দৈনিকবার্তা-গৌরনদী, ৩১ জুলাই: বরিশাল বিভাগীয় কথিত বেদে সর্দারের দাবিকৃত মাসিক চাঁদা দিতে অস্বীকার করলেই সাধারন বেদে পরিবারকে মিথ্যা মামলায় আসামিসহ মিথ্যা অভিযোগে হয়রানী করা হয়। চাঁদা না দেওয়ায় কোন কোন পরিবারের বিরুদ্ধে ২৫/৩০টি মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
চাঁদা না দেওয়ায় নির্যাতনের শিকার, ভ’ক্তভোগী ও স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বরিশালের গৌরনদী উপজেলার পৌর সদরে টরকীর চর গ্রামে নদীর তীরে গত ২০ বছর ধরে প্রায় ৫ শতাধিক বেদে পরিবার বসবাস করে আসছে। ওই বেদে পল্লীর সর্দার ছিলেন ঝালকাঠী জেলার কৃঞ্চকাঠী গ্রামের মৃত সেকেন্দার আলী সরদারের পুত্র রুস্তুম আলী ওরফে আব্দুর রহিম। সাধারন বেদে পরিবারের সদস্যরা জানান, আব্দুর রহিম সর্দারের দায়িত্ব পালনকালে তার একান্ত অনুগত ২২ নারী সদস্য দিয়ে একটি প্রতারক দল গঠন করেন। ওই দলের মাধ্যমে বিভিন্ন গ্রামে সাধারন নিরহ মানুষের সাথে প্রতারনা করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন। কেউ কেউ এ ঘটনার বিরোধিতা করলে সর্দার তাদের উপর নির্যাতন চালায়। প্রতারনা চাঁদাবাজি নারী নির্যাতনের প্রতিবাদে ২০১১ সালে আব্দুর রহিমকে সর্দারের পদ থেকে অব্যহতি দেয়া হয়।
পল্লীর লোকজন জানান, অব্যহতি দেওয়ার পর আব্দুর রহিম নিজ বাড়ি ঝালকাঠীর কৃঞ্চকাঠী গ্রামে ফিরে যান। সেখানে গিয়ে নতুন করে একটি বেদে দল গঠন করেন এবং ২০১২ সাল থেকে নিজেকে বরিশাল বিভাগীয় বেদে সর্দার হিসেবে পরিচয় দেন। সেখানে গড়ে তোলেন স্বীয় রাজত্ব। বিভিন্ন কৌশলে বরিশাল বিভাগীয় বেদেদের নিয়ন্ত্রনের চেষ্টা করেন। তার নির্দেশ অমান্য করা হলে তাদের উপর নেমে আসে নির্যাতন, মিথ্যা মামলাসহ নানান হয়রানী।
বেদে পল্লীর নান্নু সরদার(৫৫),স্বপন সরদার (৩৮), জাহাঙ্গীর সরদার(৫৫)সহ অনেকেই জানান, বরিশাল বিভাগের স্বঘোষিত সর্দার আব্দুর রহিম প্রতিটি বেদে পরিবারের কাছে মাসিক ৭ শত করে চাঁদা নির্ধারন করেন। এমনিভাবে গত তিন বছরে প্রায় ২৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন। গত ৬ মাসে ধরে সাধারন বেদে পরিবারের লোকজন চাদা দেওয়া বন্ধ করে দেন। এতে আব্দুর রহিম ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে এবং বেদে পরিবারকে নানানভাবে নির্যাতন ও হয়রানী করে আসছেন।
স্বপন অভিযোগ করেন, চাদা না দেওয়ায় আব্দুর রহিম ঝালকাঠী সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেড আদালতে তার পরিবারের ৭ জনকে আসামি করে ১০/০৫/২০১৫ তারিখে একটি মামলা করেন। তিনি মামলায় পলাতক থাকা অবস্থায় রহিম তার স্ত্রীকে খবর দিয়ে স্বামীকে মুক্ত করে দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে স্ত্রী পাখি বেগম (৩০) কন্যা রাত্রী (৫ কে তার আস্তানায় আটক করেন।
শারীরিক ও মানষিক নির্যাতন করে ৭ দিন আটকে রাখে । পরবর্তীতে নিদের্শস অমান্য করার জড়িমানা ও মামলা খরচসহ সাড়ে তিন লাখ টাকা হাতিয়ে মামলা প্রত্যাহার ও তাদের মুক্ত করেন। মজিবর সরদার(৪০), আঃ জলিল সরদার (৪৫) অভিযোগ করেন, তারা চাঁদা দেওয়ায় আঃ রহিম তার ছোট ভাই আলাউদ্দিন সরদার বাদি হয়ে ২৫/০৬/২০১৫ইং একই আদালতে একটি চাদাবাজি ও হত্যার চেষ্টা অভিযোগে ৩ জনকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করেন। পরবর্তীতে মিমাংসার নামে আড়াই লাখ টাকা হাতিয়ে নেন।
বেদে কবির হোসেন, ছগির হোসেন, মিজানুর রহমান অভিযোগ করেন, চাঁদা না দেওয়ায় রহিম তার ভাই আলাউদ্দিনকে দিয়ে বাদি করে তাদের ৫ জনকে আসামি করে গত ১৫/০৫/২০১৫ইং ওই আদালতে একটি মামলা করেন। পরবর্তীতে রহিমকে দেড় লাখ টাকা পরিশোধ করে মামলা থেকে অব্যহতি পান। পিকু সরদার জানান, চাদা না দেওয়ায় আব্দুর রহিম তাদের পরিবারের বিরুদ্ধে গত ৩ বছরে ১৩টি মামলা করেন।
মামলাগুলো মিথ্যা প্রমানিত হয়েছে। এ ঘটনায় পিকু গত ৪ জুলাই গৌরনদী থানায় রহিমের বিরুদ্ধে একটি জিডি করেন। এর আগে স্বপন সরদার গত ২৫ জুলাই গৌরনদী থানায় একটি জিডি করেন। জিডিতে বলা হয়, চাদা না দেওয়ায় মিথ্যা মামলায় হয়রানীসহ জীবন নাশের হুমকি দেয়। ভ’ক্তভোগীরা জানান, অব্দুর রহিম তার বিভিন্ন সহযোগীকে দিয়ে ঝাালকাঠী জুডিশিয়াল আদালতে মামলা করার পর আসামিরা সেখানে হাজির হতে গেলে রহিম তার লোকজন নিয়ে তাদের ধরে নিয়ে যায়। পরবর্তীতে রহিমের নিজস্ব আদালতে বিচার সম্পন্ন করে মোটা অংক আদায় করে মিমাংসাপত্র দিয়ে মামলা প্রত্যাহার করে নেন।
রহিম সর্দারে নির্দেশ অমান্য করলে হয়রানী শিকার হতে হয় সাধার বেদে পল্লীর লোকজনকে । স্বপন সরদার জানান, তিনি ২২ জুন তার বেদে বহর নিয়ে মাদারীপুর জেলায় মস্তফাপুর যান। এসময় আব্দুর রহিম নিজেকে বরিশাল বিভাগীয় বেদে সর্দার পরিচয় দিয়ে পুলিশকে ফোনে জানান, ওই বেদে বহরে ২ হাজার পিচ ইয়াবা ও ৬ কেজি গাঁজা রয়েছে। ওই মিথ্যা তথ্যে ভিত্তিতে পুলিশ বেদে বহরে অভিযান চালিয়ে সত্যতা না পেয়ে ফিরে আসে।
আলাউদ্দিন সরদার জানান, তিনি ১৮ জুলাই বেদে বহর নিয়ে পটুয়াখালি জেলার বাউফল উপজেলার কালাইয়া গেলে আব্দুর রহিম পটুয়াখালি পুলিশকে একইভাবে জানান, বেদে বহরে হিরোইন ও মদের ড্রাম রয়েছে। কলম সর্দার জানান, সে ১৯ জুলাই পিরোজপুর জেলার মঠবাড়িয়া থানায় বেদে বহর নিয়ে যান। এসময় রহিম পিরোজপুর পুলিশকে একইভাবে মিথ্যা তথ্য দিয়ে পুলিশ পাঠিয়ে বেদেদের হয়রানী করেন।
গত ২২ জুলাই রহিম সর্দার বরিশাল পুলিশকে জানান, গৌরনদীর বেদে পল্লীতে বিপুল পরিমান ইয়াবা ও পেট্রোল বোমা তৈরীর সরঞ্জাম মজুদ আছে। কিন্তু অভিযান চালিয়ে কিছুই পাওয়া যায়নি। রহিমের দেওয়া তথ্যের সত্যতা কোথাও পাওয়া যায়নি বলে পুলিশ কর্মকর্তারা জানান। বেদেরা জানান, তারা বরিশাল বিভাগের যে জায়গায় যাক সেখানের প্রশাসনকে মিথ্যা মামলা ও মিথ্যা তথ্য দিয়ে হয়রানী করেন।
পিন্টু জানান, ২২ সেপ্টেম্বর ২০০১১ সালে চাদা না দেওয়ায় রহিম তার বোনকে ধর্ষনের চেষ্টা চালায়। ওই ঘটনায় রহিমের বিরুদ্ধে গৌরনদী থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়। এছাড়া একাধিক বেদে কন্যাকে ধর্ষন করে যা আত্ম সম্মানের ভয়ে কেউ মামলা করতে যায়নি। অভিযোগের ব্যাপারে আব্দুর রহিমকে জিজ্ঞাসা করলে রহিম নিজেকে বরিশাল বিভাগীয় সর্দার ও নিজেকে নির্দোশ দাবি করে বলেন, আমি কারো কাছে চাঁদা দাবি করিনি বরং অভিযোগকারীরাই আমার পল্লীর বেদেদের কাছে চাদা দাবি করেন।
হয়রানী ও মিথ্যা অভিযোগ প্রসঙ্গে বলেন, আমি কাউকে হয়রানী করি নাই, ওরা খারাপ কাজের সাথে যুক্ত। মঠবাড়িয়া থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জানান, অভিযান চালানোর সত্যতার কথা স্বীকার করে বলেন, কোন কিছু পাওয়া যায়নি। মাদারীপুর সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জিয়াউল মোর্শেদ জানান, ইনফরমেশনের ভিত্তিতে অভিযান চলতেই থাকে তবে বড় কোন অভিযান বা সফলতার খবর নেই।
গৌরনদী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. হুমায়ুন কবির বলেন, বেদে পল্লীর আধিপত্য বিস্তারের বিরোধকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সময় মিথ্যা তথ্য দেয় কিন্তু অভিযান চালিয়ে কিছু পাওয়া যায়নি। পটুয়াখালি জেলার বাউফল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আ,জ,ম, মাসুদুজ্জামান ঈদের দিনে অভিযান সম্পর্কে বলেন, ইনফরমেশন পাওয়ার পরে অভিযান চালানো হয় তবে কোন কিছু পাওয়া যায়নি।