Law-md20150729134741

দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ২৯ জুলাই: ৭১ এর সকল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া দ্রুত শেষ করার দাবি জানিয়ে গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ডা. ইমরান এইচ সরকার বলেছেন,এ বিচার জাতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আধুনিক বাংলাদেশ গড়তে ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে এ বিচার প্রক্রিয়া দ্রুত শেষ করে আমাদের সামনের দিকে এগোনোর পথ প্রশস্ত করতে হবে।বুধবার শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরের সামনে মানবতাবিরোধী অপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর রায়ের প্রতিক্রিয়ায় তিনি সাংবাদিকদের সামনে এসব কথা বলেন। প্রায় দুই বছর আগে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া সালাউদ্দিনের ফাঁসির আদেশ বহাল রেখে বুধবার রায় দেয় প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বাধীন চার সদস্যের আপিল বেঞ্চ।

তিনি বলেন, আমরা প্রত্যাশা করছি যে, যত দ্রুত সম্ভব গতি বাড়িয়ে এ বিচার প্রক্রিয়াকে শেষ করতে হবে। কেন না এ বিচার প্রক্রিয়া যত দীর্ঘ হবে ততই যুদ্ধাপরাধীসহ সাকা চৌধুরীদের মত অপশক্তিরা ষড়যন্ত্র করার সুযোগ পাবে। এ বিচার প্রক্রিয়া দ্রুত শেষ করে আমরা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে আগামীর বাংলাদেশ বিনির্মাণে উন্নয়নের যে নীতি, বৈষম্য মুক্ত সমাজ গড়ার যে রাজনীতি, সেদিকে মনযোগী হতে পারবো।

ইমরান বলেন, ‘ই রায় বাংলাদেশের একটি ঐতিহাসিক বিজয়। আমরা ৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি। ৭১ যেমন আমাদের বুকের গভীরে আঁকা আছে, ঠিক তেমনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আমাদের নতুন প্রজন্মের একান্ত চাওয়া। সুতরাং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো উপায় নেই।এদিকে সাকা চৌধুরীর রায়ের প্রতিক্রিয়া বুধবার সকালে গণজাগরণ মঞ্চের বিজয় মিছিল বের করার কথা ছিলো। কিন্তু আদালতের নিষেধাজ্ঞার কারণে বিজয় মিছিল বেড় করেনি গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীরা।

এ বিষয়ে মঞ্চের মুখপাত্র বলেন, আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই আমরা বিজয় মিছিলটি বের করিনি। কেননা মিছিল বের করার আগে পুলিশ আমাদের জানিয়েছে যে, কোনো ধরনের মিছিল বা সমাবেশ করা যাবে না। এ কারণে আমরা মিছিল বের করিনি।মঞ্চের অপর কর্মী ও ছাত্রনেতা লাকী আক্তার বলেন, আদালত থেকে একটি নির্দেশনা রয়েছে মর্মে পুলিশ আমাদের জানানোর কারণে আমরা মিছিল বের করিনি।এ রায়কে কেন্দ্র করে সকাল ৯টা থেকে গণজাগরণ মঞ্চের প্রায় শতাধিক কর্মী জাতীয় জাদুঘরের সামনে সমবেত হয়। তাদের প্রত্যাশা ছিলো মিছিল বের করবে।

কিন্তু পুশিলের নিষেধাজ্ঞার কারণে তারা মিছিল বের করেনি।শাহবাগে অবস্থানরত এক পুলিশ কর্মকর্তা পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বাংলামেইলকে বলেন,রায়কে কেন্দ্র করে গণজাগরণ মঞ্চ যেন কোনো মিছিল বেড় করতে না পারে সে জন্য নির্দেশ রয়েছে। এ কারণে আমরা এখানে অবস্থান করছি।এদিকে, মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধে বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর ফাঁসির রায় আপিলে বহাল থাকায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন দেশের বিশিষ্ট নাগরিকরা।রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের সদস্যসচিব ও সিনিয়র সাংবাদিক হারুন হাবিব বলেন, এ রায় যুগান্তকারী । এ রায়ে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় সাকা চৌধুরীর রূপ ছিল অত্যন্ত ভয়ংকর। তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ দেখে যে কেউ আঁতকে উঠবে। তার হাতে নির্যাতিতরা দীর্ঘদিন পর হলেও ন্য্য়াবিচার পেয়েছে।

প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ বলেছেন, এই রায়ের মাধ্যমে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সাকা চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধের সময় হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর নির্যাতন চালিয়েছেন। আজকে এই অপরাধের বিচারের মাধ্যমে প্রমাণ হলো, এটি একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র। তিনি বলেন, বিভিন্ন সময় ট্রাইব্যুনালকে গালিগালাজ করেছেন সাকা চৌধুরী। দাম্ভিকতা দিয়ে তিনি নিজেকে ল’মেকার দাবি করতেন। এই রায়ের মাধ্যমে এই সত্য প্রতিষ্ঠিত হলো যে, আসলে আইনের ঊর্ধ্বে কেউ নয়।প্রসিকিউটর রানা দাস গুপ্ত বলেন, সাকা চৌধুরী চট্রগ্রাম অঞ্চলের ভয়ংকর যুদ্ধাপরাধী তা সর্বোচ্চ আদালতে আপিলের চূড়ান্ত রায়েও প্রমাণিত হলো। এ রায়ে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে।

হেভিওয়েট এ অপরাধীর বিরুদ্ধে প্রদত্ত এ রায় দেশের আইনের শাসনের জন্য মাইলফলক হয়ে থাকবে।মুক্তিযোদ্ধা ম. হামিদ বলেন, এ রায়ে মুক্তিযোদ্ধাসহ দেশবাসী খুশি হবে। সাকা চৌধুরী শুধু মানবতাবিরোধী অপরাধই করেননি, তিনি বিভিন্ন সময় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, আমাদের জাতীয় সংগিত, স্বাধীনতা সংগ্রামসহ নানা বিষয়ে ঔদ্ধত্যপূর্ন কটাক্ষ ও আচরণ করেছেন। এ রায় প্রত্যাশিত।

সুপ্রিমকোর্ট বারের সাবেক সম্পাদক এডভোকেট শ ম রেজাউল করিম বলেন, দাম্ভিকতা ঔদ্ধত্যপূর্ন আচরণ এবং সমাজের উঁচু জায়গায় অবস্থান করলেও কেউ আইনের উর্দ্ধে নয়-তা সাকা চৌধুরীর রায়ের মধ্য দিয়ে আবারো প্রমাণিত হলো। এ রায়ের মধ্য দিয়ে বিচাগের বিভাগের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা ও আস্থা আরো বেড়ে যাবে। এ রায় আইনের শাসনের ক্ষেত্রে মাইলফলক ও যুগান্তকারী হয়ে থাকবে।মুক্তিযোদ্ধা জহির উদ্দিন জালাল ওরফে বিচ্ছু জালাল রায়ের প্রতিক্রিয়ায় বলেন, রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এ রায়ে আমরা সন্তুষ্ট ও গর্বিত। সাকা চৌধরীর নৃশংসতার বিচার হলো। মৃত্যুদন্ডই তার উপযুক্ত শাস্তি। তিনি বলেন, ৭১সালে সাকা চৌধুরী যে ধরনের হত্যা- গণহত্যা চালিয়েছে, এই রায়ের মাধ্যমে তার কোনো প্রতিকার হয় না। তবে রায়ে নিশ্চয়ই শহীদদের আত্মা শান্তি পাবে এবং দেশের মুক্তিযোদ্ধারা খুশি হবে।

অন্যদিকে, যুদ্ধাপরাধী বিএনপিনেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মৃত্যুদণ্ডাদেশ আপিলের রায়ে বহাল থাকায় সন্তোষ প্রকাশ করে দ্রুত সাজা কার্যকরের দাবি জানিয়েছেন চট্টগ্রামের মুক্তিযোদ্ধা এবং মামলার সাক্ষীরা।এ রায়ের মধ্য দিয়ে চট্টগ্রাম কলঙ্কমুক্ত হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন কেউ কেউ।এ মামলায় সালাউদ্দিনের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেওয়া সাংবাদিক নিজাম উদ্দিন আহমেদ রায়ের প্রতিক্রিয়ায় বলেন, এত বছর পর যুদ্ধাপরাধীর বিচার চূড়ান্ত হচ্ছে এটাই বড় বিষয়।অচিরেই এই যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির রায় কার্যকরের প্রত্যাশা ব্যক্ত করে তিনি বলেন, এ রায়ে আমি খুশি।

রায় নিয়ে যে গুজব ছিল তা দূর হয়েছে এবং আইনের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরে এসেছে।বার্তা সংস্থা রয়টার্সের সাবেক চট্টগ্রাম প্রতিনিধি নিজাম উদ্দিনকে ১৯৭১ সালের ৫ জুলাই ধরে নিয়ে যান সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও তার অনুসারীরা। নগরীর গণি বেকারির মোড়ে সালাউদ্দিনের বাসভবন ‘গুডস হিল’ এ নির্যাতন কেন্দ্রে আটকে রেখে তাকে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়।

সেখানে নির্যাতনের শিকার সিঅ্যান্ডএফ ব্যবসায়ী ম. ছলিম উল্লাহ বলেন, একজন ঔদ্ধত্যকারীর সাজা চূড়ান্ত হল। চট্টগ্রাম কলঙ্কমুক্ত হয়েছে।আমি সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে না গেলেও এর প্রতি আমার সম্পূর্ণ সমর্থন ছিল। আমাদের পারিবারিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের দুইজন কর্মচারীকে খুঁজতে গেলে আমাকে সাকা চৌধুরীর অনুসারীরা ধরে গুডস হিলে নিয়ে উল্টো করে ঝুলিয়ে নির্যাতন করে।সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়া মুক্তিযোদ্ধা মাহবুবুল আলম বলেন, একাত্তরে সে (সাকা) আওয়ামী লীগ নেতাকে হত্যা করেছে, গণহত্যা চালিয়েছে।

তাকে মারার জন্য চট্টগ্রাম শহরে আমরা অপারেশন চালিয়েছিলাম।সেদিন সফল হইনি। কিন্তু আজ বিচারের রায়ে ভাল লাগছে। একটাই দাবি- ফাঁসি যেন দ্রুত কার্যকর করা হয়। সালাউদ্দিনের বিরুদ্ধে আরেক সাক্ষী গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা কাজী নুরুল আবছারও দ্রুত রায় কার্যকর দেখার প্রত্যাশা জানিয়েছেন।একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে চট্টগ্রামে হিন্দু ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের হত্যা, গণহত্যা এবং নির্যাতনের অভিযোগে ২০১৩ সালের ১ অক্টোবর বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসির আদেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল।পরে সালাউদ্দিন বিচারিক আদালতের ওই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করেন, যার আদেশ আসে বুধবার।