দৈনিকবার্তা-চট্টগ্রাম, ১৯জুলাই ২০১৫ : চট্টগ্রাম নগরীতে দেয়াল ও পাহাড় ধসে পৃথক ঘটনায় মা- মেয়ে ও তিন ভাইবোনসহ ৬ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। শনিবার দিনগত রাত ১টার দিকে এ দুর্ঘটনা দু’টি ঘটে। জেলা প্রশাসনের সহকারি কমিশনার ও নির্বাহি ম্যাজিস্ট্রেট তাহমিলুর রহমান বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, শনিবার দিনগত রাতে খুলশী থানার বাঘঘোনায় দেয়াল ধসে এক নারী ও দুই শিশুর মৃত্যু হয়েছে। একই সময়ে বায়োজিদ থানার আমিন কলোনি এলাকায় পাহাড় ধসে তিন শিশুর মৃত্যু হয়েছে। সকাল ৯টার দিকে জেলা প্রশাসক স্যার আমিন কলোনি পরিদর্শন করেন।তাহমিলুর রহমান আরো বলেন, লালখান বাজারে দেয়াল ধসের ঘটনায় মরিয়ম বেগম ও সুরাইয়া আক্তারের পরিবারকে ১০ হাজার টাকা ও আঁখি আক্তারের পরিবারকে ১০ হাজার করে টাকা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অনুদান দেয়া হয়েছে। এছাড়া আমিন কলোনির শাহজাহান মিস্ত্রির পরিবারকে ২০ হাজার টাকা অনুদান দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি চট্টগ্রামে পাহাড় ধস ঠেকাতে কার্যক্রম জোরদার করতে নির্দেশ দিয়েছেন জেলা প্রশাসক।এদিকে খুলশী থানার ওসি নিজাম উদ্দিন বলেন, ‘খুলশী থানার বাঘঘোনা পুড়া কলোনি এলাকার খোকনের বাড়ির দেয়াল ধসে পাশের একটি কাঁচা বসত ঘরে পড়লে এতে ঘটনাস্থলেই মা- মেয়েসহ তিনজন নিহত হয়। এরা হলেন- মা মরিয়ম বেগম (৩০), তার মেয়ে সুরাইয়া আক্তার (২) ও আঁখি আক্তার (৫)। অতি বর্ষণের ফলে এই ধসের ঘটনা ঘটেছে।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় ফায়ার সার্ভিসের সহকারি উপ-পরিচালক জসিম উদ্দিন বলেন, নগরীর বায়োজিদ থানার আমিন জুল মিলের আমিন কলোনির ৫ নম্বর কোয়ার্টারের শাহজাহান মিস্ত্রির ঘরে পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ঘরের ভেতর মাটি চাপা পড়ে শিশুসহ সাতজন আহত হলে তাদেরকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। এসময় কর্তব্যরত চিকিৎসক উম্মে সালমা (৮), আরাফাত হোসেন শুভ (১২) ও বিবি মরিয়ম (৪) নামের তিন শিশুকে মৃত ঘোষণা করেন। তারা প্রত্যেকে একে অপরের ভাই- বোন ও শাহজাহান মিস্ত্রির সন্তান। অন্য চারজন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। অতিরিক্ত বর্ষণের ফলে এই পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটেছে।চট্টগ্রামের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন ।এদিকে গত শুক্রবার থেকে টানা বৃষ্টিতে চট্টগ্রামের নিঁচু এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। নগরীর মুরাদপুর, ২নং গেট, বহদ্দারহাটসহ বিভিন্ন এলাকায় সড়ক ও বাসাবাড়িতে পানি উঠায় ভোগান্তিতে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে রোববার সারাদিন বন্দরনগরী চট্টগ্রামে হালকা থেকে মাঝারি মাত্রার বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়াবিদ নিলুফার জাহান বলেন, মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে শুক্রবার সকাল থেকে চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় থেমে থেমে বৃষ্টিপাত হচ্ছে। রোববার সারাদিনসহ আরো কয়েকদিন চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় হালকা থেকে মাঝারি মাত্রার বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। এরপর ধীরে ধীরে বৃষ্টিপাত কমে আসবে।
নগরীর লালখান বাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় পাহাড়ের নিচে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারীদের দ্রুত সরিয়ে নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী নূরুল ইসলাম বিএসসি। রোববার সকাল ১১টার দিকে মন্ত্রী লালখান বাজার পোড়া কলোনি এলাকায় পাহাড়ের নিচে দেওয়াল ধসে তিনজন নিহতের ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান। এসময় মন্ত্রীর সঙ্গে জেলা প্রশাসক মেজবাহ উদ্দিন আহমেদও ছিলেন। মন্ত্রী তাৎক্ষণিকভাবে নিহতদের প্রত্যেকের পরিবারকে ২০ হাজার টাকা করে অনুদান দেয়ার ঘোষণা দেন। এছাড়া হতাহত ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে চাল-ডাল দেয়ারও ঘোষণা দেন মন্ত্রী।মন্ত্রী লালখান বাজার পোড়া কলোনি এলাকায় পাহাড়ের নিচে যেসব মানুষ ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে তাদের দ্রুত সরিয়ে নেবার জন্য জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেন। একইসঙ্গে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় পাহাড়ের নিচ থেকে বসবাসকারীদের সরিয়ে নেয়ার জন্য ব্যবস্থা নিতে বলেন মন্ত্রী।মন্ত্রীর একান্ত সচিব নিয়াজ মোরশেদ নিরু বাংলানিউজকে বলেন, মন্ত্রী মহোদয় দ্রুততার সাথে পাহাড়ের নিচ থেকে বসবাসকারীদের সরাতে জেলা প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছেন।এছাড়া নগদ টাকা,চাল-ডাল দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।লালখান বাজারের পর মন্ত্রী আমিন কলোনিতে পাহাড় ধসের ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান বলে জানান নীরু।
লালখান বাজার পোড়া কলোনিসহ আশপাশের এলাকায় পাহাড়ের নিচে বসবাস করে এমন পরিবারের সংখ্যা জেলা প্রশাসনের হিসেবে ৬০০। এদের মধ্যে দু’শ পরিবারকে জুন মাসে বর্ষণের সময় সরিয়ে নেয়া হয়। বাকি আরও চার’শ পরিবারকে স্থানীয় শহীদনগর স্কুলে সরিয়ে নেয়ার জন্য জেলা প্রশাসন ব্যবস্থা নিচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।বর্ষা মৌসুমে পাহাড় ও দেওয়াল ধসে গত ৮ বছরে প্রায় ২০০ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। এর মধ্যে ২০০৭ সালের ১১ জুন স্মরণকালের ভয়াবহ পাহাড় ধসে চট্টগ্রামে ১২৭ জনের প্রাণহানি ঘটে। ২০০৮ সালের ১৮ আগস্ট লালখানবাজারের মতিঝর্ণা এলাকায় পাহাড় ধসে মারা যান ১১ জন, ২০০৯ ও ২০১০ সালে নগরীর পাহাড়তলী, সিআরবি, ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় বিচ্ছিন্নভাবে মারা যান আরও ১৫ জন।২০১১ সালের ১ জুলাই পাহাড় ধসে একই পরিবারের ৮ জনসহ বাটালি পাহাড়ের রিটেইনিং দেয়াল ধসে ১৭ জন মারা যান। ২০১২ সালে ১৭ জুন নগরীর ফিরোজ শাহ কলোনিসহ বিভিন্ন এলাকায় ২৩ জন মারা গেছেন। ২০১৩ সালে পাহাড় ও দেয়াল ধসে মৃত্যু হয়েছে কমপক্ষে ৫ জনের।২০০৭ সালে পাহাড় ধসের ঘটনার পর চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারের নেতৃত্বে একটি কমিটি ২৮টি কারণ নির্ধারণ করে ৩৬টি সুপারিশ প্রণয়ন করে। তবে সুপারিশগুলো আজ পর্যন্ত সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন হয়নি।
জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, নগরীর ১১টি পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে ৬৬৬টি পরিবার বসবাস করছে। এর মধ্যে নগরীর একে খান মালিকানাধীন পাহাড়ে ১৮৬ পরিবার, ইস্পাহানি পাহাড়ের দক্ষিণ পাশে হারুন খানের পাহাড় ও বায়তুল আমান সোসাইটির কাছে পাহাড়ে ৫টি, কৈবল্যধাম বিশ্ব কলোনি পাহাড়ে (পানির ট্যাংক) ২৭টি, লেকসিটি আবাসিক এলাকার পাহাড়ে ১২টি, আকবর শাহ আবাসিক এলাকা পাহাড়ে ২২টি, পরিবেশ অধিদপ্তরের কাছে সিটি কর্পোরেশন পাহাড়ে ১১টি,ফয়েজ লেক আবাসিক এলাকার কাছে পাহাড়ে ৯টি, ফরেস্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট অ্যাকাডেমির উত্তর পাশে মীর মোহাম্মদ হাসানের মালিকানাধীন পাহাড়ে ৩৮টি, নাসিরাবাদ শিল্প এলাকা সংলগ্ন পাহাড়ে ৩টি, জালালাবাদ হাউজিং সোসাইটি সংলগ্ন পাহাড়ে ৩৩টি, মতিঝর্ণা ও বাটালি হিল পাহাড়ে ৩২০টি পরিবার ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে। এ ১১টি পাহাড় ছাড়াও আরো ১৪টি পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি রয়েছে।চট্টগ্রামের সরকারি- বেসরকারি পাহাড়গুলোতে প্রভাবশালীদের সহায়তায় নিম্ন আয়ের লোকজন অবৈধভাবে বসতি গড়ে তোলে। প্রতি বছরই চট্টগ্রামে পাহাড় ও মাটি ধসে বিভিন্ন এলাকায় লোকজন মারা যায়।