দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ২৯ জুলাই: যুদ্ধাপরাধ মামলায় সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর সর্বোচ্চ সাজার রায়ে তার পরিবার সন্তষ্ট নয় জানিয়ে আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছেন, পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি হাতে পেলে তারা অবশ্যই রিভিউ আবেদন করবেন। সাকা চৌধুরীর আপিল আবেদন খারিজ করে দিয়ে বুধবার প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে চার সদস্যের আপিল বেঞ্চ এ রায় দেন।
বেঞ্চের অন্য সদস্যরা হলেন- বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী।সালাউদ্দিন কাদের সাকা চৌধুরীর আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, রায়ের কপি পেয়ে রিভিউ আবেদন করবো। যেসব অভিযোগে তাকে সাজা দেওয়া হয়েছে, আমরা আশা করি রিভিউর মাধ্যমে ে গেুলো থেকে তিনি খালাস পাবেন।মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের সাকা চৌধুরীর ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল রেখেছেন সু্প্িরম কোর্টের আপিল বিভাগ।
রায় পরবর্তী এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, ট্রাইব্যুনালে তার বিরুদ্ধে ২৩টি অভিযোগ আনা হয়েছিল। এর মধ্যে ৯টি অভিযোগে সাজা হয়েছিল। কিন্তু আপিল বিভাগে এসে মাত্র একটি অভিযোগ থেকে তিনি খালাস পেয়েছেন।এদিকে, সাকা চৌধুরীর ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরী এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, তিনি একজন নির্দোষ মানুষ। আশা করি একদিন না একদিন প্রমাণ হবে তিনি নির্দোষ।
মানবতা বিরোধী মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছোট ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরী বলেন, ‘আমার বাবা নির্দোষ। একদিন এ সত্য প্রমাণিত হবে। মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়ে কাউকে ফাঁসি দেয়া যায় না।এটি অন্যায় । এরও একদিন বিচার হবে।আপিলের রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করা হবে বলে সাকার বড় ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরী জানিয়েছেন।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি খন্দকার মাহবুব রায়ের পর নিজের কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, যেহেতু আপিল বিভাগের রায়, আমরা অবশ্যই এ রায়ের অনুলিপি হাতে পেলে রিভিউ করব। আমরা আশা করব, রিভিউয়ে আমরা বহালকৃত সাজা থেকে মুক্তি পাব। তার পরিবার থেকে বলা হয়েছে, তারা এই রায়ে হতাশ হয়েছেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধের সময় চট্টগ্রামের রাউজানে কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের মালিক নূতন চন্দ্র সিংহকে হত্যা, সুলতানপুর ও ঊনসত্তরপাড়ায় হিন্দু বসতিতে গণহত্যা এবং হাটহাজারীর এক আওয়ামী লীগ নেতা ও তার ছেলেকে অপহরণ করে খুনের দায়ে সাকা চৌধুরীর সর্বোচ্চ সাজার রায় দিয়েছে আদালত।তার আইনজীবী বলেন, আপনারা জানেন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ১৯৭৯ সাল থেকে বারবার নিজের এলাকা থেকে নির্বাচিত হয়েছেন।যে এলাকায় বর্বরোচিত পাকিস্তানি হামলার সঙ্গে উনি ছিলেন বলে বলা হয়। যে ব্যক্তি তার এলাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে থেকে মানুষের সঙ্গে থেকে বর্বরোচিত আচরণ করতে পারে, মানুষ হত্যা করতে পারে, সেই ব্যক্তি ওই এলাকা থেকে বারবার জাতীয় সংসদে নির্বাচিত হয়েছেন।
খন্দকার মাহবুব বলেন, সালাউদ্দিনের পরিবার বলেছেন, প্রসিকিউশন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এই মামলা এনেছেন। সেইফ হোমে রেখে, মিথ্যা সাক্ষ্য তৈরি করে এই রায়। তারা এ ব্যাপারে যথাযথ আইনি পদক্ষেপ নেবেন। মুসলিম লীগ নেতা ফজলুল কাদের (ফকা) চৌধুরীর ছেলে সাকা চৌধুরী হলেন চতুর্থ ব্যক্তি, আপিল আদালতে যার সর্বোচ্চ সাজার রায় এল।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ সাকা চৌধুরীকে যে চার হত্যা-গণহত্যার দায়ে সর্বোচ্চ সাজা দিয়েছিলেন সেগুলোর সাজাই বহাল রেখেছেন সর্বোচ্চ আদালত। ফলে চূড়ান্ত রায়েও অধ্যক্ষ নূতন চন্দ্র সিংহকে হত্যা (৩ নম্বর অভিযোগ), রাউজানের সুলতানপুর গ্রামে তিনজনকে গণহত্যা (৫ নম্বর অভিযোগ), রাউজানের ঊনসত্তরপাড়ায় ৫০-৫৫ জনকে গণহত্যা (৬ নম্বর অভিযোগ) এবং চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মোজাফফর আহম্মদ ও তার ছেলে শেখ আলমগীরকে হত্যার(৮ নম্বর অভিযোগ) দায়ে ফাঁসির আদেশ হয়েছে তার।
অন্যদিকে ট্রাইব্যুনালে প্রমাণিত নয়টি অভিযোগের মধ্যে অন্য তিনটি অভিযোগের প্রত্যেকটিতে ২০ বছর এবং আরো দু’টি অভিযোগের প্রতিটিতে পাঁচ বছর করে কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছিল তাকে। সব মিলিয়ে মৃত্যুদণ্ডের পাশাপাশি মোট ৭০ বছরের কারাদণ্ড পান তিনি। এর মধ্যে শুধু রাউজানের সতীশ চন্দ্র পালিতকে হত্যার (৭ নম্বর অভিযোগ) দায় থেকে আপিল বিভাগের রায়ে খালাস পেয়েছেন তিনি, যে অভিযোগে তাকে ২০ বছরের কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। এর ফলে মৃত্যুদণ্ডের পাশাপাশি মোট ৫০ বছরের কারাদণ্ড বহাল থাকলো।
বহাল থাকা অন্য চার অভিযোগের দণ্ডাদেশের মধ্যে রাউজানের গহিরা গ্রামের হিন্দুপাড়ায় গণহত্যা(২ নম্বর অভিযোগ) ও জগৎমল্লপাড়ায় ৩২ জনকে গণহত্যার(৪ নম্বর অভিযোগ) দায়ে ২০ বছর করে ৪০ বছর এবং মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক নিজাম উদ্দিন আহম্মেদ, সিরাজ ও ওয়াহেদ ওরফে ঝুনু পাগলাকে অপহরণ করে নির্যাতন(১৭ নম্বর অভিযোগ) এবং চান্দগাঁওয়ের সালেহউদ্দিনকে অপহরণ করে সাকা চৌধুরীর পারিবারিক বাসভবন গুডসহিলে নিয়ে নির্যাতনের (১৮ নম্বর অভিযোগ) দায়ে ৫ বছর করে আরো ১০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে সাকাকে।ট্রাইব্যুনালে সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে আনা মানবতাবিরোধী অপরাধের মোট ২৩টি অভিযোগের মধ্যে ১৭টির পক্ষে সাক্ষী হাজির করেন রাষ্ট্রপক্ষ।
সেগুলোর মধ্যে দোষী সাব্যস্ত করা নয়টি বাদে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত না হওয়া বাকি আটটি অভিযোগ থেকে তাকে খালাস দেওয়া হয়। এছাড়া রাষ্ট্রপক্ষ যে ছয়টি অভিযোগের পক্ষে সাক্ষ্য-প্রমাণ হাজির করেননি সেগুলো থেকেও সাকা চৌধুরীকে খালাস দেওয়া হয়। এ ১৪টি অভিযোগের বিষয়েও ট্রাইব্যুনালের রায় বহাল রেখেছেন আপিল বিভাগ। এর আগে মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর চূড়ান্ত রায়েও মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন আপিল বিভাগ।
এর আগে গত ৭ জুলাই উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক (আর্গুমেন্ট) উপস্থাপন শেষে আজ বুধবার রায়ের দিন ধার্য করেন আপিল বিভাগ।গত ৫ থেকে ৭ জুলাই পর্যন্ত তিন কার্যদিবসে সাকা চৌধুরীর পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন তার আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন ও এসএম শাহজাহান। এর আগে প্রথমে আসামিপক্ষের শুনানিতে ১৬ থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত ট্রাইব্যুনালের রায়, সাক্ষীদের সাক্ষ্য- জেরা এবং রায় সংক্রান্ত নথিপত্র ( পেপারবুক) উপস্থাপন করেন এসএম শাহজাহান।অপরদিকে গত ৩০ জুন এবং ১ ও ৭ জুলাই তিন কার্যদিবসে রাষ্ট্রপক্ষে সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।