দৈনিকবার্তা-ঢাকা,১৯জুলাই ২০১৫ :পবিত্র ঈদুল ফিতরের ছুটিতে রাজধানী ঢাকা আজ ছিল পুরো ফাঁকা।গতকাল ঈদের দিন থেকে কখনো থেমে থেমে আবার কখনো মুশলধারে অবিরাম বৃষ্টি হওয়ার কারণে যারা ঘর থেকে বের হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেছেন,তারাও বের হতে পারছেন না।এতে করে ফাঁকা নগরীতে আয়েশীভাবে যে একটু ঘুরে বেড়াবেন বা পরিবার নিয়ে বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে যাবেন, বৃষ্টির কারণে সে ইচ্ছে জলাঞ্জলি দিয়ে তাদের অনেককেই ঘরে বন্দী হয়ে থাকতে হচ্ছে। অবশ্য অনেকে এসব উপেক্ষা করেই বেরিয়ে পড়ছেন, ছুটছেন গন্তব্যে।এদিকে, বাংলাদেশের ওপর মৌসুমি বায়ু মোটামুটি সক্রিয় থাকায় চলতি মাসের শেষ পর্যন্ত টানা বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনার রয়েছে। আগস্টের শুরুর দু’একদিন বাদে আগামী মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত থেমে থেমে বৃষ্টিপাতের কথাও বলছে আবহাওয়া সংশ্লিষ্ট ওয়েবসাইটগুলো। ঈদের দ্বিতীয় দিন সকাল থেকে রাজধানীতে বৃষ্টি হচ্ছে। এতে ভোগান্তি তে পড়ে মানুষ। শ্রাবণের বৃষ্টির হাত থেকে মুক্তি মিলছে না সহজে। আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, আরও দিন তিনেক থাকবে বৃষ্টির এই দাপট।
ঈদের দিন সকাল থেকে রোববার সকাল ছয়টা পর্যন্ত রাজধানী ঢাকায় বৃষ্টি হয়েছে ৯০ মিলিমিটার। এর পর মাত্রা যেন আরও বাড়ছে। সকাল ছয়টা থেকে বেলা তিনটা পর্যন্ত বৃষ্টি হয়েছে ২৩ মিলিমিটার। সকাল থেকে বেলা ১২টা পর্যন্ত চট্টগ্রামে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়েছে ৬০ মিলিমিটার। এ ছাড়া কুতুবদিয়া ও সীতাকুণ্ডে ৫২, টেকনাফে ৩৯ আর কক্সবাজারে ২৭ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে।আবহাওয়া অধিদপ্তর জানায়, দেশের মধ্য ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে বৃষ্টির পরিমাণ বেশি। তবে উত্তরে রংপুর, সৈয়দপুর ও বগুড়ায় এর পরিমাণ কিছুটা কম।বিরামহীন এই বৃষ্টিকে অস্বাভাবিক বলতে নারাজ আবহাওয়াবিদরা।অধিদপ্তরের পরিচালক শাহ আলম বলেন, মৌসুমি বায়ু সক্রিয় থাকলে বৃষ্টির ধরন এমনই হয়। এর সঙ্গে আছে নিম্নচাপ। এর কেন্দ্র এখন আবার রাজধানী ঢাকা। এ কারণে ঢাকাতেও বেশি বৃষ্টি হচ্ছে।
তিনি জানান, ২১ জুলাইয়ের পর চট্টগ্রামে বৃষ্টি কমে আসবে। ঢাকায় ২৩ জুলাইয়ের পর কমলেও পরে মাত্রা আরও বাড়তে পারে। তাই বৃষ্টি থেকে নগরবাসীর মুক্তি মিলবে না সহজে। রোববার দিনভর আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকার কথা জানিয়েছে আকু ওয়েদার। আবহাওয়ার পূর্বাভাসে তারা আরো বলছে, সূর্যের দেখা না মিললে রাতে রাজধানীর তাপমাত্রা ২৬ ডিগ্রি পর্যন্ত নামতে পারে।সকালে দফায় দফায় বৃষ্টিপাত হলেও বিকেলথেকে বর্ষণের মাত্রা বাড়বে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতর।অধিদফতর আরো বলছে, রোববার সারাদেশে থেমে থেমে বৃষ্টিপাত সম্ভাবনা রয়েছে। তবে খুলনা, বরিশাল, ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট বিভাগের কোথাও কোথাও অতি ভারী বৃষ্টিপাত হবে। এর ফলে আরো পাহাড় ধস দেখা দিতে পারে চট্টগ্রাম ও সিলেটে।গত ২৪ ঘণ্টায় সবচেয়ে বেশি সীতাকুণ্ডে ১০৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতের কথা জানিয়েছে অধিদফতর। এছাড়া কুমিল্লায় ১০৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।ঈদুল ফিতর উপলক্ষে রাজধানী ঢাকা মূলত গত বুধবার থেকেই ফাঁকা হতে শুরু করেছে। পরিবার ও আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে নগরবাসী ওই দিন থেকেই রাজধানী ছাড়তে শুরু করেছে।
বৃহস্পতিবারও অফিস করে অনেকে রাজধানী ছেড়েছেন। শুক্রবার থেকে তো টানা তিন দিনের ঈদ ছুটিই শুরু হয়েছে। আর সেদিন সবচেয়ে বেশি মানুষ নাড়ির টানে ঢাকা ছেড়েছেন। এতে করে প্রায় দেড় কোটি মানুষের ঢাকা এখন অনেকটাই ফাঁকা হয়ে পরেছে। শুক্রবারের পর থেকে প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়েছে বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ত নগরী ঢাকা। অথচ কয়েক দিন আগেও রাজধানী ছিল মানুষে সরগরম।অসহ্য যানজটের নগরী ঢাকার ব্যস্ত সড়কগুলো এখন ফাঁকা পড়ে আছে। হাতে গোনা কিছু যানবাহন চলাচল করছে। অথচ যে শহরে মানুষ গায়ের সঙ্গে গা লাগিয়ে হেঁটে থাকেন, সে শহর এখন অনেকটাই মানবশূন্য।তবে এর মধ্যেও যারা একটু ঘর থেকে বের হতেন, তারাও এখন টানা বর্ষণের কারণে গৃহবন্দি হয়ে আছেন।ঢাকার স্থানীয় বাসিন্দা সোলায়মান আলী বাসসকে জানান, বড় বড় রাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের সময় ঢাকা শহরকে চেনাই যায় না। আর এখন মনে হয় অন্যরকম এক নগরী। তবে এই সময়টা আমাদের একটু আরামে কাটে। রাস্তা-ঘাটসহ সবকিছু একটু ফাঁকা থাকে। ছেলেমেয়েদের নিয়ে এ সময় একটু আরামে চলাফেরা করা যায়। এবার অবশ্য বৃষ্টির কারণে সে চলাচলেও ভাটা পরেছে।বাসাবোর মুদি দোকানী মাসুদ হাসান জানান, ঈদের ছুটিতে রাজধানী ঢাকা যেন ভুতুড়ে নগরীতে পরিণত হয়েছে। মানুষজনের তেমন হৈ-হল্লা নেই। কাস্টমারও কমে গেছে। তবে ফাঁকা ফাঁকা পরিবেশটা খারাপ লাগছে না।এ দোকানেই পণ্য কিনতে আসা শামীম নামের এক ব্যক্তি বলেন, ঈশ! সব সময় যদি পরিবেশটা এমন শান্ত থাকতো, কোন রকম যানজট ছাড়া নগরীর গাড়িগুলো এখনকার মত অনবরত চলাচল করতো, তাহলে কতই না ভাল হতো। নিমেষেই ঢাকার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে চলে যাওয়া যেত।
আজ সরেজমিনে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে যানজটবিহীন এক অন্যরকম নগরীর দেখা গেছে। ফুটপাথেও হকারের কোন কোলাহল চোখে পড়েনি। একেবারেই নির্ঞ্ঝাট শান্তশিষ্ট এক নগরীর আবেশ অনুভব করছে এখন ঢাকার বাসিন্দারা, যা তাদের সব সময়ই কাম্য।ফাঁকা নগরীতে চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে কিনা এমন আশঙ্কা থাকে নগরবাসীর। তবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বাসা-বাড়িতে চুরি ও ডাকাতি প্রতিরোধে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে বলে নগরবাসীকে আসস্থ করেছে, যাতে ঈদ আনন্দ উপভোগ করে নগরীতে ফিরে কাউকে দুর্ভোগে পরতে না হয়।
ঈদের পরদিন রোববার ঢাকা চিড়িয়াখানার হাজারো পশুপাখি এবং গাছগাছালি ভরা নির্মল পরিবেশ রাজধানীবাসীর বিনোদনের চাহিদা মেটালেও এবার তাতে ভাটা পড়েছে। টানা বৃষ্টিতে লক্ষ্যমাত্রার অনেক কম দর্শনার্থী এসেছে চিড়িয়াখানায়।সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত এসেছে মাত্র কয়েক হাজার দর্শনার্থী।বৃষ্টির কারণে চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ এবং দর্শনার্থীরাও রয়েছেন বিপাকে। বোটানিক্যাল গার্ডেনেও দর্শনার্থী প্রায় শূন্য। বেচাবিক্রি না থাকায় চিড়িয়াখানা ও বোটানিক্যাল গার্ডেন কেন্দ্রিক দোকানদাররাও হতাশ।
ঢাকা চিড়িয়াখানার কিউরেটর ড.এনায়েত হোসেন রোববার বলেন, ঈদের পর দিন এক লাখের বেশি দর্শনার্থীর লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল। কিন্তু বৃষ্টির কারণে সকাল থেকে বেলা তিনটা পর্যন্ত ১০/১৫ হাজার দর্শনার্থীর আগমন ঘটেছে।বিপুল সংখ্যক দর্শনার্থী প্রবেশের লক্ষ্যমাত্রা ধরে চিড়িয়াখানায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছুটি বাতিল করা হলেও তারা প্রায় অলস সময় পার করছেন। বৃষ্টিতে ভিজেই কিছু দর্শনার্থী চিড়িয়াখানার পশুপাখি দেখছেন। এসেছে তরুণ-তরুণীরাও।দ্বিতীয় দিনে টার্গেট পূরণ না হলেও তৃতীয় দিন সোমবার আবহাওয়া ভাল থাকলে দর্শনার্থী ভরে যাবে বলে আশা প্রকাশ করে কিউরেটর এনায়েত হোসেন বলেন, দর্শনার্থীদের জন্য আমাদের সব প্রস্তুতি রয়েছে। আর বিকেলে বৃষ্টি না থাকলে দর্শনার্থী বাড়বে।ঢাকাবাসীর ঈদ আনন্দের সঙ্গী হয়েছে ঢাকা শিশু পার্ক, চিড়িয়াখানা, জাতীয় জাদুঘর, শিশুমেলা, ফ্যান্টাসি কিংডম, নন্দন পার্কসহ অন্যান্য বিনোদন কেন্দ্রগুলো। তবে বৃষ্টির কারণে এসব কেন্দ্রগুলোতে দর্শনার্থীর আগমন ছিল প্রত্যাশার চেয়ে কম।ঈদে যারা ঢাকা ছেড়ে যাননি এবং ঢাকায় যাদের আত্মীয়-স্বজন বলতে বিশেষ কেউ নেই মূলত তাদের জন্য এই বিনোদন কেন্দ্রগুলোই ছিল ঈদের সঙ্গী। অন্যান্য ঈদে এসব কেন্দ্রে যত ভিড় থাকে এবারে ততটা ভিড় ছিল না। বৃষ্টিতে অনেকে বের হতে পারেননি।ঢাকার বিনোদনকেন্দ্রগুলো প্রতি বছরের মতো এবারও ঈদ-উল-ফিতরের ছুটির ৩ দিন খোলা থাকবে। বিশেষত শিশুপার্ক, শিশুমেলা, চিড়িয়াখানা, বোটানিক্যাল গার্ডেন, জাতীয় জাদুঘর ও আহসান মঞ্জিলে ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে ছুটে আছে ছোটবড় সকলে।
ক্রিকেটীয় ভঙ্গিমায় কোন একটি দলের বড় জয়কে বুঝানোর ক্ষেত্রে ‘একচেটিয়া শব্দটি‘ বহুল ব্যবহৃত। এবারের ঈদুল ফিতরের ঈদটাতেও ঠিক এভাবেই রাজত্ব করলো বৃষ্টি। প্রথম দিনের বৃষ্টিটা থেকে থেমে চললেও দ্বিতীয় দিনটিতে বৃষ্টি শুরু হয়েছে ভোর হবার আগেই। ফলে আতœীয়-স্বজন নিয়ে একটু ঘুরে বেড়ানোর আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়ে ঘরের ভেতরেই ছটফট করতে হচ্ছে ঢাকাবাসীকে।তবে সবাই কিন্তু ঘরে বসে থাকার লোক নয়। অনেক নাছোরবান্দা রয়েছে যাদের বৃষ্টি হলেও ঘুরতে হবে। বিশেষ করে একটু অল্পবয়সীরা বৃষ্টি মাথায় ঘরে থাকতে বেশ নারাজ। পার্ক-বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে বসার জায়গা না থাকলেও রিকশা নিয়ে ঘুরে বেড়ানো, লেকের মধ্যে দিয়ে ছাতা মাথায় দু-জনে মিলে গল্পের ছলে হাঁটা এসব চলছেই।সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড় থেকে একটি বাসে উঠলেন আব্দুর রহমান তার বউকে নিয়ে। সঙ্গে আরও রয়েছে ৪ বছর ও ৭ বছরের দুই বাচ্ছা রনি ও জনি। উদ্দেশ শিশু পার্কে যাওয়া। বৃষ্টি মাথায় বাচ্চাদের নিয়ে বের হলেন, বাচ্চাদের তো জ্বর হতে পারে। এমনটা বলার পর আব্দুর রহমান সাহেব বললেন, আমার তো আজকেই ছুটি শেষ হয়ে যাবে। বাচ্চাদের নিয়ে কালকেই বের হতে গিয়ে বৃষ্টির কারণেই ফিরে গেছি। কিন্তু আজ ওদের নিয়ে শিশুপার্কটা অন্তত ঘুরে যাবো। এজন্যই বের হওয়া।শিশুপার্কের সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখা গেল, একটু পরপরই দুই একটা করে সিএনজি, প্রাইভেট কার আসছে। গাড়ি থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গেই বাচ্চারা লাফালাফি শুরু করে দিচ্ছে। বৃষ্টি তো ওদের কাছে কোন সমস্যা নয়। চাইলেই সেখানে গড়াগড়ি খেতে পারে, শুধু যদি বাবা-মা না বলে, ‘এই ওদিকে যেও না।
বৃষ্টির কারণে রাস্তায় রিকশা-সিএনজি থাকলেও বের হচ্ছে না গণপরিবহনগুলো। বৃষ্টিতে যাত্রী রাস্তায় বের হবে না বলেই তারাই গাড়ি নিয়ে বের হচ্ছে না। মোহম্মদপুর থেকে ছেড়ে আসা মৈত্রী পরিবহনের চালক কামাল মিয়ার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অনেক চালক আছে। গাড়িও বের করা যায়। কিন্তু বৃষ্টিতে তো এত মানুষ বের হবে না। এইযে দেহেন গাড়ি খাইল্যা যাইতাছে। এইজন্য আমরা কমকম ট্রিম মারতাছি। দিন ভালো হইলে অনেক গাড়ি বাইর হইতো। ভাড়াও নেয়া হচ্ছে বেশী।
জ্যামের এ নগরীটিতে মানুষ অতিষ্ট হয়ে উঠলেও ঈদের সময়টাতে ফাঁকা রাস্তায় ঘুরে বেরানোর আনন্দ নেয়ার পরিকল্পনা ছিল অনেকেরই। কিন্তু ঈদের দিন এবং ঈদের পরের দিন সে জায়গায় বাগড়া দিয়ে বসে অছে বৃষ্টি। মনে হচ্ছে আনেক দিন আনন্দ করে না বৃষ্টি। তাই সবাইকে ঘরে বন্দি করে নিয়ে যত খুশি আনন্দ করে নিচ্ছে ।