image_133374_0

দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ২৫ জুলাই ২০১৫: ভোটার তালিকা-সংক্রান্ত সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে বর্তমান নির্বাচন কমিশন (ইসি) ব্যর্থ বলে মন্তব্য করেছে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন। সংস্থাটির নেতারা বলেছেন, এ জন্য ভোটার তালিকায় জেন্ডার গ্যাপের মতো একটি গুরুতর সমস্যা দেখা দিয়েছে। ফলে অনেক নারী ভবিষ্যতে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হতে পারেন। ভোটার তালিকায় নারী ভোটারের সংখ্যা ধারাবাহিকভাবে কমে যাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)। এভাবে নারী ভোটার কমার কারণ তদন্ত করে বের করার দাবি জানিয়েছে তারা।শনিবার সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সুজন তাদের উদ্বেগের কথা জানায়। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন সুজনের সভাপতি এম হাফিজউদ্দিন খান, সাবেক নির্বাচন কমিশনার বিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন, সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার, সুজন নির্বাহী সদস্য আলী ইমাম মজুমদার,সৈয়দ আবুল মকসুদ,ড. তোফায়েল আহমেদ, সাবেক রাষ্ট্রদূত নাসিম ফেরদৌস এবং নারীনেত্রী ও অর্থনীতিবিদ সালমা খান।

সুজনের পক্ষে লিখিত বক্তব্য তুলে ধরেন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, ২০০৮ সালে দেশের ভোটার সংখ্যা ছিল ৮ কোটি ১০ লাখ ৫৮ হাজার ৬৯৮ জন। পুরুষের চেয়ে নারী ভোটার বেশি ছিল ১৪ লাখ ১৩ হাজার। এর পর থেকে প্রতি বছরের হালনাগাদে নারী ভোটারের সংখ্যা ক্রমশ কমেছে। ২০১৩ সালে হালনাগাদ শেষে দেখা যায়, নারী ভোটারের চেয়ে পুরুষ ভোটার ২ লাখ ৯১ হাজার বেশি। ২০১৫ সালে দেখা যায়, পুরুষের তুলনায় নারী ভোটার ৭ লাখ ৪ হাজার জন কম।৬৪টি জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবধান দেখা যায় ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, কুমিল্লা, কক্সবাজার ও ভোলায়। আদমশুমারি অনুযায়ী, নারী ও পুরুষের সংখ্যা কাছাকাছি। যে কারণে ভোটার তালিকার এই ব্যবধান প্রশ্নবিদ্ধ। অভিযোগ উঠেছে, তথ্যসংগ্রহকারীরা বাড়ি বাড়ি যাননি বলেই নারী ভোটার কমে গেছে।লিখিত বক্তব্যে আরও বলা হয়, সংবিধানে ১৮ বছর বয়স হলে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলা আছে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন ১৫ বয়সীদেরও নিবন্ধন আওতায় নিয়ে এসেছে। তাদের এই সিদ্ধান্ত বোধগম্য নয়।

অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ভোটার তালিকায় নারী-পুরুষের ব্যবধান উদ্বেগজনক নয়। তবে কেন কমছে, সেটা খতিয়ে দেখা যেতে পারে। কমিশন ইচ্ছাকৃতভাবে নারীদের বাদ দিয়েছে বলে মনে হয় না। অভিজ্ঞতা বলে, পাড়াগাঁওয়ে পুরুষশাসিত সমাজে নারীরা ভোটার হতে চান না। তিনি আরও বলেন, ১৫ বছর বয়সীদের ভোটার করার আইনি ভিত্তি কী, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। কারণ, এদের ভোটার করতে হলে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। তবে ভোটার তথ্য ফরম ছাড়া অন্য কোনো ফরমে নিবন্ধন করা হলে সমস্যা নেই।গবেষক ও কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, এই নির্বাচন কমিশনের পক্ষে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনও সুষ্ঠুভাবে করা সম্ভব নয়। তার চেয়ে ছাত্রলীগ-যুবলীগকে দায়িত্ব দিলে তারা অনেক ভালো নির্বাচন করতে পারবে।স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ বলেন, যে জেলায় নারী ভোটার কমেছে, সেখানে তদন্ত করে ব্যবস্থা নিলে সমস্যার সমাধান হতে পারে।নারী নেত্রী সালমা খান বলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় নারীদের গড় আয়ু বেশি। দুর্ঘটনায় নারী মারা যাচ্ছে, সেই রকম কোনো সংবাদও দেখি না। তাহলে নারী ভোটার কেন কমছে?

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, শনিবার শুরু হওয়া ভোটার তালিকা হালনাগাদ করার কার্যক্রমটি অব্যাহত থাকা আবশ্যক। সততা, আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজটি সম্পন্ন করার জন্য কমিশনের প্রতি আহ্বান জানায় সুজন। একই সঙ্গে তারা ভোটার তালিকা হালনাগাদ সম্পন্ন হওয়ার পর তৃতীয় পক্ষ দিয়ে তা অডিটের ব্যবস্থা নিতেও আহ্বান জানিয়েছেন।শনিবার ইসির ভোটার তালিকা হালনাগাদ কাজ শুরু হওয়ার কথা উল্লেখ করে বদিউল আলম বলেন, ভোটার তালিকা প্রণয়ন ও হালনাগাদ কার্যক্রম নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক দায়িত্ব। কিন্তু অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে ভোটার তালিকা হালনাগাদের উদ্যোগ নিয়ে আমাদের কিছু উদ্বেগ রয়েছে। তিনি বলেন, ২০০৮ সালে প্রণীত ভোটার তালিকাটি ছিল আমাদের জন্য এক বড় গর্ব এবং পৃথিবীর অনেক দেশের জন্য ঈর্ষণীয়। কিন্তু বিগত কয়েক বছরে হালনাগাদকৃত ভোটার তালিকায় দেখা দেয় নানা অসংগতি। ওঠে বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ। বিশেষ করে জানুয়ারি ২০১৫-এ প্রকাশিত ভোটার তালিকায় জেন্ডার গ্যাপ একটি বড় অসংগতি হিসেবে দেখা দেয়।

সুজন সম্পাদক বলেন,২০০৮-এর তালিকা অনুযায়ী আমাদের ভোটার সংখ্যা ছিলো মোট আট কোটি ১০ লাখ ৫৮ হাজার ৬৯৮। ওই তালিকা অনুযায়ী নারী ভোটার ছিলো পুরুষ ভোটার থেকে ১৪ লাখ ১৩ হাজার ৬০০ বেশি এবং ভোটার তালিকায় নারী-পুরুষের বিভাজন বা ‘জেন্ডার-গ্যাপ’ ছিল +১.৭৪%। ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে হালনাগাদ করার পর ভোটারের সংখ্যা দাঁড়ায় নয় কোটি ১৯ লাখ ৮০ হাজার ৫৩১। নারী ভোটার ছিল পুরুষ ভোটার থেকে দুই লাখ ৯১ হাজার ৩৯৯ কম এবং জেন্ডার-গ্যাপ -০.৩২%। কমিশন ২০১৪ সালের মে থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ভোটার তালিকা হালনাগাদ করার পরবর্তী উদ্যোগ নেয় এবং ২ জানুয়ারি ২০১৫ তারিখে একটি খসড়া সাপ্লিমেন্টারি তালিকা প্রকাশ করে। এ তালিকা অনুযায়ী, নতুন ভোটারের সংখ্যা দাঁড়ায় ৫০ লাখের কিছু বেশি এবং নতুন ভোটারদের মধ্যে জেন্ডার গ্যাপ -১১.৬৭%। তবে চূড়ান্ত তালিকায় জেন্ডার গ্যাপ-১২%। কী কারণে এ জেন্ডার গ্যাপ হলো, যার ফলে নারীরা ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন, সেই ব্যাখ্যা দাবি করার অধিকার জনগণের রয়েছে এবং কমিশন তা প্রদান করবে বলে আমরা আশা করি।

২০১১ সালের আদমশুমারির কথা উল্লেখ করে বদিউল আলম জুমদার বলেন, বাংলাদেশে পুরুষ-নারীর অনুপাত ১০০.৩। এ হিসাব অনুযায়ী, নারীর সংখ্যা পুরুষের প্রায় কাছাকাছি। তাই ভোটার তালিকায় নতুন ভোটারদের মধ্যে নারী-পুরুষের মধ্যে যে -১২% জেন্ডার গ্যাপ দেখা যায়, তার যৌক্তিকতা প্রশ্নবিদ্ধ।এ ছাড়া কিছু আইনগত বিষয় যেমন, সর্বশেষ হালনাগাদ কার্যক্রমে বাড়ি বাড়ি না গিয়ে ভোটার তালিকা প্রণয়ন করার অভিযোগ,ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রমে ১৫-১৭ বছর বয়স্কদেরও নিবন্ধনের আওতায় আনার সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা, জানুয়ারির পরিবর্তে জুলাই মাসে ভোটার তালিকা হালনাগাদের ফলে আইনের লঙ্ঘন এবং হালনাগাদ কার্যক্রমের পর্যাপ্ত প্রচার-প্রচারণা না চালানোর অভিযোগ আনা হয় মূল প্রবন্ধে।সুজন সম্পাদক বলেন, সংবিধানের ১১৯ অনুচ্ছেদে অর্পিত ভোটার-তালিকা প্রস্তুতকরণের তত্ত্বাবধান, নির্দেশ ও নিয়ন্ত্রণ’ করার দায়িত্ব পালনে বর্তমান কমিশন ব্যর্থ হয়েছে। ফলে ভোটার তালিকায় জেন্ডার গ্যাপের মতো একটি গুরুতর, কিন্তু অনাবশ্যক, সমস্যা দেখা দিয়েছে।

আজ শুরু হওয়া ভোটার তালিকা হালনাগাদ করার কার্যক্রমটি অব্যাহত থাকা আবশ্যক। এ ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ সততা, আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজটি সম্পন্ন করার জন্য আমরা কমিশনের প্রতি আহ্বান জানাই। একইসঙ্গে আমরা হালনাগাদ সম্পন্ন হবার পর তৃতীয় পক্ষ দ্বারা পুরো তালিকাটি অডিটের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আমরা কমিশনের প্রতি আহ্বান জানাই।সভাপতির বক্তব্যে এম হাফিজউদ্দিন খান বলেন, আমরা নাগরিকরা একটি সঠিক ভোটার তালিকা চাই, যেখানে জেন্ডার গ্যাপের মতো সমস্যা থাকবে না। যথাযথ দায়িত্ব নিয়ে সুষ্ঠুভাবে হালনাগাদ কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন বিদ্যমান সমস্যাগুলো কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবে বলে আমরা আশা করি।সংবিধানের ১১৯ নং অনুচ্ছেদের উল্লেখ করে ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, নির্ভুল ভোটার তালিকা প্রণয়ন করা নির্বাচন কমিশনের অন্যতম একটি কাজ। হালনাগাদ কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার মাধ্যমে কমিশন অতীতের বিভিন্ন অভিযোগ কাটিয়ে উঠবে বলে আমরা আশা করি।দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে যেখানে নারীদের আয়ুস্কাল পুরুষের তুলনায় বেশি, সেখানে ভোটার তালিকায় নারীর সংখ্যা কমে হবে কেন, এমন প্রশ্ন উত্থাপন করে সালমা খান বলেন, ভোটার তালিকায় এ জেন্ডার গ্যাপ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এর প্রভাব ভবিষ্যতে রাজনীতি ও অর্থনীতিতে পড়বে বলে মন্তব্য করেন তিনি।নাসিম ফেরদৌস বলেন, বর্তমান সরকার যেখানে নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলছে, সেখানে ভোটার তালিকায় জেন্ডার গ্যাপ কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না। ভবিষ্যতে নারীদের ভোটার করার ক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার করা যেতে পারে বলে অভিমত দেন তিনি।