দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ২৮ জুলাই: কেবল সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে নয় দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে জনগণের জন্য কাজ করতে জেলা প্রশাসকদের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সব ভয়-ভীতি ও প্রলোভনের ঊর্ধ্বে থেকে আইনের আওতায় দায়িত্ব পালন করতে জেলা প্রশাসদের প্রতি আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী।মঙ্গলবার সকালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ৩ দিনের জেলা প্রশাসক সম্মেলনের উদ্বোধন শেষে তিনি এ কথা বলেন।দেশের সব জেলার প্রশাসকদের নিয়ে সরকারের নীতি নির্ধারকদের তিন দিনের এই সম্মেলনের উদ্বোধন হয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের শাপলা হলে।
জেলা প্রশাসকরা ছাড়াও মন্ত্রী পরিষদের সদস্য এবং প্রশাসনের ঊর্দ্ধতন কর্মকর্তারা এ অনুষ্ঠানে অংশ নেন।প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশকে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের সারিতে নিয়ে যেতে গ্রামীণ অর্থনীতি শক্তিশালী করাতে হবে। এর পাশাপাশি মাদকপাচার, নারী ও শিশুপাচার, বাল্যবিবাহ বন্ধসহ সামাজিক বেস্টনির আওতায় প্রকল্পের দ্রুত বাস্তবায়ন এবং কক্সবাজার সীমান্তে কঠোর নজরদারি বাড়াতে হবে।মাঠ পর্যায়ে সরকারের নীতি ও কর্মসূচি বাস্তবায়নে এবং জনগণ ও সরকারের মধ্যে সেতুবন্ধন হিসেবে জেলা প্রশাসকরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন— উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, শুধু দৈনন্দিন কাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে এর বাইরে সাধারণ মানুষের কল্যানে নতুন নতুন উপায় বের করতে হবে।ছিটমহলবাসীসহ সীমান্ত এলাকার জনগণ যেন সরকারের সব ধরনের সেবা পায় এবং তা পেতে কোনো মানুষ যেন হয়রানির শিকার না হয় সে বিষয়ে জেলা প্রশাসকদের সতর্ক করেন প্রধানমন্ত্রী।
এছাড়ও ৩ জেলা প্রশাসকদের সকল ভয়-ভীতি, প্রলোভনের উর্দ্ধে থেকে জনগণের জন্য কাজ করতে একুশ দফা নির্দেশনা দেন শেখ হাসিনা। এ সময় মাঠ পর্যায়ে কাজের অগ্রগতি, চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে শুরু হয়েছে ৩ দিনের জেলা প্রশাসক সম্মেলন। ভ্রাম্যমাণ আদালতের কর্মপরিধি বাড়ানোর পাশাপাশি আইনি সীমাবদ্ধতা দূর করা, দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নানা মামলা-হামলার ব্যয় সরকারিভাবে বহনসহ বেশ কিছু সুপারিশ তুলে ধরেন প্রশাসকরা। একুশটি বিষয়ে বিশেষ নজর রাখার তাগিদ দিয়ে ‘পুরনো ধ্যান-ধারণা বদলে’ জেলা প্রশাসকদের সামনের দিকে এগিয়ে যেতে নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।রুটিন কাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না।
প্রতিটি জেলায় কি ধরনের নতুন কাজ হাতে নেওয়া যায়, যা ওই জেলার উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে, সেই ধরনের নতুন নতুন পন্থা আবিষ্কার করা, কৌশল নির্ধারণ করা এবং বাস্তবায়ন করার দিকেও দৃষ্টি দিতে হবে।সরকারের নীতি ও কর্মসূচি বাস্তবায়নে জেলা প্রশাসকরা যে জনগণ ও সরকারের মধ্যে সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করছে, সে কথাও তাদের মনে করিয়ে দেন শেখ হাসিনা।প্রধানমন্ত্রী বলেন, ঔপনিবেশিক আমলে জেলা প্রশাসনের জন্ম হলেও বর্তমানে কালের বিবর্তনে আজ সবকিছুরই পরিবর্তন ঘটেছে। আমরা স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে কীভাবে এই দেশ পরিচালনা করব, উন্নত করব এবং এগিয়ে নিয়ে যাবো সেটাই হচ্ছে বিবেচ্য বিষয়।কাজেই পুরনো ধ্যান-ধারণা পরিবর্তন করে আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।
শেখ হাসিনা বলেন, একটি জেলার সার্বিক উন্নয়ন নির্ভর করে জেলা প্রশাসনের কর্মীদের ওপর। ভূমি ব্যবস্থাপনা, নির্বাচন পরিচালনা, ভেজালবিরোধী অভিযান, পরিবেশের সুরক্ষা, বৃক্ষ নিধন ও পাহাড় কর্তন রোধ, পাবলিক পরীক্ষা পরিচালনা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনি কর্মসূচির বাস্তবায়নের মত কাজগুলো তাদের মাধ্যমেই বাস্তবায়িত হয়।তবে এসব রুটিন কাজের পাশাপাশি জেলা প্রশাসকদের সৃজনশীল হওয়ার তাগিদ দিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, একেক অঞ্চলের একেকরকম বিশেষত্ব রয়েছে।
যেমন একেক জেলায় একেক জিনিস উৎপাদন, মানুষের ও জীবনযাত্রার মধ্যে ভিন্নতা দেখা যায়। এক্ষেত্রে কোন এলাকার মানুষের কী ধরনের সমস্যা রয়েছে, বা কোন এলাকায় কোন ধরনের পণ্য উৎপাদন হতে পারে, কোন এলাকার জন্য কী পদক্ষেপ নিলে সে এলাকার মানুষের জীবনমান উন্নত হতে পারে সে ধরনের বিশেষ দিকগুলো একটু খুঁজে বের করা।তিনি বলেন, রাষ্ট্র তথা জনগণের স্বার্থ সংরক্ষণই হবে আপনাদের মূল লক্ষ্য। সেবার মনোভাব নিয়ে সত্য ও ন্যায়ের পথে অবিচল থাকলে আপনাদের পক্ষে যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন সম্ভব হবে।ডিসিদের মানুষের প্রতি দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, এদেশের খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষ; তাদের অর্জিত অর্থই কিন্তু আপনাদের বেতন-ভাতা, বা আমরা যে যা কিছু ভোগ করি.. এটা কিন্তু তাদেরই অবদান। তাই তাদের ভাগ্য পরিবর্তন করা এবং উন্নত জীবন দেওয়া, এটা কিন্তু সকলের কর্তব্য।
চলতি বছরের শুরুতে রাজনৈতিক কর্মসূচির মধ্যে নাশকতা দমনে জেলা প্রশাসকদের ভূমিকার প্রশংসা করে তিনি বলেন, প্রাকৃতিক সমস্যা থেকে মনুষ্যসৃষ্ট সমস্যা আরও কঠিন ছিল। সেগুলো আপনারা যথাযথ পদক্ষেপ নিয়েছেন। আপনারা সক্রিয় ছিলেন বলেই এ ধরনের অবস্থা থেকে আমরা উত্তরণ ঘটাতে পেরেছি।ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের কাজ কেউ করতে না পারে সে বিষয়েও সজাগ থাকার নির্দেশ দেন তিনি।
শেখ হাসিনা দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি, দারিদ্র্য বিমোচন এবং শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ, যোগাযোগ অবকাঠামো, তথ্য-প্রযুক্তিসহ বিভিন্ন খাতের উন্নয়নের তথ্য-উপাত্ত ডিসিদের সামনে তুলে ধরেন।সাক্ষরতার হার বাড়ানো, স্কুলে ঝড়ে পড়া রোধ করা এবং দুস্থদের আবাসনের ব্যবস্থা করতেও ডিসিদের নির্দেশ দেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা চাই দেশে একটা মানুষও নিরক্ষর থাকবে না। কোনও জেলায় একটা মানুষও যেন গৃহহীন না থাকে সে ব্যবস্থা নিতে হবে।লক্ষ্যমাত্রার আগেই বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার প্রত্যয় জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০২১ সালের আগে যেন মধ্যম আয়ের দেশ গড়তে পারি সে লক্ষ্য নিয়েই সকলকে আরও দ্রুত কাজ করতে হবে।
মাদকের বিরুদ্ধে আরও কঠোর ব্যবস্থা নিতে এবং সৌর বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়াতেও ডিসিদের নির্দেশ দেন তিনি।উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী ডিসিদের ২১টি বিষয়ে বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখার নির্দেশ দেন। সরকারি সেবা গ্রহণে সাধারণ মানুষের হয়রানি বন্ধ করা; নারী ও শিশু নির্যাতন এবং পাচার; মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার; যৌতুক, ইভটিজিং এবং বাল্যবিবাহ রোধ করা; প্রতিবন্ধী, অটিস্টিক ও পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর কল্যাণে বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ; গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন; সম্ভাবনাময় স্থানীয় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশের মতো বিষয় এতে রয়েছে।জনগণের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছানোর লক্ষ্যে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির উন্নয়ন ও বিকাশে সহায়তা করা; তৃণমূল পর্যায়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে কাজ করা; নারীশিক্ষার হার বৃদ্ধি; ছাত্র-ছাত্রীদের ঝরে পড়ার হার কমানো এবং ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের মূলধারায় ফিরিয়ে আনার পদক্ষেপ নেওয়ার কথাও প্রধানমন্ত্রী বলেন।তিনি বলেন, ভূমি প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা ও স্বচ্ছতা বৃদ্ধি এবং সরকারি ভূমি রক্ষায় সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। কৃষি-উৎপাদন বৃদ্ধিতে সার, বীজ, বিদ্যুৎ, জ্বালানির সরবরাহ নির্বিঘ্ন করতে প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নিতে হবে।
ভেজাল খাদ্য বাজারজাতকরণ প্রতিরোধে গণসচেতনতা সৃষ্টি; পরিবেশ রক্ষার জন্য জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং এ সংক্রান্ত আইন ও বিধি বিধানের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা; প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বিপর্যয় প্রশমনে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন এবং এ সংক্রান্ত স্থায়ী নির্দেশনা অনুসারে সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নিতে বলেন সরকারপ্রধান।সাধারণ মানুষ যাতে সহজে সুবিচার পায় এবং আদালতে মামলা জট কমে, সেজন্য গ্রাম আদালতগুলোকে কার্যকর করা; জেলা পর্যায়ে বিভিন্ন কমিটির প্রধান হিসেবে জেলা প্রশাসকদের দায়িত্ব পালন; এসব কমিটিকে সক্রিয়, গতিশীল ও ফলপ্রসূ করা এবং জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস ও সাম্প্রদায়িকতা দূর করতে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে বলেন প্রধানমন্ত্রী।
শিল্পাঞ্চলে শান্তি রক্ষা; পণ্য পরিবহন ও আমদানি-রপ্তানি নির্বিঘœ করার ব্যবস্থা গ্রহণ; ভোক্তা অধিকারকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া এবং বাজারে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টির যে কোনো অপচেষ্টা’ কঠোর হাতে দমন; নারী উন্নয়ন নীতি দৃঢ়ভাবে অনুসরণ ও বাস্তবায়নেরও নির্দেশনা দেন তিনি।শিশু-কিশোরদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের লক্ষ্যে শিক্ষা, ক্রীড়া, বিনোদন ও সৃজনশীল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সুযোগ নিশ্চিত করা; মাদক চোরাচালান ও এর অপব্যবহার বন্ধ করা এবং পার্বত্য জেলাগুলোর ভূ-প্রকৃতিক বৈশিষ্ট্য, বনাঞ্চল, নদী-জলাশয়, প্রাণিসম্পদ এবং গিরিশৃঙ্গগুলোর সৌন্দর্য সংরক্ষণ করারও নির্দেশনা দেওয়া হয় জেলা প্রশাসকদের।অনুষ্ঠানে রংপুর বিভাগ এবং কুষ্টিয়া, পঞ্চগড় ও নারায়ণগঞ্জ জেলাকে ‘ডিজিটাল সেবা পুরস্কার দেওয়া হয়। রংপুরের বিভাগীয় কমিশনার ও তিন জেলার ডিসি প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পুরস্কার নেন।