দৈনিকবার্তা-সাতক্ষীরা, ২৪ জুলাই: সাতক্ষীরার শ্যামনগরের জয়নগর গ্রামে দুটি শিশুকে রশি ও শিকল দিয়ে গাছের সাথে বেধে নির্যাতনের ঘটনায় প্রধান আসামি গোলাম মোস্তফাকে জেল হাজতে পাঠিয়েছে পুলিশ । বুধবার রাতে এ ব্যাপারে নারী ও শিশু নির্যাতনের ৮ ধারায় শ্যামনগর থানায় মামলা( নম্বর ৩৪ তারিখ ২২.০৭.১৫ ) করেছেন নির্যাতিত শিশু আবু নাসিমের বাবা হামিদ তরফদার।
মামলার অপর আসামি গোলাম মোস্তফার ছেলে গোলাম হোসেনকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে ।এদিকে সিলেটে শিশু রাজনকে নির্যাতনের মাধমে নৃশংসভাবে হত্যার ঘটনা নিয়ে দেশ যখন তোলপাড় তখন এমন একটি স্পর্শ কাতর ঘটনায় সাতক্ষীরায়ও শুরু হয়েছে ব্যাপক তোলপাড়। এই নির্যাতনের ঘটনা গত ২৮ রমজান ১৬ জুলাই ঘটলেও তা জানাজানি হয় ২২ জুলাই বুধবার। এরপরই গ্রেফতার করা হয় মোস্তফাকে। পুলিশ এ ঘটনা নিয়ে অধিকতর তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানান শ্যামনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ( ওসি ) ইমদাদুল হক । তিনি জানান এর সাথে জড়িত অন্যদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে ।
শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী অফিসার আবু সাইয়েদ মঞ্জুর আলম বৃহস্পতিবার বিকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গেছেন বলে জানিয়েছেন ।উল্লেখ্য যে শ্যামনগরের কাশিমারি ইউনিয়নের জয়নগর গ্রামের তিন সহোদর গোলাম মোস্তফা , আবদুল কুদ্দুস ও আবু মুসার মধ্যে পারিবারিক জমি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলে আসছে । সম্প্রতি তার বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে লোক চলাচল বন্ধের লক্ষ্যে গোলাম মোস্তফা খেজুর কাঁটার একটি বেড়া দেন। এই বেড়া সরিয়ে সেখানে খেলতে আসে পাড়ার দুটি শিশু মো.ইয়াসিন ( ৮) ও মো. নাসিম (৯) । মোস্তফা পুলিশকে জানিয়েছেন ‘ এই বেড়া ডিঙ্গিয়ে কেউ তার জমিতে এলে তাকে বেধে রাখার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন তার প্রতিপক্ষের লোকজন ’। এদিকে প্রতিপক্ষের এই চ্যালেঞ্জের জবাবে ক্ষিপ্ত হয়ে গোলাম মোস্তফা ও তার ছেলে শিশু দুটিকে ধরে বেধে রাখেন ।
কয়েক মিনিট পর পাড়ার মহিলারা তা খুলে দেন ।তবে শিশু নাসিমের বাবা মামলার বাদি ভ্যানচালক হামিদ তরফদার জানান তাদেরকে সকাল সাড়ে ৭টা থেকে ৩/৪ ঘন্টা যাবত বেধে রেখে নির্যাতন চালানো হয় । তিনি আরও জানান তাদের শিশু দুটি সকাল থেকেই ছিল অভুক্ত। এ অবস্থায় তাদের ওপর নির্যাতন করা হয়। প্রতিবেশি এক বৃদ্ধা বাধা অবস্থায় শিশু দুটিকে পানি খেতে দেন’ বলেও জানান তিনি । স্থানীয় সূত্র থেকে জানা গেছে বেড়া নষ্ট করে খেলা করার অভিযোগে শিশু দুটিকে ধরে গোলাম মোস্তফার কাছে নিয়ে যান প্রতিবেশি ইট ভাটার শ্রমিক সরদার আবদুস সাত্তার মোড়ল । এরপরই তাদের ওপর নির্যাতন নেমে আসে ।এদিকে, সাতক্ষীরার শ্যামনগরে দুই শিশু নির্যাতনের যে ছবি সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়েছে তার রহস্য উদঘাটনে পুলিশ আরও এক ধাপ এগিয়েছে ।
ঘটনাস্থল কাশিমারি ইউনিয়নের জয়নগর গ্রাম ঘুরে এসে শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী অফিসার আবু সাইয়েদ মঞ্জুর আলম রাতে জানান ‘ নির্যাতনকারী গোলাম মোস্তফার বাড়ি থেকে ছবি নেওয়া হলে তার সাথে বাড়িঘরের ছবি আসবেই’ । তিনি আরও বলেন যে ছবিতে শিশু দুটিকে বেধে রাখা দেখানো হয়েছে সেই গাছটি নির্যাতিত শিশু ইয়াসিনের বাড়ির একটি গাছের । এসব কথা জানিয়ে তিনি বলেন ছবিটি সাজানো । এর সাথে শিশু নির্যাতনের বাস্তবতার কোনো মিল নেই ।
সাতক্ষীরার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মীর মোদাচ্ছের হোসেন জানান ছবিটি সাজানো এবং তা ঘটনার কয়েকদিন পর ভিন্ন স্থান থেকে তোলা হয়েছে । ছবির এই গাছটি মোস্তফার বাড়ির নয় বলে জানান তিনি । এদিকে কালিগঞ্জ সার্কেলের সহকারি পুলিশ সুপার মীর মনিরুজ্জামান জানান তিনিও ঘটনাস্থলে যেয়ে ছবির গাছটি চিিহ্ণত করে নিশ্চিত হয়েছেন ওই গাছের সাথে শিশু নির্যাতনের কোনা সম্পর্ক নেই ।
এদিকে শিশু দুটিকে আটকে রেখে নির্যাতনের ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে সেদিন সন্ধ্যায় শিশু দুটির বাবা প্রতিবেশি আবদুল হামিদ ও ইসমাইল হোসেন গোলাম মোস্তফার বাড়িতে এসে হামলা করেন । এতে মোস্তফা ও তার অন্তঃস্বত্তা স্ত্রী মাসুদা খাতুন আহত হন । মোস্তফা এ নিয়ে মামলার উদ্যোগ নিলে স্থানীয়রা তাকে বিষয়টি নিজেদের মধ্যকার বলে মিটিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দেন ।মোস্তফার ঘনিষ্টজনরা বলেন এই সুযোগে মোস্তফাকে শিশু নির্যাতনের মতো অতি স্পর্শকাতর ঘটনার মতো অপরাধে অপরাধী বানানোর লক্ষ্যে কোনো তৃতীয় পক্ষ একটি সাজানো ছবি তৈরি করে তা সংবাদ মাধ্যমে প্রচারের উদ্যোগ নেয়।
তারা বলেন কোনো পক্ষ এ ব্যাপারে মামলায় আগ্রহী না হলেও পুলিশ শিশু দুটির বাবাকে বাড়ি থেকে ডেকে এনে বুধবার রাতে মামলা করিয়েছে। এদিকে মামলার তদন্তকারী অফিসার শ্যামনগর থানার উপপরিদর্শক ( এসআই) আবদুস সাত্তার জানান ‘ প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গোলাম মোস্তফা শিশু দুটিকে চড় থাপ্পর দিয়ে বেধে রাখার কথা স্বীকার করেছেন । তবে পায়ে শিকল দেওয়া এবং পুরো দেহ রশি দিয়ে পেচিয়ে নির্যাতন সম্পর্কে তার কিছইু জানা নেই বলে জানিয়েছেন’।
এদিকে শিশু দুটিকে রশি দিয়ে হাত বেধে ও শক্ত করে পেচিয়ে পায়ে শিকল দিয়ে গাছের সাথে সটান বেধে রাখার কোনো প্রত্যক্ষদর্শীর সন্ধান এলাকায় মেলেনি ।এ প্রসঙ্গে একই পাড়ার বাসিন্দা প্রতাপনগর মাদ্রাসার শিক্ষক নাজমুস সাদাত বেলাল জানান ঘটনার দিন তার সাথে নির্যাতিত শিশু নাসিমের বাবা হামিদ সরদারের সাথে দেখা হলে তার কাছে শিকল কেনো জানতে চাইলে তিনি বলেন –নতুন ভ্যান কিনেছি তাতে লাগানোর জন্য নিয়ে যাচ্ছি’ ।
তিনি ও তার স্ত্রী নিলুফার ইয়াসমিন বলেন তারা নিকট প্রতিবেশি হয়েও তাদের নজরে শিশু দুটিকে এমনভাবে বেধে নির্যাতনের দৃশ্য তারা দেখেন নি । তবে শিশু নাসিমের বাবা আবদুল হামিদ দাবি করেছেন তিনি নিজে না দেখলেও তার স্ত্রী আয়েশা খাতুন তা দেখেছেন । বেলাল আরও জানান ‘যে গাছে শিশু দুটিকে বেধে রাখার ঘটনা ঘটে তার সাথে ছবিতে থাকা গাছের কোনো মিল নেই’ । তবে এই ছবির নেপথ্যে কোনো রহস্য আছে কিনা তা তিনি বলতে পারেন নি ।
এদিকে শিশু দুটিকে গাছে বেধে নির্যাতনের ছবির উৎস কি তা নিয়ে পুলিশ তদন্তে নেমেছে। কে এই ছবি তুলেছেন এবং কখন কবে কোথা থেকে এই ছবি তুলেছেন সে বিষয়টিও খতিয়ে দেখছে পুলিশ । উল্লেখ্য ছবিটি সাতক্ষীরার স্থানীয় একটি দৈনিকে বুধবার প্রকাশিত হয়।পরে সেই সূত্র ধরে সংবাদকর্মীরাও ছবিটি হাতে পান ।এদিকে ছবিটি সাজানো কিংবা তা পরিকল্পিতভাবে তৈরি করা হয়েছে কিনা এমন প্রশ্নের কোনো জবাব দিতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন কালিগঞ্জ সার্কেলের সহকারি পুলিশ সুপার মীর মনিরুজ্জামান । তিনি বলেন শিশু দুটিকে নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে । এই নির্যাতনের মাত্রা কতটুকু তা পুলিশ খতিয়ে দেখছে ।এছাড়া আসামি গ্রেফতার হয়েছে । তিনি স্বীকারও করেছেন নির্যাতনের কথা ।
কাশিমারি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান গাজিী আনিছুর রহমান জানান ‘ আমি জয়নগরের ওই বাড়ি ও প্রতিবেশি অনেকের সাথে কথা বলে নিশ্চিত হয়েছি যে মোস্তফা শিশু দুটিকে চড় থাপ্পর মেরে তাচ্ছিল্যকর ভাবে বেধে রাখেন । কিছুক্ষন পর তা খুলেও দেওয়া হয় । তিনি জানান আলোচিত ছবি যা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়েছে এমন কোনো দৃশ্য তারা কেউ দেখেননি বলে তাকে তারা জানিয়েছেন। এর কোনো প্রত্যক্ষদর্শীও মেলেনি’ । চেয়ারম্যান আরও জানান মোস্তফার বাড়িতে যে গাছের সাথে তাদের বাধা হয়েছিল ছবিতে সে গাছটি দেখানো হয়নি ।
ছবির গাছটি মোস্তফার বাড়িতে নেই বলেী নিশ্চিত করেন তিনি । শ্যামনগরের একজন প্রবীন সংবাদকর্মী ঘটনাস্থল ঘুরে বিভিন্ন মহলে কথা বলে জানান গোলাম মোস্তফা শিশু দুটিকে ৭/৮ মিনিট বেধে রাখেন । এ খবর পেয়ে তাদের মা শিশু দুটিকে রশি খুলে নিয়ে যান। সেদিনের ঘটনায় মারামারিতে হাসপাতালে ভর্তি থাকা মোস্তফা ফিরে এসে মামলা করবেন এমন হুমকি দেওয়ায় প্রতিপক্ষ নিজেদের রক্ষা করতে ও তার ওপর শিশু নির্যাতন অপরাধ চাপিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে নির্যাতনের ঘটনাকে পুঁজি করে তিনদিন পর শিশু দুটিকে ভিন্ন এক স্থানে নিয়ে পরিকল্পিতভাবে বেধে ছবি তৈরি করে সংবাদকর্মীদের কাছে পাঠিয়েছেন’ ।