দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ৩০ জুলাই: সুন্দরবনের বাঘ ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বেড়াতে গেছে বলে মন্তব্য করেছেন বন ও পরিবেশ মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন। তাই বাঘের সংখ্যা কম হওয়ায় হতাশ না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। মন্ত্রী বলেন, যখন ওই বাঘগুলো ফিরে আসবে, তখন সংখ্যা বাড়বে।বিশ্ব বাঘ দিবস-২০১৫ উপলক্ষে বৃহস্পতিবার রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানে মন্ত্রী এসব কথা বলেন। বাঘ বাঁচলে, বাঁচবে বন, রক্ষা পাবে সুন্দরবন’এই স্লোগানকে সামনে রেখে এবারের বাঘ দিবসের নানা কর্মসূচি পালিত হয়।
দিবসের মূল অনুষ্ঠানে বাঘ রক্ষায় দেশে সচেতনতা তৈরি হয়েছে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, সবাই মিলে এই বাঘকে রক্ষা করতে হবে। মন্ত্রী বলেন, যেকোনো পরিসংখ্যানই সবচেয়ে বড় মিথ্যা কথা। কেননা বাঘ কতটা পাওয়া গেছে, এর চেয়ে বড় কথা হচ্ছে বাঘ কখন গোনা হয়েছে।বাঘ দিবসের অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মোস্তফা ফিরোজ বলেন, ২০১১ সালে রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত বাঘ সম্মেলনে বাংলাদেশ যে অঙ্গীকার করেছিল, তা যদি বাস্তবায়ন হতো, তাহলে আজকের বাঘের সংখ্যা এতটা কমে আসত না।
বনের ভেতর দিয়ে নৌযান চলাচল করার কথা ছিল না। বাঘ রক্ষা করতে হলে সুন্দরবনের ভেতরে এসব তৎপরতা বন্ধ করতে হবে।অনুষ্ঠানে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব সরকারের বাঘ রক্ষায় নেওয়া নানা উদ্যোগের কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, বাঘের আবাসস্থল রক্ষায় উন্নয়ন সহযোগী দেশগুলো সহায়তা করছে। এই সহায়তা অব্যাহত রাখার আহ্বান জানান তিনি। বন বিভাগের জরিপে গত এক দশকে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা এক চতুর্থাংশে নেমে আসার তথ্য মিললেও রয়েল বেঙ্গল টাইগারের বিলুপ্তির শঙ্কা উড়িয়ে দিয়েছেন বন ও পরিবেশমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু।
মন্ত্রী বলেন, আমার জানা মতে পরিসংখ্যান হল সবচেয়ে বড় মিথ্যা কথা। যারা এসব পরিসংখ্যান তৈরি করেন তারা সত্যবাদী নন।যারা বাঘ বিলুপ্তির শঙ্কায় ভুগছেন, তাদের উদ্দেশে মন্ত্রী বলেন, চলেন বাঘ গুণতে যাই। তারপর বলি, কে কতো বাঘ দেখতে পেয়েছি।ক্যামেরা ট্র্যাপিং পদ্ধতিতে বাংলাদেশের বন বিভাগ ও ভারতের বন্য প্রাণী ইনস্টিটিউটের সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা যায়, বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে বর্তমানে রয়েল বেঙ্গল টাইগার রয়েছে মাত্র ১০৬টি।১৯৭৫ সালের জরিপে (বুবার্ট হ্যান্ড্রিস) সুন্দরবনে ৩৫০টি বাঘের সংখ্যা নিরূপণ করা হয়।
১৯৮৪ সালের জরিপে (গিটিন্স ও আকন্দ) ৪৩০টি থেকে ৪৫০টি, ১৯৯২ সালে বন বিভাগের জরিপে ৩৫৯টি, ১৯৯৩ সালের পদচিহ্ন জরিপে (তামাংগ ও দে) ৩৬২টি, ২০০৪ সালের পাগমার্ক পদ্ধতির শুমারিতে (বন বিভাগ, ইউএনডিপি ও ভারতীয় বিশেষজ্ঞ) ৪৪০টি (২১ বাচ্চাসহ) ও ২০০৯ সালে রেডিও টেলিমেট্রি জরিপে (বন বিভাগ ও ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাস্ট অব বাংলাদেশ) ৪০০টি থেকে ৪৫০টি বাঘ রয়েছে বলে ফলাফল প্রকাশ করা হয়।বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাঘ কমে যাওয়ার অর্থ হল, এই প্রাণীটির আবাসস্থল সঙ্কটে পড়েছে।
গত সেপ্টেম্বরে দ্বিতীয় ‘বিশ্ব বাঘ স্টকটেকিং সম্মেলনে প্রানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বাঘ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, বাঘ হত্যা ও বাঘের আবাসস্থল সঙ্কোচনের ফলে এই প্রাণীটি এখন বিলুপ্তির পথে।বিশ্বনেতাদের প্রতি সে সময় তিনি আহ্বান জানিয়েছিলেন, আসুন সকলে মিলে আমরা বাঘ বাঁচাই, প্রকৃতি বাঁচাই।অবশ্য প্রধানমন্ত্রী বা বিশেষজ্ঞদের ওই বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন জাতীয় পার্টির(জেপি) চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জু।বাঘ দিবসের অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, প্রথমত বাঘ আমাদের দেশের প্রাণী নয়। এটি এখানে মাইগ্রেশন করে এসেছে।
অনেক প্রাণী ইতোমধ্যে বিলুপ্ত হয়েছে। কিন্তু এটুকু নিশ্চিত, এখানে আমরা যারা উপস্থিত রয়েছি, আমাদের জীবদ্দশায় বাঘ বিলুপ্ত হবে না।এই বিশ্বাসের পেছনে মন্ত্রীর যুক্তি, যতো বাঘ বনে আছে, তার চেয়ে বেশি আছে খাঁচায়। সুতরাং বাঘ বিলুপ্ত হয়ে যাবে না। অন্তত আমাদের জীবদ্দশায় নয়।আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বলেন, বাঘ রক্ষার জন্য বিশ্ব ব্যাংক ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থায়নে বিভিন্ন প্রকল্প রয়েছে। তারা বাঘ সংরক্ষণকে উৎসাহিত করে। কিন্তু যখনই বাঘ কমে যাওয়ার খবর প্রকাশিত হয়, তখনই দায়ী করা হয় সরকারকে। যারা ‘রক্ষার দায়িত্ব নিয়েছেন’ তাদের কেউ ‘কিছু বলে না’।
অবশ্য এরপর মন্ত্রীর কথায় পাওয়া যায় অন্য সুর। বাঘ রক্ষায় সচেতন হওয়ার তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ বাঘ রক্ষা করতে চায় না বলেই আমার মনে হয়। কারণ সুন্দরবনের গাছ তাদের কাটতেই হবে। এখানে কোনো বিকল্প জ্বালানি নেই। মানুষকে টিকে থাকার জন্য সুন্দরবনের উপরে নির্ভর করতে হবে। বাঘ রক্ষার মন মানসিকতা মনে হয় আমাদের নেই।পরিবেশবাদীদের কটাক্ষ করে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বলেন, সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশ থেকে বাঘ ভারতের দিকে চলে যাচ্ছে বলে অনেকে হৈ চৈ করেন। আমি বলি, বাঘ ওপারে বেড়াতে গেছে, আবার চলে আসবে।অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাঘ গবেষক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোস্তফা ফিরোজ।
অনুষ্ঠানের শুরুতেই বন বিভাগের বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বন সংরক্ষক তপন কুমার দে বলেন, ১৯০০ সালে বিশ্বে বাঘের সংখ্যা ছিল এক লাখ। বর্তমানে তা চার হাজারে নেমে এসেছে। সুন্দরবনের বাঘ রক্ষায় বনের ভেতর দিয়ে নৌপথ বন্ধ করতে বিকল্প পথ মংলা-ঘসিয়াখালি নৌপথ চালু করার ওপরে গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন, নৌপথ চালু হওয়ার পর বনের বাঘ শিকার বেড়েছে।সভাপতির বক্তব্যে প্রধান বন সংরক্ষক ইউনুস আলী বলেন, বাঘ হত্যা ও পাচারের সঙ্গে জড়িত চক্রকে বন বিভাগ চিহ্নিত করেছে। সুন্দরবনের পাশের এলাকার বেশ কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি, বন বিভাগের নিচু স্তরের কিছু কর্মকর্তাসহ অনেকেই বাঘ পাচারের সঙ্গে জড়িত বলে ইন্টারপোল থেকে তথ্য দেওয়া হয়েছে।
বন বিভাগ ওই তথ্য পর্যালোচনা করে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে।অনুষ্ঠানে বিশ্বব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত কান্ট্রি ডিরেক্টর ক্রিস্টিনি ই কিম্যাস বলেন, বাংলাদেশের বাঘ ও সুন্দরবন রক্ষায় বিশ্বব্যাংক তার সহযোগিতা অব্যাহত রাখবে। বাংলাদেশের তরুণ সমাজের মধ্যে বাঘ রক্ষায় যে সচেতনতা তৈরি হয়েছে, এটাকে কাজে লাগাতে বন বিভাগকে তিনি পরামর্শ দেন।অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব খন্দকার রাকিবুর রহমান ও উপ-প্রধান বন সংরক্ষক আকবর হোসেন।