরশাদ।

তিনি নিজে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হয়ে রাষ্ট্রপতির আসনে বসান বিচারপতি এ এফ এম আহসানুদ্দিন চৌধুরীকে।১৯৮৩ সালের ১১ ডিসেম্বর বিচারপতি আহসানুদ্দিনকে সরিয়ে এরশাদ রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন। জিয়ার মতোই গণভোটের মাধ্যমে নিজের কর্তৃত্বকে বৈধ রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেন। ১৯৮৫ সালের ২১ মার্চ ওই গণভোটে তিনি পান ৯৪.৫ শতাংশ ভোট। পরে ১৯৮৬ সালে এরশাদ রাষ্ট্রপতি নির্বাচন দেন এবং নির্বাচিত হন। ৯ বছর ক্ষমতায় থাকার পর ব্যাপক গণ আন্দোলনের মুখে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন তিনি।

অবসরভাতার এ আইন এরশাদ বা জিয়া কিংবা তাদের উত্তরাধীকারদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে কি না জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, তারা রাষ্ট্রপতি হিসেবে অবসরভাতা নেন না। তারা সামরিক কর্মকর্তা হিসেবে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ভাতা নিয়ে থাকেন।আরেক প্রশ্নের জবাবে মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবার কখনো পেনশন নেয়নি, কারণ ওই আইনটিই হয়েছিল ১৯৭৯ সালে। তবে নতুন আইন পাস হলে বঙ্গবন্ধুর উত্তরাধীকারীরা তা পাবেন।মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, কেউ যদি রাষ্ট্রপতি পদে দায়িত্ব পালন শেষে এমন কোনো দপ্তরে বা পদে দায়িত্ব পালন করেন, যার জন্য তিনি প্রজাতন্ত্রের সংযুক্ত তহবিল থেকে বেতন বা অন্যান্য সুবিধা পেয়েছেন বা পাচ্ছেন, তাহলে তিনিও রাষ্ট্রপতি পদের পেনশন পাবেন না বলে খসড়ায় উল্লেখ করা হয়েছে।

বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে অধ্যাদেশ জারির সময় পর্যন্ত যারা রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেছেন, তাদের সবার ক্ষেত্রেই এই আইন প্রযোজ্য হবে বলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানান।তিনি বলেন, মূল অধ্যাদেশে বলা হয়েছিল, এটি ১৯৮৮ সালের ৪ এপ্রিল থেকে কার্যকর হবে। কিন্তু এ সময়ের আগে যারা রাষ্ট্রপতি ছিলেন, তাদের ক্ষেত্রে কী হবে?… কাজেই এ বিধানটা প্রশ্নবিদ্ধ। বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে যারাই রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেছেন, তারা পেনশন পাবেন।

সচিব জানান, পেনশনের বিষয়ে মূল অধ্যাদেশে ন্যূনতম ৭ হাজার ৫০০ টাকার কথা বলা হয়েছিল। ১৯৭৯ সালে রাষ্ট্রপতির বেতন ছিল ১০ হাজার টাকা।তখন ন্যূনতম সাড়ে সাত হাজার টাকা দরকার ছিল। এখন এটি অনাবশ্যক হয়ে গেছে। এ বিষয়টি বাদ দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে রাষ্ট্রপতি ৬১ হাজার ২০০ টাকা বেতন পেয়ে থাকেন। এর ৭৫ শতাংশ হারে মাসিক অবসর ভাতা হয় ৪৫ হাজার ৯০০ টাকা।বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করলেও তার পরিবার এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রপতির অবসরভাতা, আনুতোষিক ও অন্যান্য সুবিধা নেননি।

অন্যদিকে, সাবেক রাষ্ট্রপতি ডিয়াউর রহমানের পরিবার এবং সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে অবসরভাতা, আনুতোষিক ও অন্যান্য সুবিধা নিয়েছেন। বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, সামরিক শাসনামলে জারি করা ১৯৭৯ সালের অধ্যাদেশটি হালনাগাদ করে আইন করা হচ্ছে। এর আগে এ সংক্রান্ত্র কোনো আইন ছিল না। মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা বলেন, ১৯৭৯ সালের আগে রাষ্ট্রপতির পেনশন আইন ছিল না। ১৯৭৯ সালে এ অধ্যাদেশটি জারি করা হয়। তখন ছিল সামরিক শাসন। সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনা ও সংবিধান সংশোধনীর কারণে সামরিক শাসনামলে জারি করা অধ্যাদেশ সংশোধনসহ হালনাগাদ করে বাংলায় আইনটি করা হচ্ছে।

২০১৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর মন্ত্রিসভায় উপস্থাপন করা হলেও মন্ত্রিসভা তখন অনুমোদন করেনি। ওই সভায় নির্দেশনা ছিল, বিদ্যমান অধ্যাদেশে যদি কোনো টওাক্তন রাষ্ট্রপতি নৈতিক স্খলন বা ফৌজদারি অপরাধে দণ্ডপ্রাপ্ত হন তাহলে পেনশন-গ্র্যাচুয়িটি পাবেন না। আর একটি বিষয় ছিল, যারা অবৈধপন্থায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা নিয়েছেন মর্মে আদালতের মাধ্যমে সাব্যস্ত হন, তাহলে অবসরভাতা ও গ্রাচুয়িটি পাবেন কিনা তার বিধান থাকা দরকার।এ কারণেই আইনের খসড়াটি সংশোধন করে বৈঠকে তোলা হয়েছে। লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগ এটি দেখে মতামত দিয়েছে। সেই খসড়াটি পরিমার্জিত অবস্থায় মন্ত্রিসভায় তোলা হয়েছে বলে তিনি জানান।

আইন সংশোধনের প্রেক্ষাপট উল্লেখ করে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, মূল অধ্যাদেশে বলা ছিল বেতনের ৭৫ শতাংশ হারে মাসিক পেনশন পাবেন রাষ্ট্রপতি। তখন রাষ্ট্রপতির বেতন ছিল ১০ হাজার টাকা। সেই হিসেবে রাষ্ট্রপতির পেনশন কমপক্ষে হবে সাত হাজার ৫শ টাকা।এখন আইনে আর এটির প্রয়োজন নেই। কারণ, এখন রাষ্ট্রপতির বেতন ৬১ হাজার ২শ টাকা। আর অবসরভাতা ৪৫ হাজার ৯শ টাকা। কাজেই অনাবশ্যক বিষয়টি বাদ দেওয়া হয়েছে।রাষ্ট্রপতি যে কয়বছর দায়িত্ব পালন করেছেন তার সেই পরিমাণকে বছর দিয়ে গুণ করা হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আট বছর ধরা হয়।

তবে কেউ যদি আট বছরেরও বেশি দায়িত্ব পালন করেন, তাও আট দিয়ে গুণ করেই পেনশনভাতা ও অনুতোষিক পেতেন। মন্ত্রিপরিষদ মনে করে, এটি থাকার দরকার নেই। তাই আইন সংশোধন করে যে সময় পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেছেন সে সময়েরই অবসরভাতা ও আনুতোষিক পাবেন। এছাড়া দেশ স্বাধীনের পর থেকে যারা রাষ্ট্রপতি হয়েছেন, তারা সবাই অবসরভাতা ও আনুতোষিক পাবেন। মন্ত্রিসভার নির্দেশনা অনুযায়ী আইনে এটি করা হয়েছে।

সচিব বলেন, তবে েেকউ অসাংবিধানিক উপায়ে ক্ষমতায় গেলে রাষ্ট্রপতি হিসেবে অবসরে যাওয়ার পর পেনশন-গ্র্যাচুয়িটি পাবেন না। নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধে কোনো আদালতে দোয়ী সাব্যস্ত হলেও পেনশন-গ্র্যাচুয়িটি পাবেন না।এছাড়া রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠান শেষে কেউ যদি অন্য কোনো দফতরে পদে বা মর্যাদায় দায়িত্ব পালন করেন ও বেতন বা অন্য কোনো সুবিধাদি পান তাহলে অবসরভাতা, আনুতোষিক ও অন্যান্য সুবিধা পাবেন না।আগের অধ্যাদেশেও রয়েছে, কেউ যদি ফৌজদারি আদালতে দোষী সাব্যস্ত হন তাহলে অবসরভাতা প্রাপ্য হবে না, যোগ করেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব।